শনিবারের নিবন্ধ ২...
২১ রজনী সেন রোড
ডোরবেল বাজাতেই দরজা থেকে উঁকি মারলেন বছর তিরিশের এক অবাঙালি মহিলা।
“কী চাই?”
“এটা ২১ নম্বর রজনী সেন রোড?”
ভাঙা বাংলায় মহিলা উত্তর দিলেন, “না। ২১ এ। ২১ বি-ও আছে। কিন্তু ২১ নম্বর রজনী সেন রোড বলে কিছু নেই। কোনও দিনই ছিল না। তবে আপনার মতো অনেকেই এই খোঁজে আসেন।”
কেন আসেন তার আর প্রশ্নের দরকার নেই। ২১ নম্বর রজনী সেন রোডই যে গোয়েন্দা ফেলুদার বাড়ি।
রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন থেকে হাঁটা পথে মিনিট দশ। রজনী সেন রোড। দক্ষিণ কলকাতার বর্ধিষ্ণু পাড়াগুলোর একটি।
প্রায় পঁচিশ ফুট চওড়া রাস্তা। এক ধারে আরও দশ ফুটের ফুটপাথ। সার দেওয়া গায়ে গায়ে বাড়ি। বহুতল, সাবেকি মিলিয়ে। এই রাস্তার একেবারে উপরে সামনে-পিছনে দুটো বাড়ি।
সামনেরটা ২১বি। তার ঠিক গায়েই সিমেন্টের বাঁধানো সরু গলি। সেই গলির মুখে লোহার দরজা ঠেলে এগোলেই শেষ প্রান্তে ২১এ।
২১ কোনও কালেই ছিল না। তাই কি ফেলুদা-জনক এই ঠিকানাটাকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁর গোয়েন্দা-বাসা? হতে পারে।
রজনী সেন রোডের বাড়ির বৈঠকখানাতে বসেই চারমিনারের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রহস্যের জিলিপির জট ছাড়াতেন ফেলুদা। চায়ের সঙ্গে ডালমুট বা লালমোহনবাবুর আনা গরম গরম শিঙাড়া সহযোগে সিমলা থেকে কাশ্মীর যাওয়ার প্ল্যান করতেন।
এই বাড়ির বৈঠকখানার দরজার ডোরবেল বাজলেই কোনও মক্কেল এসেছে ভেবে দ্রুত দরজা খুলে দিত তোপসে। সামনের রাস্তাতে তাঁর বিখ্যাত সবুজ অ্যাম্বাসাডরটা এনে রাখতেন লালমোহনবাবু।
ছবির ডান ধারে দাঁড়িয়ে ২১এ রজনী সেন রোড।
“আপনি কোনও দিন রজনী সেন রোডের বাড়িটার খোঁজে গেছেন?” পর্দার প্রথম ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করতে বললেন, “না কোনও দিন যাইনি।”
অথচ ’৭৪ সালে যখন ‘সোনার কেল্লা’, কী ’৭৮ সালে যখন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ সেলুলয়েডে এল, তখন তিনি লেক টেম্পল রোডে সত্যজিৎ রায়েরই ছেড়ে আসা তিন তলার ফ্ল্যাটের বাসিন্দা।
যেখান থেকে রজনী সেন রোডের দূরত্ব গাড়িতে মিনিট পাঁচেকও নয়। তাতেও ২১ নম্বর বাড়িটা নিয়ে কোনও উৎসাহ দেখাননি তিনি।
“আসলে বাড়িটা তো কল্পনার। অস্তিত্ত্বই নেই। তা ছাড়া ওটা ফেলুদারও নয়, তার কাকার। আমিও খুঁজে পেতে দেখতে যাওয়ার কোনও উৎসাহ পাইনি।” বললেন ফেলুদা নম্বর দুই, সব্যসাচী চক্রবর্তী।
দুই ‘ফেলুদা’ই এ ব্যাপারে প্রায় এক সারিতে। কী বলেন ‘তপেশরঞ্জন’রা?
প্রথম ‘তপেশ’ সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। যার সঙ্গে জটায়ুর সংলাপের সূত্র ধরেই ‘সোনার কেল্লা’য় প্রথমবার ফেলুদার ডেরার ঠিকানা পাওয়া যায়।
সিদ্ধার্থ বললেন, “সত্যিই কোনও দিন ভেবেই দেখিনি। আর বাড়িটাও ঠিক কোথায় আইডিয়া নেই।”
দ্বিতীয় ‘তপেশ’ শাশ্বতরও রজনী সেন রোড নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই। শুধু আরেক ‘তপেশ’ পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বললেন, “একেবারে ছোটবেলায় যখন সবে ফেলুদা পড়ছি, তখন যেতে ইচ্ছে করত। বড় হয়ে সেটা আর ছিল না।”
আর ফেলু মিত্তিরের ভক্তকুল? তাঁরা কী বলেন?
