ওডাফা দৌড়ে যাচ্ছেন সাইড লাইনের ধারে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা ইচের কাছে। হাতজোড় করে বলছেন, “আর মিনিট পাঁচেক বাকি, মাঠ ছেড়ে যেও না প্লিজ।”
ইচে খোঁড়চ্ছেন, মাঠে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ছেন। তবুও বাগান গোলের সামনে বল এলেই সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। কড়া ট্যাকলে যাচ্ছেন।
ক্রিস্টোফারের গোলের পর করিম বেঞ্চারিফার সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠল পুরো রিজার্ভ বেঞ্চ। মাঠের ভেতর থাকা টিমের বেশিরভাগ ফুটবলার দৌড়ে এসে হাত মিলিয়ে গেলেন রিজার্ভদের সঙ্গে। দেখে মনে হচ্ছিল, এগারো নয়, আঠারো জনই খেলছে আজ বাগানে। কেউ পা দিয়ে, কেউ ইচ্ছাশক্তি দিয়ে।
ডার্বি ম্যাচ কি বদলে দিল পুরো বাগানের আবহাওয়া? নুইয়ে পড়া বিধ্বস্ত ট্রফিহীন টিমটা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল শেষ পর্যন্ত? তাই-ই মনে হচ্ছে। না হলে, শুধু টিমগেমের রেসিপি দিয়ে এত দাপটে ইয়াকুবু-হারাসদের বধ করতে পারতেন না মরক্কান কোচ। যুবভারতীর ডার্বির আলো এনে ফেলতে পারতেন না কোচিতেও। মোহন-পরিবারের আন্তরিকতা আর লক্ষ্যে স্থির থাকা দেখে এতটাই তৃপ্ত করিম, যে টিমবাসে ওঠার আগে বলে গেলেন, “কে কোথায় কত গোলে জিতল মনে রাখছি না। গ্রুপের তিনটে ম্যাচ জিতেই আমরা শেষ চারে যাব।” লক্ষ্যটা অবশ্যই তাঁর গ্রুপের এ দিন অন্য ম্যাচে চার গোলে জেতা লাজং। শনিবার পরের ম্যাচে তো গ্লেন-টুবোইদের সঙ্গেই বাগানের লড়াই। জিততে পারলেই শেষ চারে অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যাবে গঙ্গাপাড়ের তাঁবু।
সালগাওকরকে যখন লাজং একের পর এক গোল চাপাচ্ছে তখনই ভিআইপি বক্স থেকে নেমে গিয়েছিলেন ম্যাচ দেখতে বসা করিম। নিজেদের ড্রেসিংরুমে গিয়ে তার পর মোহন-কোচের পেপ-টক ছিল, “আমরাই জিতব। অন্য দিকে তাকিও না। নিজেদের খেলাটা খেলো।” পরের দু’ঘণ্টায় রিজার্ভ বেঞ্চের সঙ্গে প্রথম একাদশের একাত্মতা বোঝাল করিম সফল। একশো ভাগ। ওডাফা ওকোলির মাঠে না থাকাটা শাপে বর হয়ে গেল তাঁর। |
ক্রিস্টোফারের গোলে তিন পয়েন্ট। |
ফুটবল-ঈশ্বর বরাবর সাহসীদের সহায় হন। ওডাফা খেলার জন্য মরিয়া শুনেও দু’কোটির ফুটবলারকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছিলেন করিম। একেবারে কলকাতা ডার্বি-শেষের একাদশ নেমেছিল ফেড কাপের প্রথম ম্যাচে। নিখুঁত অঙ্ক কষে। ইয়াকুবুর ঘাড়ে করিম তুলে দিয়েছিলেন ইচেকে। খালিদ জামিলের টিমের প্রাণভোমরা হারাসের পায়ে-পায়ে লাগিয়েছিলেন কখনও কাতসুমি, কখনও জাকিরকে।
