|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
এত সুর আর এত কষ্ট |
কণ্ঠ থেকে গান কেড়ে নিলে আর রইলটা কী! জীবন সায়াহ্নে
দাঁড়ানো সুবীর সেন। যন্ত্রণা উজাড় করে দিলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য-র কাছে। |
আগের বাঙালি, এখনকার বাঙালি বলে কথা নয়। যে কোনও বাঙালিকেই সেরা পাঁচ আধুনিক বাংলা গানের নাম করতে হলে তার মধ্যে আসবেই আসবে সুবীর সেনের ‘এত সুর আর এত গান’।
কোথাও গানটা বেজে উঠলে সময়টা থমকে যায় কেন, পৃথিবীটা উল্টে যায় কেন, কোনও হদিশ নেই।
একটা হদিশ অবশ্য আছেগলা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া এমন একটা ভগবানের তৈরি সুরেলা, সাহেবি আওয়াজ তো আর হয়নি এ দেশে, সুর লাগালেই পাড়ার রোয়াকও রয়্যাল অ্যালবার্ট হল।
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। |
যে-অনতিমন্দ্র পুরুষকণ্ঠকে সাহেবরা বলছেন ব্যারিটোন, সেই ব্যারিটোনের স্নিগ্ধ গাম্ভীর্য ও লাবণ্যে এঁরা মানুষকে সমানে মাত করছেন। শুধু আওয়াজে, চটুল করে বললে, naked voice-এ।
হেমন্ত ও সুবীরের রিমেকে বাজার ছেয়ে আছে, বেজায় বাণিজ্য তাদেরও, কিন্তু মন দূরস্থান, কানেই ধরে না। তার আরেক কারণ, বাণী বলা।
গানের কথা বলার মধ্যে যে একটা কবিতাভাব আছে, গান ধরা ও তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে একটা মরমি সংলাপ উচ্চারণ আছে, যেন প্রিয়া সাক্ষাৎ সামনেএই দেয়া-নেয়ার জন্য একটা খুব সূক্ষ্ম, শিক্ষিত, আভিজাত্য আছে। যা ঘষে-মেজে, রেওয়াজ করে আসে না। ‘হয়তো তোমার অনেক ক্ষতি করেছি, কাছে এসে, ভালবেসে’ এ কথা সুবীর ছাড়া এ ভাবে আর কে বলেছেন? বলবেন? এই বলার কোনও রিমেক হয় না।
হেমন্তের মতো সুবীরকেও পাঁচটি অপরূপ দান দিয়েছিলেন ভগবান যা বেশ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে, মাইরিমন, গলা, চেহারা, বম্বে ও সলিল চৌধুরী। সঙ্গে কপাল। না হলে ১৯৫৬-য় প্রথম যে-রেকর্ড করলেন জলসায় জলসায় হেমন্তের গান গেয়ে ভিড় বাড়ানো সুবীর, সে গানই সুপারহিট। সে-গান ‘ঐ উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’, সেই গীতিকার-সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত। তার পর আর ডিব্রুগড়ের ছেলেকে বাংলায় বেঁধে রাখে কে!