২১ নম্বর নেই। তাতে কী? বাড়িটা কাল্পনিক। বয়েই গেছে। তাঁদের অনেকেরই ভাবখানা ঠিক এই রকম। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে প্রায়ই এখানে সকাল-দুপুর যখন তখন সটান হাজির হন উৎসাহী ভক্তকুল।
২১ এ-র এক তলায় বাস এক দক্ষিণী মহিলার। পেশায় গৃহশিক্ষিকা ওই মহিলা বললেন, “বাংলা পড়তে পারি না বটে, কিন্তু ফেলুদার সিনেমা দেখেছি। ফেলুদা-প্রেমীরা এই বাড়ি মাঝে মধ্যে দেখতে আসেন ঠিকই। তবে ঠিকানার কিছুটা মিল থাকা ছাড়া আর অন্য কোনও কিছু না পেয়ে তাঁরা চলেও যান।”
২১ বি নম্বরটিতে রয়েছে নানা বেসরকারি অফিস। অফিসের অনেকে আবার ফেলুদার নামটাই জানেন না। কেউ কেউ আবার জানেন, কিন্তু তেমন উচ্ছ্বাস নেই।
ফেলুদা-প্রেমীদের একটা অংশের মতে, লন্ডনে যদি ২২১বি বেকার স্ট্রিট থাকতে পারে, সেখানে যদি শার্লক হোমসের মিউজিয়াম তৈরি হতে পারে, তাহলে কলকাতাতেই বা কেন ফেলুদার মিউজিয়াম হতে পারে না?

ব্যোমকেশের মেসবাড়ি
৬৬ নম্বর হ্যারিসন রোড। আরেক জনপ্রিয় গোয়েন্দা ব্যোমকেশের ঠিকানা। সত্যবতীর সঙ্গে বো্যমকেশের বিয়ে হওয়ার আগে অজিতকে নিয়ে ব্যোমকেশ এই ঠিকানার মেসেই থাকতেন।
এর পর সত্যবতীকে বিয়ে করার পর চলে যান দক্ষিণ কলকাতার কেয়াতলায়। কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে হ্যারিসন রোড ধরে শিয়ালদহের দিকে মিনিট তিন-চার হাঁটলেই ডান ধারে ৬৬ নম্বর। পলেস্তারা খসা চার তলা বাড়ি। কাঠের বারান্দা। ছাদে সেকেলে পাঁচিলের কাজ করা বেড়া। খড়খড়ি দেওয়া জানলা। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, ভর দুপুরে টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে। একতলায় ভাতের হোটেল। দোতলা থেকে রয়েছে বোর্ডিং। বোর্ডিং ও রেস্টুরেন্টের মালিক বললেন, “১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত এই বোর্ডিংয়ের চারতলাতে থাকতেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।” জানা গেল, ব্যোমকেশ নিয়ে সিনেমা করার জন্য পরিচালক দিবাকর মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন এই মেসবাড়ি দেখতে।

কিন্তু হোমসের বাড়ির তো একটা অস্তিত্ব আছে। এখানে তো তাও নেই। এ যুক্তি কিন্তু মানতে চান না অনেকেই। আসলে হোমসের বাড়ি নিয়েও তো তর্কাতর্কি কম হয়নি।
কোনান ডয়েল যখন একের পর এক গোয়েন্দা কাহিনি লিখছেন, তখন বেকার স্ট্রিটে বাড়ির নম্বর একশো ছাড়ায়নি। শোনা যায়, অস্তিত্ব আছে এমন কোনও বাড়ির নম্বর দিলে তার বাসিন্দাকে বিপদে ফেলে দেওয়া হবে, এ কথা ভেবেই তিনি নাকি তখন হোমসের বাড়ির ঠিকানা দেন ২২১বি। গোড়াতে বাড়িটিকে আপার বেকার স্ট্রিটে দেখানো হত। পরে ‘অ্যাবে ন্যাশনাল বিল্ডিং সোসাইটি’ যখন ২১৯-২২৯ বেকার স্ট্রিটে উঠে আসে, তখন থেকে ‘অ্যাবে’ই হয়ে যায় হোমসের হোম-অ্যাড্রেস। সারা পৃথিবী থেকে চিঠি আসতে থাকে এই ঠিকানায়। তাতে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, হোমস-এর ফ্যান-মেল সামলাতে একজন ফুলটাইম সেক্রেটারিও রাখতে হয়।
এ দিকে হোমসের নামাঙ্কিত ‘মিউজিয়াম’-এর ঠিকানা ছিল ২৩৭-২৪১-এর মধ্যে। ১৯৯০ সালে যখন সেই বাড়িতে ‘২২১বি’ বেকার স্ট্রিট লেখা নীল ফলক লাগিয়ে দেওয়া হয়, শুরু হল নতুন বিতর্ক। খাতায় কলমে হোমসের বাড়ির ঠিকানা ‘অ্যাবে’র থেকে চলে গেল ‘মিউজিয়াম’-এর দখলে। যা আবার ‘অ্যাবে’র কাছে ছিল না-পসন্দ।
জনপ্রিয়তার কারণে হোমসের বাড়ির অস্তিত্ব দেখানো হলেও, কোনান ডয়েলের কাছে তা ছিল কল্পনাই। ঠিক যেমন সত্যজিতের কাছে ফেলুদার ডেরা।
সব্যসাচী চক্রবর্তী বললেন, “বাড়িটা যাই-ই হোক, ফেলুদাকে নিয়ে মিউজিয়াম হলে কিন্তু মন্দ হয় না। আমরা অনেক দিন ধরেই কথাটা বলছি। ফেলুদার ব্যবহার করা জিনিসপত্র তো কম নেই। আমি বেকার স্ট্রিটের বাড়িটায় গেছি। সামনে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলেছি। বেশ ইন্টারেস্টিং।”
আরেকটু এগিয়ে শাশ্বত বললেন, “আজকাল তো ছোটরা ডোরেমন-হ্যারি পটারে আটকে পড়েছে। তার থেকে চোখটা সরাতে এমন একটা মিউজিয়াম ভাল কাজে আসতে পারে।”
কিন্তু কোথায় হতে পারে সে জাদুঘর?
