শনিবারের নিবন্ধ ১...
সম্পাদকের শরশয্যা

ম্পাদকের কাজটা যে ঠিক কী এ নিয়ে স্পষ্ট ধারণার চেয়ে শ্লেষ-বিদ্রুপই বেশি। ফলে কেউ আর গুরুত্ব দিয়ে ভাবতেই চায় না সম্পাদককে কী ধরনের দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়, কোন ধরনের কাজ তাঁর নিয়তসঙ্গী, এই বৃত্তিতে তাঁর সম্মান-অসম্মান কতটা! মার্কিন সাহিত্যিক অ্যালবার্ট হুবার্ড (এটাই ওঁর বড় পরিচয়, এ ছাড়াও হুবার্ড ছিলেন শিল্পী, প্রকাশক, দার্শনিক) সেই কবে বলে গেছেন, সংবাদপত্র সংস্থা যে-ব্যক্তিকে সম্পাদক হিসেবে চাকরি দেয়, তাঁর কাজ হল ভুসি থেকে গম আলাদা করা এবং সেই বাছাই করা ভুসিমাল কাগজে ছাপা হয়েছে কি না দেখা! দেখুন, এখানেও সেই ব্যঙ্গ! খবরের কাগজ কিংবা সাময়িকপত্র, যেটাই হোক এই দু’ক্ষেত্রের সম্পাদকদের কাজ নিয়ে বাজারে যে সব কথা চালু আছে তা প্রায়শই ভেসে বেড়ানো উড়ো কথার মতো। সত্যি-মিথ্যে বোঝা মুশকিল।
সাময়িকপত্রের কাজের সঙ্গে তিন দশক ধরে জড়িয়ে আছি। তাই নিউজ পেপারের চেয়ে ম্যাগাজিনের এডিটরদের নিয়ে যেসব চিমটিকাটা অভিমত ছড়িয়ে আছে, সেগুলোর কিছু কিছু জানি। যেমন : এক, যথাসময়ে লেখা আদায় করার জন্য লেখকদের মাথার চুল ছিঁড়ে নিতে এঁরা পিছপা হন না। দুই, আহূত বা অনাহূত কোনও লেখাই এঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করেন না। তিন, বাজে লেখা ভাল বলে চালাতে এবং ভাল লেখা খারাপ বলে দাগিয়ে দিতে এঁরা ওস্তাদ এবং এই ওস্তাদির নামই সম্পাদনা। চার, আদতে এঁদের কোনও কাজই নেই। অধস্তন সাব- এডিটরদের দিয়ে এঁরা কাজ করিয়ে নেন এবং নিজের নামে তা বাজারে চালিয়ে দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন, খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন।

এগুলোই শুধু নয়, একদল লোক আছেন যাঁরা বলে বেড়ান, সম্পাদকরা নানা উপায়ে ঘুষ নেন। সম্পাদক মানেই পণ্ডিতমূর্খ। পদ থেকে চলে যাওয়ার পর এঁদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।
এই সব ঝাঁঝালো কটূক্তির সপক্ষে-বিপক্ষে কিছু না বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। তার চেয়ে বরং সম্পাদকেরা কী ভাবে হালে পানি পেয়ে, অথবা হালে পানি না-পেয়ে প্রাণান্তকর লগি ঠেলেন, কোন প্রক্রিয়ায় শরশয্যায় শুয়ে থাকেন দিনের পর দিন এসব নিয়ে একটু-আধটু অভিজ্ঞতা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। সম্পাদকের কাছে সবচেয়ে প্রার্থিত বস্তুটির নাম লেখক-লেখিকাদের পাণ্ডুলিপি। এই পাণ্ডুলিপির মধ্যেই সম্পাদকের সার্থকতা-ব্যর্থতার মন্ত্র নিহিত। ‘তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে’-র মতো পাণ্ডুলিপির পাতা চিবিয়ে খেয়ে (আক্ষরিক অর্থে ধরবেন না), তারই ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন সম্পাদক এমন দৃশ্য বিরল নয়। পাণ্ডুলিপি বলতে এখনও বোঝায় নানা রকমের, নানা মাপের কাগজে স্রষ্টার হস্তাক্ষরে রচিত সৃষ্টি। ডাকযোগে, হাতযোগে, ক্যুরিয়রে আসা নানা রকমের ও সাইজের কাগজে লেখা ম্যানাস্ক্রিপ্ট। