ঝাঁঝালো এক নতুন মুখ কংগ্রেসের
টাকমাথার জন্য চিরুনি বেচেন না, বোঝালেন রাহুল

১৭ জানুয়ারি
প্রয়োজন ছিল আগ্রাসী তুখোড় এক সওদাগরের। মেজেঘষে সেই মুখটিই বার করে আনলেন রাহুল গাঁধী।
দু’দিন আগেই দলের একজোড়া পোস্টার বার্তা দিয়েছিল, আর সনিয়া গাঁধী বা মনমোহন সিংহের ছায়ায় নয়, ভোটযুদ্ধের ময়দানে এ বার তিনিই মুখ। সেই অনুযায়ীই দলের কর্মসমিতির বৈঠকে কাল আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রচারের ব্যাটন তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে। যদিও দলে রাহুলের ঘনিষ্ঠরা বারবারই বলছিলেন, এ সব বড় কোনও ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হল এআইসিসি-র অধিবেশনে রাহুল কী বলতে চলেছেন, সেটাই। রাহুলের বাড়িতে বোন প্রিয়ঙ্কা ও দলের অন্য শীর্ষ নেতাদের ঘনঘন যাওয়া থেকেই ইঙ্গিত মিলছিল, চলছে বিশেষ কোনও প্রস্তুতি। প্রস্তুতি, দলের মুখ হিসেবে নতুন অবতারে রাহুলকে পেশ করার। এআইসিসি-র মঞ্চে আজ দেখা গেল সেই প্রস্তুতির ফসল।
ব্যাটন হাতে নিয়ে প্রথম দিনেই সাহসী সওদাগরের মতো তিনি টক্কর নিলেন প্রধান বিরোধী দল থেকে শুরু করে দেশের আর যারা কংগ্রেসের ক্ষমতায় টিকে থাকার পথে কাঁটা, তাদের সকলের। বোঝালেন, কোথায় তাঁর পণ্য আলাদা। নরেন্দ্র মোদী থেকে নয়া কাঁটা আম আদমি পার্টি, কিংবা ইউপিএ সরকারকে সমর্থন জোগানো মুলায়ম সিংহের দল সকলকেই যেন একই বাণে বিঁধতে চাইলেন তিনি। তাঁর কথায়, “চমক, নাচ, গান বিপণনে ওরা খুবই দক্ষ। যাদের চুল নেই, তাদের কাছেও চিরুনি বেচছে ওরা। এখন তো কিছু লোক তাদের চুলের ছাঁটও বাতলে দিচ্ছে।”
আগামীর নেতা রাহুল গাঁধীকে কাছে টেনে নিলেন মনমোহন সিংহ।
পাশে সনিয়া গাঁধী। শুক্রবার এআইসিসি-র বৈঠকে। ছবি: রয়টার্স।
এ তো গেল আক্রমণের দিক। কিন্তু নিজের ঝাঁপিতে এমন কী রয়েছে, যা নিয়ে গর্ব করতে পারেন রাহুল! দশ বছরে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়া, চার রাজ্যে বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির ধাক্কা, দল ও সরকারের কর্তাদের গায়ে দুর্নীতির কালি, নীতিপঙ্গুত্বের অভিযোগে জর্জরিত একটা সরকারের উত্তরাধিকার ঘাড়ে নিয়েই তো এগোতে হচ্ছে তাঁকে। নিজেরও রয়েছে ভাবমূর্তির সঙ্কট। বিরোধীরা তো বটেই, দলের নেতা-কর্মীরাও বলেন, নেতা হিসেবে তাঁর কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব। অনেক তত্ত্বের কথা বললেও দল ও মানুষের নাড়ির গতি যেন বুঝতে পারেন না, সংসদে কেউ প্রশ্ন করেন না তাঁকে। এমনই মুখচোরা যে নিজেও সংসদে মুখ খোলেন না বড় একটা।
গাঁধী পরিবারের এমন এক সদস্যকে সামনে রেখে কি মোকাবিলা করা যাবে নরেন্দ্র মোদীর? দল কি ভরসা পাবে তাঁর নেতৃত্বে? রাহুল তাঁর চড়া মেজাজের বক্তৃতায় যেন এই সব প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন যথাসাধ্য। দলকে এই ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করলেন যে, প্রতিকূল রাজনৈতিক ঝঞ্ঝার মধ্যেও তিনি ফের লড়াইয়ে এনে দিতে পারবেন দলকে।
সরকারের শীর্ষে থেকেও আম আদমির কাছে সরকার বা দলের রাজনৈতিক মুখ হয়ে উঠতে পারেননি মনমোহন সিংহ। সনিয়াই সে দায়িত্ব সামলে এসেছেন। এখনও তিনিই তা করে যাচ্ছেন। তাঁরই অনুমোদনেই দল কাল প্রচারের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে রাহুলের হাতে। কিন্তু নয়া দৌড় একটু অন্য ঘরানায় শুরু করলেন রাহুল। বোঝালেন, চাইলে তিনি কতটা ঝাঁঝালো হতে পারেন আক্রমণে। দলকে আশা দেখালেন, ঠিকঠাক বিপণনে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতির মতো গত দশ বছরে তৈরি হওয়া দগদগেও ক্ষতও! দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের তাতিয়ে তোলার পাশাপাশি চোখে চোখ রেখে তিনি বার্তা দিলেন প্রতিপক্ষকেও।