মুম্বই-বধের অঙ্কে নিজের দলের আক্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন উইং-প্লে। সাইডলাইন দিয়ে দৌড়তে-দৌড়তে হঠাৎ-ই কাট করে ভেতরে ঢুকে পড়ার স্ট্র্যাটেজি। তাতেই বিপক্ষ ডিফেন্স বারবার বিভ্রান্ত এই ম্যাচে। পঙ্কজ মৌলা আর সাবিথকে সেটাই করে গেলেন নিরন্তর। ক্রিস্টোফারের সঙ্গে শঙ্কর ওঁরাওয়ের গতিকে জুড়ে দেওয়াটাও করিমের মাস্ট্রারস্ট্রোক। তার সুবিধা হয়ে গিয়েছিল কম বয়সী দ্রুতগতির কিছু ফুটবলার হাতে থাকায়। যাঁর মধ্যে জনা চারেক বঙ্গসন্তান। কেউ গড়িয়ার, কেউ বজবজের।
ম্যাচের সেরা কে? ওডাফা দু’জনের পিঠে হাত রাখলেন। ইচে আর কাতসুমির। “বুকটা ধুকপুক করছিল। মনে হচ্ছিল হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে যে কোনও মূহূর্তে। বাইরে থাকা কী কঠিন!” বলছিলেন বাগান-অধিনায়ক। জানিয়ে দিলেন, “পরের ম্যাচেই আমি ফিরছি।”
বাগানের জেতার কথা অন্তত চার গোলে। ক্রিস্টোফার, কাতসুমি, রাম, পঙ্কজবোহেমিয়ান হয়ে নিশ্চিত যে সব গোল নষ্ট করলেন তা অপরাধ। গ্রুপ লিগে গোল পার্থক্য এক-এক সময় বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে। বাগান যদি সেমিফাইনালে ওঠার পথে সেই অঙ্কের গেরোয় পড়ে তখন হাত কামড়াতে হবে।
আবার বয়সও কখনও-কখনও সত্যিই বাধা হয়। ইয়াকুবুর এ দিন যা হল। ঘানার ফুটবলারটি যখন খেলা শুরু করেছেন তখনও প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি হয়তো পেরোননি প্রীতম কোটাল, শৌভিক ঘোষ, আইবররা। তাঁদের সামনে নিজের বিখ্যাত ‘স্নেক ডান্স’ দেওয়া দূরে থাক, হাঁটু মুড়ে বসতে হল মুম্বই স্ট্রাইকারকে। দু’টো ভাল শট ছাড়া ইয়াকুবু বন্দি হয়ে থাকলেন সারাক্ষণ। আর আফগান হারাস? জীবনে প্রথম বার ডিফেন্সিভ ব্লকারে নেমে স্থানীয় ছেলে জাকির মন্ডাম্পাও যে ভাবে তাঁকে অকেজো করলেন, তা মনে হয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি সাফ জেতা ফুটবলারটি। ড্রেসিংরুমে ঢোকার মুখে ইয়াকুবু আর হারাসকে দেখে মনে হল দু’জনেই হতবাক। ইচে-মন্ডাম্পার বিক্রম দেখে।
শুরুর মিনিট দশেক বাদ দিয়ে বাগানের বল পজেসনই ছিল বেশি। এবং মুম্বইয়ের শক্তিশালী মাঝমাঠকে পকেটে পুরে নিয়েছিল বাগান। মাঝমাঠের লড়াইয়ে করিমের টিমকে এগিয়ে দিয়েছিলেন দু’জনজাকির আর কাতসুমি। জাকির ধ্বংসাত্মক ফুটবল খেলে ক্লাইম্যাক্স-প্রদীপদের মতো অভিজ্ঞদের বোকা বানালেন। আর মাঠ জুড়ে প্রায় সব বলের পিছনে দৌড়চ্ছিলেন কাতসুমি। কখনও ডিফেন্সকে সাহায্য করলেন, কখনও বিপক্ষের রক্ষণকে বোকা বানিয়ে পাস বাড়ালেন গোলের।