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। কাটাকুটি, পরিবর্তন-সহ এপাশে-ওপাশে, ওপরে-নীচে সংযোজনের বেলুন উড়ছে এমন পাণ্ডুলিপি সম্পাদকের টেবিলে বিস্তর জমা পড়ে। ছড়ানো-ছেটানো অযত্নে ভরা পাণ্ডুলিপি যেমন আসে, তেমনই সুন্দর হাতের লেখার আপ্রাণ উপস্থাপনা। বিষয় যেমনই হোক, হাতের অক্ষরগুলো মুগ্ধ করে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। কোনও এক প্রদর্শনীতে প্রকাশক এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স-এর সৌজন্যে রাজশেখর বসুর পাণ্ডুলিপি দেখেছিলাম। মুক্তাক্ষর। এক একটি পৃষ্ঠা যেন ছাপানো পাতা! আমাদের কালে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডুলিপি এমন চোখ-চমকানো। হালকা ধূসর রঙে রুলটানা, মাঝারি মাপের কাগজে লেখেন তিনি। কালো কালিতে, ঝরনা কলমে লেখা প্রতিটি অক্ষর স্পষ্ট।
সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে পুজোর লেখা (গোয়েন্দা ফেলুদার রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজ) নিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল বেশ কয়েক বার। সাদা ফুলস্কেপ কাগজে লিখতেন। টানা হাতের লেখা। লাইনের ওপরে-নীচে যথেষ্ট ফাঁকা। অক্ষর মোটেই খুদে খুদে নয়, বরং বেশ বড়। ফাউন্টেন পেন ছাড়া কখনও ডট পেন ব্যবহার করেননি। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুর বর্ণটি (ড্রপ লেটার) লিখতেন অন্য কালিতে। নীল, বেগুনি, সবুজ, খয়েরি। প্রত্যেকটি আলাদা। কাটাকুটি প্রায় থাকতই না। ফাঁকে ফাঁকে পরিমার্জনা করতেন লাল কালিতে। পঁচাত্তর থেকে আশি পাতার পাণ্ডুলিপি। বিশপ লেফ্রয় রোড থেকে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট পর্যন্ত আসতে আসতেই পড়া হয়ে যেত।
বিমল কর ও রমাপদ চৌধুরী লিখতে পছন্দ করেছেন ল্যাব কপি বা প্র্যাকটিক্যাল খাতার কাগজে। যে-কাগজের বৈশিষ্ট্য এক দিক সাদা, অপর দিকে রুল। বেশ শক্ত-সমর্থ কাগজ। ওঁদের দু’জনের হাতের লেখাতেই থাকত প্রাজ্ঞ লেখকের স্পর্শ। সন্তোষকুমার ঘোষ লিখতেন নিউজ প্রিন্ট দিয়ে তৈরি প্যাডে। খুব কমদামি, বাজে কাগজ বলেই হয়তো সন্তোষবাবু আতর বা সেন্ট মাখিয়ে দিতেন পাণ্ডুলিপির গায়ে। তবে লোকে বলত, আসলে এটা মহিলা কম্পোজটিরদের (ওই সময়ে আনন্দবাজার সংস্থায় যাঁরা কাজ করতেন) প্রতি তাঁর সুগন্ধ-উপহার! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পাণ্ডুলিপিতে ধরা থাকত ওঁর বিপুল গদ্য রচনার ছুটন্ত ইতিহাস। দ্রুত লেখা ঠিকই, কিন্তু ভীষণ পরিষ্কার। সাদা পাতায় লিখতেন অথবা বন্ড পেপারে তৈরি নিজের লেটারহেডে। এখনকার এ-ফোর কাগজের প্রায় সমান সমান কাগজ। সুনীলদা ব্যবহার করতেন সামান্য দামের ডট পেন।