তবে দলকে দিশা দেওয়ার আত্মবিশ্বাস বা আক্রমণের ঝাঁঝটাই সবটুকু নয়, রক্ষণ ভাগে দেখা গেল কৌশলী পরিকল্পনা। সরকারটা নিজেরই দলের। মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাহুল কিন্তু ক্ষণিকের জন্যও অপাঙ্ক্তেয় করে রাখতে চাননি প্রধানমন্ত্রী মনমোহনকে। বরং মনমোহনকে কুর্নিশ জানিয়ে তাঁর সরকারের ভালটা নিয়েছেন। তবু এই মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধেই প্রকাশ্যে জেহাদ ঘোষণা করে দাগি নেতাদের সাংসদপদ বাঁচানোর অর্ডিন্যান্স বাতিল করিয়েছেন রাহুল। আজ দলের মঞ্চ থেকেই প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর আর্জি ছিল, ৯টা সিলিন্ডারে চলছে না, ভর্তুকির কোটা বাড়িয়ে ১২টা করা হোক। দেশের প্রায় অর্ধেক ভোটার মহিলা। রান্নার গ্যাস বা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অসন্তোষ প্রশমণে তাঁর মূল নিশানা ছিলেন মহিলারা। তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথাও যে কারণে বাদ পড়েনি রাহুলের বক্তৃতায়। লোকসভা, বিধানসভা থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যাতেও যাতে মহিলারাই অর্ধেক হন, তার জন্য সচেষ্ট হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। স্পষ্টতই আশ্বাস বিলির ক্ষেত্রে রাহুল হেঁটেছেন পপুলিজমের পথে। কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যে অত্যাবশক পণ্যের দাম কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন, “ক্ষমতায় এলে দারিদ্রসীমার নীচের মানুষকে মধ্যবিত্তের স্তরে তুলে আনবে কংগ্রেস। মাথার ওপর পাকা ছাদ হবে প্রত্যেকের। খাদ্য ও কাজের সঙ্গে এ বার স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকারও হবে মৌলিক অধিকার।”
সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতির দায় নেওয়ার প্রশ্নে কিন্তু রাহুল আম-জনতার পাশে। তাঁদের ক্ষোভ শান্ত করতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করে রাহুল বলেন, “তথ্যের অধিকার আইন পাশ করে এই যুদ্ধ শুরু করেছিল কংগ্রেসই। বিরোধীরা মস্করা করলেও লোকপাল বিলও পাশ করেছে সরকার। এ বার সংসদের আসন্ন অধিবেশনে দুর্নীতি দমনে আরও ৬টি বিল পাশ করানো হবে। সংসদ অচল করার ছুতোয় বিরোধীরা সেই উদ্যোগে বাধা দিলে পথে নেমে লড়াই করবে কংগ্রেস।”
রাহুলের এই নয়া অবতার কংগ্রেসকে কতটা জাগাতে পেরেছে, আজ অন্তত তার সাক্ষী ছিল তালকাটোরা স্টেডিয়াম। এই রাহুল কথায় কথায় কুর্তার হাতা গোটাননি। খোঁচা দাড়িও নেই। সৌম্য আত্মবিশ্বাসী এই মুখ অচেনা রকমের আক্রমণাত্মক। আক্রমণের বেশিটাই ঝরে পড়েছে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে। তাঁর কথায়, “বিরোধীরা কংগ্রেস-মুক্ত ভারত চাইছে। কিন্তু তা কি সম্ভব? কংগ্রেস তো কোনও দল নয়, দেশের চিরাচরিত ভাবনা। সৌভ্রাতৃত্ব ও সদ্ভাবের এই ভাবনাকে যারা মুছে দিতে চাইবে, তারা নিজেরাই শেষ হয়ে যাবে।” শুধু তা-ই নয়, পরোক্ষে মোদীর বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেছেন, “গণতন্ত্রে একনায়কতন্ত্রের স্থান নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছায় চলতে পারে না গণতন্ত্র।”
রাহুলের মোদ্দা কৌশল ছিল দ্বিমুখী। বিজেপি-র দিকে আঙুল তুলে দেশকে সাম্প্রদায়িকতার জুজু দেখানো। তেমনই এক বিকল্প প্রশাসনিক ব্যবস্থার দিশা দেওয়া। নিজের কোনও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও, মোদীর চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার, শিল্পের বিকাশ, যুব সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থানের মতো বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তা সুচারু ভাবে সম্পন্ন করার বার্তা দিয়েছেন রাহুল। দলকে চাঙ্গা করতে বলেছেন, প্রার্থী নির্বাচনও গণতান্ত্রিক ভাবে হবে।
আর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী? তালকাটোরা স্টেডিয়ামে আজও এই দাবি উঠেছিল প্রথম দিকে। কিন্তু সনিয়া সপাটে জানিয়ে দেন, কালই এ ব্যাপারে নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে। পরে এ বিষয়ে মুখ খোলেন রাহুল। মোদীর সঙ্গে তাঁর ফারাক তুলে ধরতে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী কে হবেন ভোটের পর সাংসদরা তা স্থির করবেন। আমি আপনাদের সৈনিক। যে দায়িত্ব দেবেন, তা মাথা পেতে নেব।”
কংগ্রেসের এই নয়া মুখের প্রশংসায় আজ মুখর হন মনমোহনও। তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “কংগ্রেস কর্মীদের মনে রাহুল আত্মবিশ্বাস ঢেলে দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস অবশ্যই ভোটে জিতবে।”
এই রাহুলকে পেয়ে খুশি দলও।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.