বম্বে জয় করতে চব্বিশ বছরের নওজোয়ানের দরকার হয়েছিল কেবল একটি ছবি, একটি গান। ছবি ‘কাঠপুতলি’, গান, ‘মঞ্জিল ওহি হ্যায় প্যার কি, রাহি বদল গয়ে’। আর সুরকার? বম্বের এক নম্বর সুরকার জুটি শঙ্কর-জয়কিষেন। বম্বেতে প্রথম গানে হিট দিয়ে সুবীর সে বার একটা দীর্ঘস্থায়ী রেকর্ড ভেঙে ফেললেন। তালাত মাহমুদের। যিনি দু’নম্বর গানে হিট দিতে পেরেছিলেন। হেমন্তকুমারের প্রথম হিট ৩ নম্বর গানে, ‘জাল’ ছবির ‘ইয়ে রাত, ইয়ে চাঁদনি, ফির কহাঁ’।
কিন্তু সুবীর ওঁর প্রথম হিট নিয়ে বলতে গেলে অন্য এক তৃপ্তিবোধে জড়িয়ে পড়েন। সে-তৃপ্তির কারণ, হিন্দি ছবির জীবন্ত কিংবদন্তি বলরাজ সাহনির ঠোঁটে ধরা ছিল গানটি। এর কিছু দিন পরই, কপাল এমন, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে যেতে হল বলরাজকে শেষ দেখা দেখতে। তবে হাত ছাড়েননি শঙ্কর-জয়কিষেন, পরপর আরও তিনটে ছবিতে গলা নিলেন সুবীরের।
লতার সঙ্গে দুর্ধর্ষ ডুয়েট বাঁধল ‘ম্যয় রঙ্গিলা প্যার কা রাহি’ গানে, আর সে-সময়ের জুবিলি হিরো রাজেন্দ্রকুমারের লিপে চড়ল দুনিয়া দোলানো ‘দিল মেরা এক আস কা পঞ্ছি, উড়তি হ্যায় উঁচি গগন পর’। |
|
লতার সঙ্গে ‘ম্যায় রঙ্গিলা পেয়ার কা রহি’ গাইছেন। পরিচালনায় শঙ্কর-জয়কিষেন-এর শঙ্কর। |
বম্বেতে যখন গানের কন্ট্রাক্টই হয়েছে, গান ওঠেনি পর্দায়, সুবীর তখন সে-শহরে সময় কাটাচ্ছেন ইন্ডাস্ট্রির আরেক চুক্তিবদ্ধ মিউজিশিয়ান সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে। টাকা আসছে, অথচ কাজ নেই, এ অবস্থায় সুধীনবাবু একটু হাঁপিয়েই উঠেছিলেন। উনি ফাঁকা সময়ে সুবীরের জন্য একটা গান লিখলেন শারদ অর্ঘ্য হিসেবে পেশ করবেন বলে। আর তাতে জুড়লেন এমন সুর যাতে একটা বিলাতি বিষাদগীতির এলানো ছন্দ, সুবীর তা গাইলেনও যেন তৃতীয় বাংলা গান নয়, জীবনের শেষ গান গাইছেন। যে-গান বাঙালির কোনও দিনও শোনা শেষ হবে না, যে-গানকে বলা হয় বাংলা আধুনিকের এক সিগনেচার সং বা স্বাক্ষরগীতি। কেউ কেউ আরেকটু ঝুঁকি (খুব বেশি নয়) নিয়ে বর্ণনা করেন অমরগীতি বলে। গানটা, আদৌ উল্লেখের প্রয়োজন?‘এত সুর আর এত গান’।
এই গানের, এবং আরও অন্তত একশো গানের অমর (বলব নাই বা কেন?) গায়ক সুবীর সেন ৮০ বছর পার করলেন গত বছর ২৪ জুলাই। ওই দিন উত্তমকুমারের প্রয়াণদিবস, ন্যায্যত অনেক স্মরণসভা হয়েছিল, ছবিতে ছবিতে, গানে গানে, শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সেই উত্তমকুমারই যাঁকে ডেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে হিরো করেছিলেন নিজের সঙ্গে ‘মোমের আলো’ ছবিতে, তাঁর জন্মদিনটা খেয়াল রাখিনি আমরা। রাখলে জানতে পারতাম সেই উজ্জ্বল, নায়কোচিত, রোম্যান্টিক সুবীর সেন আজ এক মহানিস্তব্ধতায় আত্মসমর্পণ করেছেন। সারা শরীরে নানা রোগপ্রস্টেটের সমস্যা, হার্নিয়া, শ্বাসে টান, স্নায়ুতে চাপ, চোখে ছানি, শোনায় অসুবিধেগলায় সাত সুর আস কা পঞ্ছির মতো আর উড়ে এসে বসছে না। কয়েক বার ব্ল্যাকআউট হয়েছে বিগত ক’মাসে। পড়ে একবার পাঁজর ভেঙেছেন। চার জন ডাক্তারের পাহারায় আছেন। অখণ্ড অবসর কাটান নিজের পুরনো গান শুনে কখনও সখনও, তবে মূলত একজীবন স্মৃতি আর একবুক প্রেম আগলে। আশি পার করেও সুবীর, কী করে জানি না, মনে মনে সেই ‘মোমের আলো’র শান্তনু, যাকে কিছুতেই ভুলতে পারে না নায়িকা। আর মনোবিদ উত্তম সমানে তাকে প্রশ্ন করে যান, ‘শান্তনু কে?’