যদিও বাগানকে শুরুতেই অক্সিজেন দিয়েছিলেন গোলকিপার শিল্টন পাল। ডার্বি ম্যাচে তাঁর হাতে আটকে গিয়েছিলেন চিডিরা। তাঁর ধারাবাহিকতা নেই, এই বদনাম ঘোচাতে মনে হল মরিয়া সোদপুরের ছেলে। হারাসের তীব্র গতির শট শিল্টন যে ভাবে উড়ে গিয়ে বাঁচালেন, অবিশ্বাস্য। ভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখছিলেন জাতীয় কোচ কোভারম্যান্স। হাততালি দেওয়ার পাশাপাশি তাঁকে দেখা গেল সামনে টিভিতে সেভ-এর রিপ্লে দেখার জন্য ঝুঁকে পড়েছেন। ওই গোলটা খালিদের দল পেয়ে গেলে চাপে পড়ে যেত করিম ব্রিগেড।
ক্রিস্টোফারের একমাত্র গোলটা বাগান-আক্রমণের ঢেউয়ের সুফল। গোলের আগে কাতসুমির শট বিপক্ষ গোলকিপারের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ক্রসপিসে লেগে ফিরল। মনে হয়েছিল, করিমের ভাগ্য মনে হয় ডার্বি-জয়েই আটকে থাকল। কিন্তু কিছু পরেই জাপানি মিডিও-র অসাধারণ পাস ধরে ক্রিস্টোফার গোল করে গেলেন। হঠাৎ গতি বাড়িয়ে। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি। পিয়ারলেস থেকে বাগানে আসার পর ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে আই লিগে দু’গোল করেছিলেন নাইজিরিয়ান ক্রিস্টো। তার পর আবার বাগানে ফুল ফোটালেন তিনি। জ্বালিয়ে রাখলেন আলো। নিয়মে আটকে যাওয়ায় কলকাতা লিগের ম্যাচ খেলতে পারেননি। সে জন্য আফশোস ছিল। ম্যাচের পর বললেন, “অনেক দিন খেলার সুযোগ পাইনি। আজ ঠিকই করেছিলাম গোল করবই। সেটা পেরে ভাল লাগছে। তবে জয়টা আমাদের টিমগেমের।”
ক্রিস্টোফারের স্বপ্ন সফল। কিন্তু বাগান শেষ চারে যাবে কি না সেটা নিশ্চিত হতে আরও দু’টো ম্যাচ অপেক্ষা করতে হবে। করিম অবশ্য দ্রুত ড্রেসিংরুমে ঢুকে সবাইকে তাড়া দিয়ে টিমবাসে তুলে দিলেন। ‘মিশন পাহাড়’-এর প্রস্তুতির জন্য এক মিনিটও যে অপেক্ষা করতে রাজি নন বাগান-কোচ। |
ভারত সেরার দৌড়ে স্বস্তি বাগানে |
মোহনবাগানে ডার্বির রেশ
ইয়াকুবুর চ্যালেঞ্জ সামলে দিল করিমের দল। প্রথমার্ধেই ক্রিস্টোফারের গোলে এগিয়ে যায় মোহনবাগান। মুম্বই এফসি আর ফিরে আসতে পারেনি ম্যাচে।
টার্নিং পয়েন্ট
ইয়াকুবুকে বোতলবন্দি
করিমের শক্তি
ডার্বির পর টিমের তুরীয় মেজাজ
টিম গেম
পরের ম্যাচে ফিরছেন ওডাফা
নক আউটে ওঠার চ্যালেঞ্জ
সালগাওকরকে ৪-০ হারিয়ে ফর্মে থাকা লাজংকে পরের ম্যাচে হারাতে পারলেই অনেকটা নিশ্চিন্ত। সেক্ষেত্রে সালগাওকরের সঙ্গে ড্র করলে শেষ চারে চলে যাওয়া নিশ্চিত |
|
মোহনবাগান: শিল্টন, প্রীতম, আইবর, ইচে, শৌভিক, পঙ্কজ, কাতসুমি, জাকির, সাবিথ (রাম), শঙ্কর, ক্রিস্টোফার। |