তৎপর হয়েছে পুলিশ প্রশাসন। কলেজের সামনে মোতায়েন ভিডিও ক্যামেরা। কিছু কলেজে মনোনয়ন পত্র পাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে অনলাইনে। তবু কলেজ ভোটে শান্তি থাকছে কই?
রাজ্যের বেশির ভাগ কলেজেই মনোনয়ন তোলার প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি অনলাইনে। আর তা নিয়েই বুধবার উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন কলেজ ছাত্র-ভোট ঘিরে হানাহানিতে অশান্ত হল। নদিয়ার বেথুয়াডহরি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রহৃত হয়ে ভর্তি হাসপাতালে। সন্দেশখালির কালীনগর কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) এক প্রার্থীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে দিনভর চলল রাজনৈতিক চাপান-উতোর। শিলিগুড়িতে পরিস্থিতি সামলাতে একাধিক কলেজে লাঠি চালাল পুলিশ।
এ দিনের সব ঘটনা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর অভিমত, “ছাত্র-ভোট নিয়ে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত গোলমাল হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু প্রশাসন সজাগ রয়েছে। রাজনীতির রং না দেখে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। হিংসা-হানাহানি করে ভোটে জেতা যাবে না।”
এ দিন সন্দেশখালির কালীনগর কলেজের মৃত ছাত্রের নাম পরেশ মণ্ডল (১৯)। তিনি বিএ প্রথম বর্ষে পড়তেন। তাঁর পরিবার সূত্রে খবর, বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ কলেজের গেটের সামনেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বুকে ব্যথা হওয়ায় নিত্যবেড়িয়া গ্রামে নিজের বাড়ি ফিরে যান। তাঁকে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বসিরহাট হাসপাতালে স্থানান্তরের সময়ে পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। |
এর পরেই শুরু হয় রাজনৈতিক চাপান-উতোর। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের অভিযোগ, “ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য এসএফআই পরেশকে হুমকি দিচ্ছিল। ওরাই পরেশকে কলেজে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য গেটের সামনে ধাক্কা মারে। তার জেরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান।” একই অভিযোগ তোলেন মৃতের দাদা তাপসও। এফএফআইয়ের বিরুদ্ধে তিনি এ নিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করায় পুলিশ একটি খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করে। ঘটনার প্রতিবাদে বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজ্য জুড়ে মিছিল-সমাবেশের ডাক দেন জ্যোতিপ্রিয়। শিক্ষামন্ত্রী ছাত্র-মৃত্যুর বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।
আগামী ২২ জানুয়ারি ওই কলেজের ছাত্র সংসদের ২৭টি আসনে নির্বাচন। বুধবার ছিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। ফলে, এ দিন কলেজে ভিড় ছিল। তবে, কলেজের সামনে কোনও গোলমাল হয়নি বলে দাবি করেছেন কিছু ছাত্রছাত্রী। পরেশকে ধাক্কা মারা বা বাধা দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে এসএফআই। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস বলেন, “এই ঘটনা নিয়ে নোংরা রাজনীতি হচ্ছে।” এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কলেজে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দেহের ময়না-তদন্তের রিপোর্ট মিললেই মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার হবে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোরঞ্জন নস্কর বলেন, “কলেজের গেটে কোনও অশান্তি হয়েছে কি না, জানতে ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখা হবে।”