সুবীর সেনের মনের যৌবনই আশি পার-করা অসুস্থ শিল্পীকে এখনও টেনে যাচ্ছে। বললেন, ‘‘জানি না, যে-কোনও দিনই হসপিটালাইজড হতে পারি। ভাঙা দাঁত তুলতে পারছি না, কারণ অ্যান্টিবায়োটিকে অ্যালার্জি ধরা পড়েছে। এ সব মেনে নিচ্ছি, কিন্তু গানটা যে গাইতে পারছি না সেটাই বেদনার।’’ বলেই ওঁর ওই অসম্ভব নিষ্পাপ হাসিটা হাসলেন সুবীর, যাতে কোনও জীবনের অভাব দেখা যায় না। আর এই ভগ্নশরীরেও ওঁর ওই অপূর্ব আওয়াজে গেয়ে দিতে চেষ্টা করলেন ওঁর সেই চোখে জল-আনা ‘সারাদিন তোমায় ভেবে হল না আমার কোনও কাজ/ হল না তোমাকে পাওয়া দিন যে বৃথাই গেল আজ’। |
‘সারাদিন তোমায় ভেবে’-কে (১৯৬৭) বাঙালি যুবক-যুবতীরা ঠোঁটের গান ভাবত না, ভাবত মনের গান। যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে, নকশাল আন্দোলন শুরু হয়-হয়। ঠিক তখন প্রেমের, রোম্যান্সের, কষ্টের এই গানের বন্যা কী ভাবে চালু করলেন কে জানে সুবীর, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জোড় বেঁধে।
ন’টা বছর বম্বেতে কাটিয়ে তদ্দিনে কলকাতায় ফিরে এসেছেন শিল্পী। আর এসেই গৌরীপ্রসন্নর কথায়, অভিজিৎবাবুর সুরে গাইলেন ‘নয় থাকলে আরো কিছু ক্ষণ’ (১৯৬৬) কিংবা অভিজিৎবাবুরই কথা ও সুরে ‘হয়তো তোমার অনেক ক্ষতি করেছি’ (১৯৬৮)।
ধীর মেজাজে, অতিনাটকীয়তা পরিহার করে গাওয়া চাপা দুঃখের এই সব গান যে বাজারে এসে এক অনুরাগী সমাজ, ফ্যানশিপ গড়ে তুলছিল সেটা নজর না করার কোনও উপায় থাকছিল না।
|
দেবব্রত বিশ্বাস |
তত দিনে যুবসমাজে বব ডিলান, বিটলজ ও রোলিং স্টোনজ এসে গেছে, কিন্তু প্রেমিক বাঙালি, যুবক-যুবতী তখনও বুকে আঁকড়ে রেখেছে ন্যাট কিং কোল, জিম রিভজ, ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রাকে, যাঁদের মুহুর্মুহু মনে পড়িয়ে দিচ্ছেন সুবীর সেন। ন্যাট কিং কোল-এর ‘মোনালিসা’ গানটাকে তো বাংলায় চালাই হল সুবীরের গলার জন্য‘মোনালিসা, তুমি কে বলো না’ (১৯৬৭)। কিংবা ধরা যাক ‘এ যেন সেই চোখ’ (১৯৬৮)। অতীব জনপ্রিয় রেডিয়ো প্রোগ্রাম বিকে’র ‘মিউজিকাল ব্যান্ড বক্সে’ মজা ছেলেমেয়েরা সুবীরের মধ্যে একটা বিলাত-বাঙালি মিলন দেখেছে সারা ক্ষণ।
তাঁদের খুব কম জনেরই তখন খবর আছে যে এই বোম্বাই দাপানো, সাহেবসুবো সুবীর আদতে প্রত্যন্ত ডিব্রুগড়ের ছেলে, পণ্ডিত রতনজনকারের সামনে খেয়াল গেয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কলকাতায় এসে গান শিখতে গিয়েছিলেন অনুপম ঘটকের কাছে, যিনি ওঁর গলা শুনে বলেছিলেন, “তুমি ওই ব্যারিটোন ভয়েসেই প্র্যাকটিস করো।” কিন্তু নিয়মিত শেখানোর আগেই প্রয়াত হন অনুপমবাবু।
তবে আরেকটা উপদেশও দিয়ে গিয়েছিলেন, “যখন আধুনিক বাংলা গান গাইবি তখন যদি ক্ল্যাসিকালের ওই সব গমকি তানটান করিস তো সব শেষ।” সেই থেকে গলা ও গান বাঁচানোর রেওয়াজটা সুবীরের দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটির সময় মনে মনে পদ আবৃত্তি করে চলা। নিয়মিত গান প্র্যাকটিসের কোনও বালাই নেই।
