|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
রসোত্তীর্ণ হল না নতুন অ্যাস্টেরিক্স |
অভিজিত্ গুপ্ত |
অ্যাস্টেরিক্স অ্যান্ড দ্য পিক্টস, কাহিনি: জঁ-ঈভ ফেরি, ছবি: দিদিয়ের কনরাদ। অনুবাদ: অ্যান্থিয়া বেল।
ওরায়ন, ভারতীয় পরিবেশনা: হাসেত, ৫৯৫.০০ |
১৯৫৯ সালে ‘পিলোত’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে অ্যাস্টেরিক্স কমিক্সের সূচনা ও তার দু’বছর পর অ্যাস্টেরিক্স দ্য গল নামে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ। ২০১৩ সালে প্রকাশিত অ্যাস্টেরিক্স অ্যান্ড দ্য পিক্টস এই সিরিজের ৩৫ নম্বর অ্যালবাম। এই ৫২ বছরের প্রকাশনার ইতিহাসকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হ্রেনে গসসিনি ও আলব্যের উদের্জো-র যৌথ সৃষ্টি ২৪টি অ্যালবাম-- লেখা গসসিনির ও ছবি উদের্জো-র, এবং প্রকাশক দারগ্যো। ১৯৭৭ সালে গসসিনির মৃত্যুর পর উদের্জো একাই লেখা ও ছবির কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন, ২০০৯ অবধি বেরোয় আরও ১১টি অ্যালবাম যেগুলি প্রকাশ করে দুই স্রষ্টার নামধারী আলব্যের-হ্রেনে প্রকাশনা। ইতিমধ্যে প্রথম ২৪টি অ্যালবাম স্বত্ব কেন্দ্র করে গসসিনি-উদের্জো পরিবারের সঙ্গে দারগ্যো-র মোকদ্দমা বাধে, মামলায় জিতে উদের্জো কিন্তু আলব্যের-হ্রেনের বদলে হাসেত কোম্পানিকে প্রথম ২৪টি বইয়ের স্বত্ব বিক্রয় করেন।
ঝামেলা বাঁধে এর পর থেকে। উদের্জো প্রথমে জানিয়েছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পর আর নতুন কোনও অ্যাস্টেরিক্স বেরোবে না। কিন্তু ২০০৮ সালে মত বদলে তিনি সিরিজের সমস্ত স্বত্ব হাসেতকে বেচে দেন। নাটকীয় ভাবে উদের্জোর মেয়ে সিলভি বাবার এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে ‘ল্য মঁদ’ সংবাদপত্রে লেখেন: ‘I am entering resistance against perhaps the worst enemies of Asterix, the men of finance and industry... It’s as if the gates of the Gaulish village had been thrown open to the Roman Empire’. কিন্তু এ সত্ত্বেও ২০১১ সালে দু’জন নতুন স্রষ্টার নাম ঘোষণা করেন উদের্জো লেখায় জঁ-ঈভ ফেরি ও ছবিতে ফ্রেদেরিক মেবের্কি। দ্বিতীয়জন পিছিয়ে আসায় দিদিয়ের কনরাদ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
অ্যাস্টেরিক্স অ্যান্ড দ্য পিক্টস প্রকাশের সঙ্গে এই সিরিজের নবজন্ম হল বলা যায়। কিন্তু এই উত্তরাধিকার বহনে কত দূর সফল ফেরি-দিদিয়ের জুটি? অন্য অ্যালবামগুলির মতো এটিতেও জুলিয়াস সিজারের আমলের অপ্রতিরোধ্য গলীয় গ্রামের বাসিন্দারা সকলেই স্বমহিমায় উপস্থিত। জলে ভেসে আসা রহস্যময় এক আগন্তুককে কেন্দ্র করে এই নতুন অ্যাডভেঞ্চারের শুরু। ম্যাকারুন নামক এই স্কটল্যান্ডবাসীকে স্বদেশে প্রত্যর্পণের উদ্দেশ্যে অ্যাস্টেরিক্স ও তার দোসর ওবেলিক্স ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে পৌঁছয় পিক্টসদের দেশ ইংল্যান্ডে। এর আগে মাত্র এক বারই বিলেত যাত্রা করেছে দুই গলবাসী যার বিবরণ আমরা পাই ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত অ্যাস্টেরিক্স ইন ব্রিটেন বইটিতে। অনেকের মতে এই বইটি অ্যাস্টেরিক্স-সিরিজের অন্যতম সেরা, ইউরোপের চোখে ব্রিটেন নামক ভূখণ্ডের বিচিত্র বাসিন্দাদের বিচিত্র খেয়ালখুশির এক বুদ্ধিদীপ্ত আবোলতাবোল, যাতে প্রায় অনিবার্য ভাবে এসেছে রাগবি, বিটলস, চা-পান ও উইকেন্ড বা সপ্তাহান্তের প্রসঙ্গ। ফেরি-দিদিয়ের জুটির বইটিতে কিন্তু দুধের সেই স্বাদ ঘোলেই মেটাতে হল, দু-একটি প্যানেল ছাড়া স্কটদের নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ারকি সে ভাবে রসোত্তীর্ণ হতে পারল না।