হাতের লেখা বুঝতে কখনও অসুবিধে হয়নি। সমরেশ বসুর হাতের লেখা ছিল খুব ছোট ছোট। ডান দিকে হেলে থাকা সারিবদ্ধ অক্ষরগুলোকে দেখে মনে হত ধান বিছিয়ে রেখেছেন। কালো কালিতে লিখতেন, কখনও নীল কালিতেও। বেশ দামি কাগজে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হস্তাক্ষরও যেন ওই ধান-ছড়ানো শিল্পিত বিন্যাস! অক্ষরগুলো এক এক জায়গায় এত ক্ষীণতনু যে, বুঝতে সময় লাগে বিশেষত সেই শব্দগুলো, যারা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের নিজস্ব সম্পদ। সমরেশ মজুমদারের পাণ্ডুলিপি দেখলেই বোঝা যায়, ঝড়ের বেগে লিখেছেন। লেখার মগ্নতায় পাণ্ডুলিপির সৌকর্যসাধন গৌণ হয়ে গেছে। একটানা লিখে যাচ্ছেন, কিন্তু পড়তে ব্যাঘাত ঘটছে না। বাণী বসু কিংবা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের পাণ্ডুলিপিতে আলাদা কোনও মেয়েলি ছোঁয়া নেই। তবে অদৃশ্য প্রসাধনের স্পর্শে খুব মনোরম। কবিদের মধ্যে আলাদা করে শঙ্খ ঘোষ ও জয় গোস্বামীর কথা বলতে হয়। শঙ্খবাবুর পাণ্ডুলিপি পরিশীলতার পরাকাষ্ঠা। অন্য দিকে জয়ের লেখায় পরিমার্জনার স্তর থেকে স্তরান্তর। বিস্তর কাটাকুটি, যত ক্ষণ না মনের মতো শব্দটি ধরা দিয়েছে, তত ক্ষণ কবি তার অন্বেষণে অক্লান্ত।
এখনকার দিনে যাঁরা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন নিজেদের রচনার গুণে, তাঁদের মধ্যে প্রায় সকলেই জমা দিচ্ছেন ডিটিপি বা কম্পিউটার প্রিন্ট। সেখানে হাতের লেখা বলতে লেখক বা লেখিকার সইটুকু। প্রিন্টকপিও পাণ্ডুলিপি ঠিকই, তবে এখানে হস্তলিপির বিচিত্র মাধুর্য অনুপস্থিত। পাণ্ডুলিপির সূত্রে সেই অগুন্তি অনামা অজানা রচয়িতাদের কথা বলতে হবে, যাঁরা তাঁদের হাতে-লেখা চিত্র-বিচিত্র পাণ্ডুলিপি নিয়মিত পাঠিয়ে দেন সম্পাদকের দপ্তরে।
সেই সব ম্যানাস্ক্রিপ্টের সঙ্গে প্রায়ই থাকে একটি নান্দীমুখ-পত্র (ফরোয়ার্ডিং লেটার)। এই চিঠিগুলির ভাষায় কখনও মিশে থাকে আর্তি বা প্রার্থনা, কখনও বা ক্রোধ ও ব্যঙ্গ, কখনও আবার অভিযোগের পর অভিযোগ। এমনকী হুমকি! যেমন এক কবিযশঃপ্রার্থী দু’টি কবিতা পাঠিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘এর একটাও যদি ছাপা না হয় তাহলে আমার মৃত্যুর জন্য আমার সুইসাইডের জন্য আপনারা (‘দেশ’ কর্তৃপক্ষ) দায়ি থাকবেন’’। এসব চিঠিতে থাকে লেখকের জীবনপঞ্জি, পাসপোর্ট সাইজের ছবি। কখনও-সখনও আসে জেমস ক্লিপ দিয়ে গাঁথা কারেন্সি নোট কিংবা চেক যা সম্পাদককে অস্বস্তিতে ফেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট! পত্রপাঠ সেই পাণ্ডুলিপি টাকাপয়সা-চেক সমেত ফেরত দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।