সেদিক দিয়েও মস্ত মিল হেমন্ত ও সুবীরে। গলা সাধা বলে কোনও জিনিসকে কোনও দিন পাত্তাই দেননি হেমন্ত। বাল্যবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন যে স্কুলের অফ পিরিয়ডে টেবিল চাপড়ে গান ধরত হেমন্ত, তাতে ওঁকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের হুমকিও শুনতে হয়েছিল। কাদের গান গাইতেন হেমন্ত? না, সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক, শচীনকর্তার। হয়তো তাতেই টের পেয়েছিল বন্ধুরা যে ওর গান হবে।
সুবীর কবে টের পেলেন যে ওঁর গান হবে? বলছেন, ‘সেটা একটা মজার ঘটনা। তখন স্কুলে পড়ি, আমাদের পাড়ায় দুর্গাপুজোর পর জলসা হত। একবার সবাই ধরল, সুবীর, তুই একটা গান গা। বললাম, আমি তো হারমোনিয়মই বাজাতে পারি না। আবার ভাবছি কী গান গাইব। তখন আমার ধারণা ছিল ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটা বোধহয় ভগবান-টগবান নিয়ে। সে সময় এতটাই মূর্খ ছিলাম। পুজোর সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল পেতাম, অথচ সেরকম কিছুই নেই। তা ‘গাঁয়ের বধূ’ অর্ধেকটা গেয়েছিলাম। সবাই দেখি আনন্দে ফেটে পড়ল কী অসাধারণ গলা রে তোর!
সেই শুরু। তার পর কাদের গান শুনে গানকে পেশা করার ভাবনা? বলছেন, “হেমন্তদা, তালাত মাহমুদ, ধনঞ্জয়দা’র গান খুব শুনতাম। মনে হত এঁরা এত সুন্দর গান করেন যে পাগল হয়ে যাই। আহা, যদি কখনও এঁদের মতো গাইতে পারি! তখন গান শিখছি। এই ডাইমেনশন, এই স্টাইল, এই কাব্যের গানএ সব গাইতে পারব কখনও ভাবিনি।
“অসম থেকে কলকাতায় এসে প্রথম উঠি মামাবাড়িতে। সেখানে খুব চল ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের। তা ছাড়া বাবার এক খুড়তুতো ভাই ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ নীহারবিন্দু সেন। মামাবাড়িতে থাকতে থাকতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া ধরলাম আর জলসায় জলসায় হেমন্তদা’র গান। আমি তখন হেমন্তকণ্ঠী। হেমন্তদা’র গান হিট করলেই আমার কদর বাড়ে কলকাতায়।”
এত শত তথ্য ’৬৭, ’৬৮, ’৬৯-এর যুবক-যুবতীদের কাছে ছিল না। তাদের পুলক ও বিস্ময় এটাই যে, এই আরেক হেমন্ত। যে এত সূক্ষ্ম ভদ্র সফিস্টেকেশনে প্রেমের কথা প্রেমিকের মতো বলে যেতে পারে। ফলে সুবীর সেন যে হিন্দি ফিল্ম ও বম্বে ছেড়ে চলে এসেছেন তাতে তাঁর কোনও অনুরাগী-অনুরাগিণীর কোনও মনোকষ্ট ছিল না। যেমন বাঙালির কোনও খেদ নেই হেমন্তের বম্বেত্যাগে। কিংবা একটু ভেবে দেখলে, গীতা দত্তের বম্বে থেকে অবসৃত হওয়ায়। কারণ তত দিনে এঁরা তিন জনই এঁদের সেরাটুকু বম্বেকে দিয়ে ফেলেছেন।
চলে আসার পরও বারকয়েক হিন্দিতে গান গাইতে গেছেন। ১৯৭২-এর রিলিজ বাসু ভট্টাচার্যের ‘অনুভব’ ছবিতে তো পর্দায় নায়ক সঞ্জীবকুমারের বাঙালি বন্ধু হিসাবে স্বশরীরে গাইতে হল রবিঠাকুরের গান ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’। আশ্চর্য সমাপতন এই যে, সেই ছবিতে গীতা দত্তও (সুবীরের প্রিয় গায়িকা প্রিয় মানুষ) গাইলেন ওঁর জীবনের শেষ এবং সর্বকালের এক সেরা হিন্দি গান ‘মুঝে জান কহো মেরি জান, মেরি জান’। এবং ছবি মুক্তির আগেই প্রয়াত হলেন। |