সব্যসাচীর মত, “যেখানেই হোক, সেটা প্রশাসনকে দেখতে হবে। তবে রজনী সেন রোডেই হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। লেক টেম্পল রোডেও হতে পারে।”
সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার বলছেন, “ফেলুদা যেহেতু খাঁটি বাঙালি, এমন একটা রাস্তা বাছা দরকার, যার মধ্যে পুরোনো কলকাতার আমেজটা আছে। একটু গলিঘুঁজি থাকবে। গাড়ি নিয়ে গেলে দূরে রেখে হেঁটে যেতে হবে। রাস্তার নামটাও একটু সাবেকি হতে হবে। এই যেমন মহিম হালদার স্ট্রিট, প্রিয়নাথ মল্লিক রোড। জগুবাবুর বাজারের যে গলিতে মুকুলকে কিডন্যাপ করা হয়, সেটাও জায়গা হিসেবে বেশ ভাল।”
জাদুঘর না হোক, আপাতত রজনী সেন রোডে ফেলুদা-স্পেশাল একটা কফি শপ তৈরি হয়েছে। বছর দেড়েক আগে তৈরি হওয়া এই শপের কিছু মেনুও ফেলুদাকে মনে করায়।
মাছের একটি খাবারের নাম যেমন মছলিবাবা। কয়েকটির নামে আবার জুড়ে আছে লালমোহনবাবুর ‘সাহারায় শিহরন’, ‘হন্ডুরাসে হাহাকার’ মার্কা বিখ্যাত সব ‘পানিং’। চকলেটের একটা ডিশের নাম যেমন ‘চেঁচিয়ে বলো চকলেট’। দেওয়ালে ঝুলে আছে ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ কার্টুন। বুকর্যাকে উঁকি মারে ‘কলকাতায় ফেলুদা’, কী ‘ফেলুদার সপ্তকাণ্ড’। আপাতত এইটকুই। তবু এ পাড়ায় এলে ফেলু মিত্তিরের ভক্তরা কিন্তু একবার না একবার ঢুঁ মারেনই এই ডেরায়।
আসলে, হোক না দুধের স্বাদ ঘোলে, ঘোলেরও তো একটা স্বাদ আছে।

গোয়েন্দা দফতর
• পরশুরামের সৃষ্টি গোয়েন্দা সরলাক্ষ হোম থাকেন বাগবাজার বেচু কর স্ট্রিটে। কিন্তু ঠিকানা জানা যায়নি।
• ষষ্টীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দা থাকতেন হাওড়ার শিবপুরের গোপাল ব্যানার্জি লেন এলাকায়। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা জানা নেই ।
• শিবরাম চক্রবর্তীর চরিত্র গোয়েন্দা কল্কেকাশি থাকতেন ডায়মন্ড হারবার রোডে। তাঁর একটা মোটর গাড়ি ছিল বলে জানা গিয়েছে। ডায়মণ্ড হারবার রোডে কোথায় থাকতেন সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
• বিমল করের গোয়েন্দা কিকিরা আবার জাদুকরও ছিলেন। বিমলবাবু লিখে গিয়েছেন, ওয়েলিংটনের মোড় থেকে সামান্য এগিয়ে কিকিরার বাড়ি।
• সমরেশ বসুর কিশোর গোয়েন্দা গোগল থাকে পার্ক স্ট্রিট থানা এলাকার দশতলার একটি ফ্ল্যাটের পাঁচতলায়।
• সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের চরিত্র কর্নেল থাকতেন ইলিয়ট রোডে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়ায়। তবে এর থেকে বেশি আর কিছু জানা যায় না।
• শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্ত কলকাতা পুলিশের একজন ডিটেকটিভ অফিসার। থাকেন কলকাতাতেই।
• বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের আরও দুই জনপ্রিয় ডিটেকটিভ নীহাররঞ্জন গুপ্তর কিরীটি রায়, স্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জি। দু’জনেরই ডেরার হদিশ জানা নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.