‘দেশ’ পত্রিকার দফতরে একবার একগাড়ি (আক্ষরিক অর্থেই) পাণ্ডুলিপি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এক তেলকলের মালিক। স্থূলদেহী, কালো কুচকুচে, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোকটির নাম ভুলে গেছি, পদবি মনে আছে সাধুখাঁ। সাগরবাবুর সঙ্গে দেখা করে তিনি বলেছিলেন, আপনার অফিসের সামনে গাড়ি রাখা আছে। গাড়িতে আছে আমার সমস্ত লেখা কবিতা, ছোট গল্প, বড় গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা, নাটক, এমনকী একটা ছোটখাটো মহাকাব্যও আছে। কোন কোনটা চাই বলুন। এখুনি এনে দেব।
এমন অপ্রত্যাশিত রচনা-খনি হাতে পেয়ে সাগরময় ঘোষ এতটুকু ঘাবড়ে যাননি বা ভিরমি খাননি। মৃদু হেসে সেই সব্যসাচী লেখককে বলেছিলেন, বাহ্, আপনি তো সাহিত্যের সমস্ত ময়দানেই বিচরণ করছেন! খুব ভাল। তবে এখনই আপনার এই মূল্যবান সৃষ্টি নিতে পারছি না। আপনি আপনার ঠিকানা-ফোন নম্বর দিয়ে যান। যখনই দরকার পড়বে আমি নিজে চেয়ে নেব।
ভদ্রলোক সত্যি সত্যি আশ্বস্ত হয়েছিলেন কি না জানি না। তবে তাঁর পাণ্ডুলিপি-পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ে সেদিন দফতরের কেউই হতাহত হয়নি।
পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়ার আগে সম্পাদককে অনেক সময়ই একটি কাজ সেরে নিতে হয়। কাজটি হল, লেখা চাওয়া। লেখা চাওয়া আবার দু’ধরনের প্রথমত, অমুক বিষয়ের ওপর গল্প কী প্রবন্ধ কী কবিতা! এই ধরনের লেখা (কমিশনড্) সাধারণত পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য কিংবা স্বাদ বদলের জন্য দরকার হয়। দ্বিতীয়ত, পূর্বনির্দিষ্ট কোনও বিষয় ছাড়া লেখা। এই দ্বিতীয় ধরনটি উন্মুক্ত। কোনও বিষয় অর্পিত না-হওয়ার ফলে এই জাতীয় রচনায় স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বেশি থাকে এবং এরাই সাময়িকপত্রের গৌরব ও প্রচার বৃদ্ধি করে। প্রতিষ্ঠিত লেখক-লেখিকারা এই দু’ধরনের লেখা দিতেই অভ্যস্ত। তবে বিষয় নিয়ে তাঁদের আপত্তি বা নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতনতাও দেখেছি। যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনও হাসির গল্প লেখায় স্বচ্ছন্দবোধ করেননি।

সন্তোষকুমার ঘোষ

সাগরময় ঘোষ

রমাপদ চৌধুরী
সাময়িকপত্রকে সচল রাখে কিন্তু বিভিন্ন প্রান্ত, দূরদূরান্ত থেকে আসা অনামী স্রষ্টাদের অগুন্তি রচনা যেগুলি সম্পাদক চেয়ে নেননি, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সতত যেসব লেখা দফতরে জমা পড়ে। এই সব লেখা থেকেই সম্পাদক বেছে তুলে নেন তাঁর পত্রিকার উপযোগী রচনাটি। ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই/ পাইলে পাইতে পার অমূল্যরতন’ অনেকটা এই প্রক্রিয়ায় পত্রিকার পাতা ভরাট হয়, অপর দিকে অপরিচিত লেখকও ধীরে ধীরে কিংবা রাতারাতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