নদিয়া জেলার কলেজগুলিতে ২৮ জানুয়ারি ভোট। এ দিন ভোটার তালিকা সংক্রান্ত অভিযোগ জানাতে বেথুয়াডহরি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অলোককুমার দাসের কাছে যাচ্ছিলেন কিছু এসএফআই কর্মী-সদস্য। টিএমসিপি তাঁদের বাধা দেয় বলে অভিযোগ। এসএফআই বিক্ষোভ দেখায়। তার পরেই কয়েক জন এসএফআই কর্মী মাফলার ধরে তাঁকে টেনে তাঁকে ঘরের বাইরে এনে উইকেট, রড দিয়ে মারতে থাকে বলে পুলিশে অভিযোগ জানান অলোকবাবু। তাঁকে বেথুয়াডহরি গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অভিযোগ অস্বীকার করেছে এসএফআই। |
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে রানাঘাট কলেজে আবার মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়ার সময় টিএমসিপি-র একাংশের বিরুদ্ধে বোমাবাজির অভিযোগও ওঠে। প্রতিবাদে ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছাত্র পরিষদ। চাপড়া বাঙ্গালঝি কলেজেও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়ে বোমাবাজি হয়। জখম হন এক পথচারী। হুগলির মশাটের বিদ্যাসাগর কলেজে মারধর করে এসএফআই প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা না দিতে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে। তিন এসএফআই সমর্থক জখম হন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা অহল্যাবাঈ রোড অবরোধ করে এসএফআই। টিএমসিপি অভিযোগ মানেনি।
বিধাননগরের পাঁচ নম্বর সেক্টরের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও এ দিন মনোনয়নকে ঘিরে মারামারি হয় এসএফআই ও টিএমসিপি-র মধ্যে। দু’পক্ষেরই কয়েক জন জখম হন। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় টিএমসিপি-র। টিএমসিপি-র অভিযোগ, পুলিশ তাদের উপরে লাঠি চালায়। গোলমাল হয় ফলতার সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়েও।
গোলমাল থেকে বাদ যায়নি উত্তরবঙ্গের ছ’টি কলেজ। শিলিগুড়ি কমার্স কলেজে ছাত্র পরিষদ এবং টিএমসিপি-র সংঘর্ষে জখম হন ৮ জন। সে সময় পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে থাকে বলে অভিযোগ। শিলিগুড়ি মহিলা কলেজে এসএফআই ও টিএমসিপি-র ছাত্রীরা মারপিটে জড়িয়ে পড়েন। কয়েক জন জখম হন। পরিস্থিতির জেরে মনোনয়নপত্র বিলি বন্ধ করে দেন কর্তৃপক্ষ। তার আগেই এসএফআই কর্মী ইন্দ্রাণী সরকারের উপরে হামলা হয় বলে অভিযোগ। উঠেছে ওই সংগঠনের কয়েক জন ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগও। বাগডোগরা কলেজে এসএফআই-টিএমসিপি গোলমাল হয়। |
শিলিগুড়ি পলিটেকনিক কলেজে ছাত্র পরিষদ ও টিএমসিপি-র গোলমাল থামাতে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়। সূর্য সেন কলেজে টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে মনোনয়ন তুলতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তোলে ছাত্র পরিষদ এবং এসএফআই। কলেজে ঢোকার রাস্তাগুলি সোমবারের মতো এ দিনও টিএমসিপি পুলিশের সামনেই আটকে রাখে বলে অভিযোগ। যদিও শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার জগমোহনের দাবি, “প্রতিটি এলাকাতেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তার বন্দোবস্ত থাকায় বড় কোনও ঘটনা ঘটেনি।”
টিএমসিপি এবং এসএফআইয়ের সংঘর্ষ হয় হরিরামপুর আব্দুল গণি দেওয়ান কলেজে। সংঘর্ষে টিএমসিপির এক নেতা এবং এসএফআইয়ের ৩ জন জখম হন। পুলিশ দু’জন এসএফআই সমর্থককে গ্রেফতার করে।
এই সব অশান্তির জন্য রাজ্য প্রশাসনের কড়া সমালোচনা করেছে কংগ্রেস। অশান্তি রোখার আর্জি নিয়ে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনেরও দ্বারস্থ হয়েছে ছাত্র পরিষদ। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া এ দিন বলেন, “কলেজে কলেজে যা চলছে, তা কি মুখ্যমন্ত্রীর অগোচরে হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর রাজত্বে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা, রাজ্যের কিশোরী বা মহিলারা নিরাপদ বোধ করছেন না।” |
বুধবার দীপঙ্কর দে ও বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি। |