সুবীর সেনের একটা প্রেমিক ভাবমূর্তি যে কবে থেকে শুরু হল বলা মুশকিল। যখন বম্বে থেকে আসছেন, শহরের জলসায় গাইছেন, তারপর ফিরে গিয়ে শঙ্কর-জয়কিষেন, কল্যাণজি-আনন্দজি কী লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের ছবিতে গলা দিচ্ছেন তখনই ওঁর একটা প্লেবয় ইমেজ নিয়ে চর্চা শুরু হয়। লতা মঙ্গেশকরের পরিবারের সঙ্গে এক সময় ওঁর বেজায় ঘনিষ্ঠতার কথা শোনা যেত, পরে নাকি সে সম্পর্ক ঠান্ডা মেরে যায়।
সুবীরের প্রেমিক চেহারাটাই সম্ভবত উত্তম কুমারকেও টেনেছিল। শহরে এলেই ওঁর ড্রাইভার ন্যাপাকে দিয়ে সুবীরকে আনিয়ে নিতেন ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। বলতেন, ‘কী সুন্দর ফিগার, কী মিষ্টি হাসি’। একদিন বললেন, ‘তুমি অভিনয় করো’।
অভিনয়ের এই অফার সুবীরের কাছে প্রথম নয়। বম্বেতে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় তো ওঁকে ভেবে একটা চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সেই ’৫৮-’৫৯ সালে। কিন্তু মায়ের বেজায় আপত্তি বলে সুবীর রাজি হননি। বহু পরে, সত্তরের দশকের গোড়ায় হৃষীকেশবাবু তাঁর সুবীর নামের নায়ক নিয়ে ছবিটা করলেনও, তবে এক তরুণ, উঠতি নায়ককে নিয়ে। যাঁর নাম অমিতাভ বচ্চন। ছবির নাম ‘অভিমান’!
উত্তমবাবু অবশ্য ‘অভিনয় করো’ বলে থেমে থাকেননি, পরিচালক সলিল দত্ত-র কানেও তুলেছিলেন। ফলে একদিন সুবীর দেখলেন সলিল বাড়িতে হাজির। বলছেন, “আমার ‘মোমের আলো’ ছবিতে আপনি হিরো। উত্তমকুমার ডাক্তার।” সুবীর শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘সর্বনাশ! অভিনয়-টভিনয় জানি না। লোকে তো মারবে আমাকে’। বাকিটুকু ইতিহাস।
সুবীর সেন খুব প্রেমিক মানুষ হলেও নিজের প্রেমের গপ্পোটপ্পো শোনানোর ব্যাপারে কেবল রিজার্ভডই নন, ভয়ানক লাজুকও। ওঁর গান বেরোলে মেয়েরা পাগল হয় জানতেন, প্রচুর ফোন আসত মানেনও, কিন্তু কাকে কবে কী গান শুনিয়েছেন বলতে জিভ জড়িয়ে যায়।
যাঁর গান গেয়ে ছেলেমেয়েরা প্রেমে পড়ে, প্রেম করে, তিনি নিজের প্রেম জানাতে কী গান করেন? সুবীর শুধু চুপ করে হাসেন। কিন্তু যদি প্রিয় গানের কথা ওঠে তো সলিল চৌধুরীর কথা তুলবেন। বলবেন, ‘ধরণীর পথে পথে’ গানটার কথা বার বার। একটু ভেঙে ভেঙে গেয়ে দেবেন ‘পাগল হাওয়া’। কিংবা ‘কিছু দিন পরে আর চাইব না’ বা ‘আর কিছু স্মরণ নেই’।
তবে সুবীরের যে অজস্র গান বাঙালির প্রেমের ভাষা হয়েছে তারা মূলত সুধীন দাশগুপ্ত ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ। সুরে তো বটেই, প্রায়শ কথাতেও। সুবীরের জন্য এক বিশেষ ধরনের লিরিকও এঁরা বাঁধতেন। তাতে একটা সরল, মেধাবী, ওজনদার কণ্ঠযোগের জায়গা রাখতেন এবং যে সুরের আয়োজন করতেন, তা লাগসই বাংলা শব্দের অভাবে বলতে হয় এলিগ্যান্ট। সুবীরের সমস্ত বাংলা গানের এই এক তকমা এলিগ্যান্ট।
সুবীর সেনের বাংলা গানের সংখ্যা কত! অনুরাগীরা বলেন, দেড়শো তো বটেই। সুবীর মাথা নেড়ে বলেন, ‘কী জানি, একশোও হবে কি না জানি না’। জানবেন কী করে, নিজের রেকর্ড, ক্যাসেট, ক্লিপিংস কিছুই কি গুছিয়ে রাখতে পেরেছেন?