স্বেচ্ছায় পাঠানো লেখার রচনার মধ্যে যে-ব্যাপ্তি থাকে, চেয়ে নেওয়া বিষয়ভিত্তিক লেখায় অনেক সময় তা থাকে না। তখন সমস্যায় পড়েন সম্পাদক। প্রায় ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা হয়। বিষয়ের বিচ্যুতি কিংবা যা চাওয়া হয়েছে তার ধার দিয়েও হাঁটেননি রচয়িতা। হয়তো লিখতে বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীবনে কবি প্রিয়ম্বদা দেবীর নীরব উপস্থিতি এবং এর উল্টো দিকটি। লেখক লিখে দিলেন প্রিয়ম্বদা ও ওকাকুরার প্রেম এবং প্রেমপত্র নিয়ে। রচনাটি পাঠযোগ্য, কিন্তু সম্পাদকের পরিকল্পনা তাতে সফল হল না। এই অবস্থায় সম্পাদক পড়ে যান গভীর গাড্ডায়। চেয়ে নেওয়া লেখা ছাপতে না পারার অস্বস্তিতে বেড়ে যায় সম্পাদকের রক্তচাপ।
লেখা বাতিল করে দিলে নামী লেখক ক্ষুব্ধ হবেন, অপমানিত বোধ করবেন। সেই পত্রিকার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ হওয়াও বিচিত্র নয়। এই শাঁখের করাত সিচুয়েশন থেকে যেসব সম্পাদক সুকৌশলে নিজেকে বের করে আনতে পেরেছেন বা পারেন, তাঁরা অবশ্যই নমস্য। তবে সেই কৌশলটা যে কী, তা বলা মুশকিল! আরও এক গুরু দায়িত্ব সম্পাদককে পালন করতে হয়। সম্ভবত এই দায়িত্বটাই (এবং দায়) সম্পাদকের জীবনে সবচেয়ে কঠিন কাজ লেখা বাতিল করা। বাতিল হয় সেই সব রচনা, যেগুলি অপাঠ্য, ছাপার অযোগ্য, পাঠকের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ অর্থাৎ সব দিক থেকেই নট আপ টু দি মার্ক। বিস্তর রচনা পড়তে পড়তে সম্পাদক নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তবু সেই শ্রান্তির ভেতর থেকে তাঁকে বেছে নিতে হয় পাঠযোগ্য, মনে রাখার মতো, ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার নয় এমন রচনা। পাঠকের মস্তিষ্ক ও হৃদয় দরজা খুলে যে-লেখাটিকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে। জন্ম হবে এক সম্ভাবনাময়, প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন লেখক কিংবা লেখিকার। যোগ্য লেখাটি খুঁজে নেওয়ার এই কৃতিত্ব সম্পাদককে নিশ্চয়ই আত্মতৃপ্তি এনে দেয়। আবার কোনও প্রতিষ্ঠিত লেখকের ততোধিক খারাপ লেখা বাতিল করার কাজটি করতে হলে সেই তৃপ্তি যে উবে যায়, এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই।
সময়মতো এবং প্রত্যাশিত আয়তন অনুযায়ী লেখা না পাওয়ার বিড়ম্বনা সম্পাদকের নিত্যসঙ্গী। বলতে গেলে, ডেট-লাইন আর ডেড-লাইন এখানে একাত্ম হয়ে আছে। ম্যাগাজনের প্রচ্ছদে মুদ্রিত প্রকাশের তারিখটিই শেষ সময়সীমা। এই নির্দিষ্ট সীমানা পার হয়ে যাওয়া মানে সম্পাদকের কার্যক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন পড়ে যাওয়া! ঘোষিত বা নির্ধারিত তারিখে পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত না হলে পাঠকরা ভীষণ অসহিষ্ণু