সাবেকি অ্যাস্টেরিক্স-সিরিজের প্রধান আকর্ষণ তিনটি: গলীয় গ্রামের কলহপ্রিয় অথচ স্বাধীনচেতা বাসিন্দাদের নিয়মিত রোমান-প্রহার যা প্রায় এক জাতীয় ক্রীড়ায় পরিণত, ইউরোপের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা থেকে উত্সারিত নির্মল হাস্যরস, ও ব্যক্তিনামকে কেন্দ্র করে নিরন্তর শব্দের খেলা যেগুলি সমাধান করার মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কের ভারি আরামদায়ক ব্যায়াম হয়। ইংরেজি ভাষায় এই সিরিজের অসাধারণ অনুবাদ করে পাঠকদের বহু দিন আনন্দ দিয়েছেন ডেরেক হকরিজ (২০১৩ সালে প্রয়াত) ও অ্যান্থিয়া বেল জুটি, এই বইটিতেও দ্বিতীয়জনের তর্জমার গুণে এক বারও মনে হয়নি অনুবাদ পাঠ করছি (এ প্রসঙ্গে দুঃখের সঙ্গে বলতেই হচ্ছে যে অ্যাস্টেরিক্সের বাংলা অনুবাদে শব্দ ও নাম নিয়ে খেলা করার যে অসাধারণ সুযোগ ছিল, তা কখনওই গ্রহণ করা হয়নি, কিশোরপাঠ্য করার তাগিদে প্রাপ্তমনস্ক পাঠকদের চাহিদা অপূর্ণ থেকে গেছে)। এই বইটিতে কিন্তু এই তিনটি প্রত্যাশার কোনওটিই সে ভাবে পূরণ হয়নি। এক মাত্র নেসির ব্যবহারই পুরনো অ্যাস্টেরিক্সকে মনে করায়। স্কটদের নামকরণে ম্যাক-উপসর্গ আরও সৃষ্টিশীল ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারত, সাম্প্রতিক স্কটিশ ইতিহাস, বিশেষত আসন্ন স্কটিশ রেফারেন্ডামের প্রেক্ষিতে, হয়তো আরও সচেতন ভাবে ব্যবহার করা যেত। অন্য দিকে যারা অ্যাস্টেরিক্সকে প্রধানত শিশুসাহিত্য হিসেবে দেখতে চান, তারা হয়ত চাইবেন যে এই সিরিজ প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্রব এড়িয়েই চলুক। ছবির দিক দিয়ে কনরাদ পুরনো অ্যাস্টেরিক্সের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন, যদিও এই সংস্করণে গ্লসি বা চকচকে কাগজ ব্যবহার করার প্রয়োজন ঠিক বোঝা গেল না। ১৯৫৯ সালে যখন অ্যাস্টেরিক্সের যাত্রা শুরু, তখন ফ্র্যাঙ্কো-বেলজীয় কমিক্সের স্বর্ণযুগ। এক দিকে টিনটিন-খ্যাত ও ligne claire (clear line)-এর প্রবক্তা অ্যার্জে, অন্য দিকে গসসিনি-উদের্জো-র এই সিরিজ মার্কিন কমিক্সের সুপারহিরো ঘরানার বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। কিন্তু আশির দশক থেকে কমিক্স-সাহিত্যে যে সম্পূর্ণ নতুন ও অভাবিত বিবর্তন ঘটতে থাকে, তার প্রেক্ষিতে অ্যাস্টেরিক্স বা টিনটিনের মতো কমিক্স একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তের ফসল বলেই মনে হয়। টিনটিন যেমন শীতল যুদ্ধ বা Cold War-উত্তর রাজনীতির আঙ্গিনায় এক একাকী সৈনিক, তেমনই অ্যাস্টেরিক্স সিরিজে আমরা পাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রমবিবর্তনের কৌতুকময় পাদটীকা। কিন্তু একুশ শতকে টিনটিন বা অ্যাস্টেরিক্স কতদূর স্বচ্ছন্দ? সম্প্রতি স্টিভেন স্পিলবার্গের পরিচালনায় টিনটিন চলচ্চিত্রায়িত হয়ে সমকালীন হওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু অ্যাস্টেরিক্সের পক্ষে সে পথ বোধহয় খুব সুগম নয়। রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে একটিমাত্র অকুতোভয় গলীয় গ্রামের অসম সংগ্রামের কাহিনিকে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা প্রদান করার ইচ্ছে সংবরণ করলেই ভাল করতেন আলব্যের উদের্জো। |
|
|
|
|
|