তা হলে ওঁর যে ডজন ডজন গান বাঙালির মনস্থ, কণ্ঠস্থ? কারণ, সরল সুবীরের প্রায় সব গান হিট। ভুলে যাওয়ার মতো গান উনি বলতে গেলে করেন না। আর, যেটা না বললেই নয়, ‘এত সুর আর এত গান’-এর গায়ক আধুনিকের চেয়ে ঢের বেশি গান তুলেছেন রবীন্দ্রনাথের। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁর এক জলসার পরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, সুবীরের আরও বেশি করে রবীন্দ্রসঙ্গীতে আসা প্রয়োজন।
রবীন্দ্রসঙ্গীতে যতটুকু যা এসে থাকুন খুব ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন এক প্রণম্য রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধকের। দেবব্রত বিশ্বাস।
জর্জ বিশ্বাসের প্রসঙ্গ তুলতেই সুবীর বললেন, “জর্জদার কথা খুব মনে পড়ে। একজন অসাধারণ লোক। কী শিক্ষা, কী মানসিকতা, আমায় অসম্ভব স্নেহ করতেন। অনেক সময়েই গান নিয়ে তর্ক বাঁধত, আমার যুক্তি ঠিক হলে মেনেও নিতেন। সে সময় উনি গণসঙ্গীত গেয়ে বেড়াতেন। ওঁর মোটর সাইকেলের পিছনে বসে আমি ঘুরতাম। পিছনে হারমোনিয়াম না থাকলেই এসে বলতেন, ‘তুই কুন দিকে যাইতেছস? হয়তো বললাম, আমি গড়িয়াহাট যাব। বললেন, চল নামাইয়া দিমু’।
রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া আরও দুটো নেশায় ওঁদের বাঁধত। পান-জর্দা আর তাসের জুয়ো। সুবীরের গলা ছাড়া ওঁর তাসের বুদ্ধিরও অনুরক্ত ছিলেন জর্জ। এক বোহেমিয়ানের সঙ্গে আরেক প্রায়-বোহেমিয়ানের মিলের অভাব বিশেষ ছিল না। তবে ঘুরে ঘুরে নানা জায়গায় থেকেও জর্জ বিশ্বাস শেষ অবধি ওঁর রাসবিহারীর ডেরায় বহু দিন থিতু ছিলেন। বম্বের ফ্ল্যাট তো সুবীর জলের দরে বেচে কলকাতায় ফিরে আসেন, তারপর নানা ঠিকানায় থাকলেন।
এখন তো পণ্ডিতিয়া প্লেসের নিবাসে। শুধু সন্ধেকালে যান বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পানীয় সহযোগে। বহু দিনের অভ্যাস বলে ডাক্তাররা এই অসুস্থতাতেও ওঁকে সামান্য একটু পান করতে বলেছেন, নচেৎ অসুবিধে।
বাকি সময় সুবীর থাকেন জীবনসঙ্গিনী সুনন্দা বসাকের ফ্ল্যাটে, গল্ফ ক্লাব রোডে। সুযোগ পেলেই কন্যার কথা বলেন, সে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সুবীরের বন্ধুরা কেউ ওঁর গান বা ওঁকে ছাড়া চলতে পারেন না। তাঁদের মধ্যে নামী ডাক্তার, উকিল, ব্যবসায়ী কে নেই!
এমন মানুষ কি সত্যিই নিঃসঙ্গ হয়? কে জানে! এত হাসি, এত কথার মধ্যেও ওই যে থেকে থেকে একটা বেদনার ছায়া এসে পড়ে অতর্কিতে, ওতেই সুর কেটে যায়। নতুন করে শোনাতে হয় শিল্পীকে এত সুর, আর এত গান থেমে গেলেও জানবেন আমরা আপনাকে ভুলিনি, ভুলব না।
না ভোলার প্রমাণ? কেন, ওই যে বাজছে গানটা সিডি-তে। আর চোখ ভিজছে। |
|
|
|
|
|