ও অসন্তুষ্ট হয়েছেন এমন উদাহরণ কম নেই। তারিখ মিস করলেই পত্রিকার শিরোনামে পড়বে কলঙ্কের কালিমা। চোখের সামনে তখন দৃশ্যমান হবে প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকার বক দেখানো হাত সেই মুখ থুবড়ে পড়লি তো! আরে বাবা, এ ম্যাগাজিন তো আর রাইফেলের ম্যাগাজিন নয় যে, তৈরি টোটা পুরবি আর ফটাস করে ছুড়বি! পত্রিকা বের করতে গেলে কসরত করতে হয়।
এসব বক্রোক্তি সম্পাদকের গায়ে জ্বালা ধরায়, সম্পাদক আহতও হন। কিন্তু তাঁর পিছিয়ে আসার জায়গা নেই। লেখা মনোনয়নের কাজের মতো আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদককে নিষ্ঠার সঙ্গে করে যেতে হয় তা হল সম্পাদনা। নানা ভাবে লেখার উৎকর্ষ সাধনই সম্পাদনার লক্ষ্য। কোনও রচনাই ইলাস্টিক নয় যে, তাকে টানলে বড় হয়ে যাবে, বা ছেড়ে দিলে গুটিয়ে ছোট আকার নেবে।
অনেক সময়ই সীমিত পৃষ্ঠাসংখ্যার কথা মনে রেখে বা বরাদ্দ জায়গা অনুযায়ী কোনও রচনা খানিক কেটে-ছেঁটে ফেলা অনিবার্য হয়ে ওঠে! তবে সেই অঙ্গচ্ছেদ ঘ্যাচাং করে মাথা নামিয়ে দেওয়া কী ধড় শুইয়ে দেওয়া নয়। লেখকের স্বাতন্ত্র্য ও লেখার প্রসাদগুণ বজায় রেখে এই কাজটি সম্পন্ন করার পেছনে যে-শিল্প কুশলতা থাকা জরুরি, তা সম্পাদককে অর্জন করতে হয়। বঙ্গদর্শন-এ বঙ্কিমচন্দ্র এবং নানা সাময়িকপত্রের সম্পাদক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ, সম্পাদনার কাজ যে-দক্ষতায় করে গেছেন, তা প্রবাদ হয়ে আছে।
লেখার অঙ্গহানি অনেক সময়ই মেনে নিতে পারেন না প্রতিষ্ঠিত লেখকরা। হয়তো মুদ্রণের প্রয়োজনে একটা লাইন বা কয়েকটা লাইন বাদ দিতে হয়েছে। জনপ্রিয় লেখকের গলা খাদে নেমে এল, ‘এ সব কী হচ্ছে! সবচেয়ে ভাল, ইম্পর্টান্ট, জোরালো, কমিউনিকেটিভ জায়গাটাই ফেলে দেওয়া হল! এর পর আর লেখাটার থাকলটা কী!’ এই ভয়ঙ্কর স্পর্শকাতরতার মুখোমুখি হয়ে সম্পাদক তখন মনে মনে হয়তো ভাবেন, তবে কি আমি একটা আকাট সাহিত্যবোধহীন জড়পদার্থ! মনে পড়ছে, একবার একটি পুজো সংখ্যায় দয়া করে সব শেষে লেখা দিয়ে তখনকার এক নামী সাহিত্যিক একেবারে গাড্ডায় পড়ে গেলেন। পত্রিকাটির শেষ পাতা অতিক্রম করে তাঁর উপন্যাসের অনেকটা অংশ বাইরে পড়ে আছে। অন্তত আরও ষোলো পেজি ফর্মা বাড়ানো ছাড়া তা ধরানো অসম্ভব। এ দিকে ফর্মা বাড়ানোর কোনও রাস্তা সামনে খোলা নেই। বাণিজ্যিক ও কারিগরি কারণগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সম্পাদক লেখককে উপন্যাসের কিছু ডালপালা ছেঁটে দেওয়ার অনুরোধ করলেন।
প্রস্তাবটি পেয়েই লেখক রেগে আগুন! ‘নিজের লেখা নিজে কাটুন’ প্রস্তাবটি তাঁর কাছে অপমানজনক মনে হল। অগত্যা সম্পাদক ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে (সম্ভবত প্রাণের ঝুঁকিও ছিল!) উপন্যাসটির অঙ্গচ্ছেদ (অবশ্যই শিল্পসম্মতভাবে) করতে বাধ্য হলেন। নির্ধারিত পাতায় লেখাটি ধরানো গেল।
পাঠকরা পড়ে বুঝতেই পারলেন না। এও জানলেন না যে, সম্পাদনার জন্য সম্পাদক কলমের বদলে বড় ধরনের কাঁচি ব্যবহার করেছেন। লেখক আগে থেকে জ্বলছিলেন, এবার হুতাশনে পরিণত হলেন। সেই আগুনের তাপ দূরদূরান্তে ছড়িয়েও গেল। নিন্দিত সম্পাদক ‘যা করেছি কাগজের জন্যে করেছি, ভুল কিছু করিনি’ গোছের ভঙ্গি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। মজার ঘটনাটি ঘটল তার পরের বছর। ক্ষুব্ধ লেখককে চমকে দিয়ে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হল সেই সম্পাদিত (কর্তিত!) উপন্যাসটি। এক এক সময় মনে হয়, সেদিন লেখকের পাশাপাশি সম্পাদকও পুরষ্কৃত হয়েছিলেন।
আবার বাণিজ্যের হিসেব-নিকেশ সরিয়ে রেখে ফর্মা বাড়ানোর দৃষ্টান্তও আছে। অসম্ভব ভাল লেখা প্রকাশ করার গৌরব যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায়, সে জন্যে পাতা বেড়েছে। আর্থিক লাভালাভের অঙ্ককে পত্রিকা তখন প্রাধান্য দেয়নি।
পত্রিকা-দফতরে লেখা আসে নানা মাধ্যমে। সে কথা আগেই বলেছি। এখন ই-মেলে লেখা পাঠানো ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এসবের বাইরে অনেকেই স্বয়ং পত্রিকা দফতরে এসে লেখা পৌঁছে দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তাঁদের ধারণা অন্য মাধ্যমে পাঠালে, সে লেখা সম্পাদক এবং তাঁর সহকারীদের নজরে আসে না। বাজে কাগজের ঝুড়িতে সেগুলো ফেলে দেওয়া হয়। শুধু দফতরে এসেই কেউ কেউ ক্ষান্ত হন না। সম্পাদকের হাতে রচনাটি তুলে দিতে না পারলে তাঁরা অশান্তিতে ভোগেন। যেন সরাসরি সম্পাদকের হাতে দেওয়া মানে লেখার সদ্গতি নিয়ে আর চিন্তা রইল না! এঁরা সম্পাদকের টেবিলের সামনে সশরীর আবির্ভাবকে খুব গুরুত্ব দেন। অথচ এঁদের বোঝানো যায় না, সাক্ষাৎকারের কোনও প্রয়োজন নেই। আপনার লেখাটাই কথা বলবে। সব কথা প্রাণের কথা, মনের কথা!
দীর্ঘদিন রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন রমাপদ চৌধুরী, কাজের ফাঁকে যখন চুপ করে চেয়ারে বসে থাকতেন তখনও ওঁর শ্যামলবরণ পুরুষালি মুখে লগ্ন হয়ে থাকত এক নির্মোহ কাঠিন্য। তবে তা খুব গাঢ় নয়, অনেকটা পাতলা কুয়াশার মতো। কিন্তু চোখে পড়বেই। একদিন ওঁর সামনে এসে সটান দাঁড়িয়ে, শান্তিনিকেতনী ঝোলা থেকে একটি পাণ্ডুলিপি বের করে এক ভদ্রলোক বললেন, আপনার কাছে জমা দেওয়ার জন্যে ল্যাখা এনেছি।
রমাপদবাবু সামান্য চোখ ফেরালেন, আগন্তুককে তেমনই মোহহীন মুখে এক পলক দেখলেন। তারপর ধীর গম্ভীর স্বরে বললেন, বেশ করেছেন। কিন্তু আমরা তো ল্যাখা জমা নিই না, লেখা জমা রাখি।
এক এক সময় মনে হয়, সম্পাদনার শরশয্যায় শুয়ে সম্পাদককে কেবলই বুঝে নিতে হয় কোনটা লেখা, কোনটা ল্যাখা। তাঁর ওই একটাই কাজ।

অলংকরণ: শেখর রায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.