গোটা দেশের চোখ ফের সুপ্রিম কোর্টের দিকে। অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের পরে স্বতন্ত্র কুমার আবার এক প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যৌন হেনস্থা করার। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগকারিণী এক ইন্টার্ন এবং কলকাতার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জুরিডিকাল সায়েন্সের প্রাক্তন ছাত্রী। বিচারপতি কুমারের বিরুদ্ধে তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবমের কাছে হলফনামা দিয়েছেন। প্রাক্তন বিচারপতি কুমার গত কালই কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে ওই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, এটা তাঁর বিরুদ্ধে কোনও চক্রান্ত। সেই সঙ্গে তিনি সব সংবাদমাধ্যমকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যে, ওই হলফনামা প্রকাশ করলে ফল গুরুতর হতে পারে। তা সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমের একাংশে ওই মহিলার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তাতেই জানা গিয়েছে, ওই ইন্টার্ন বিচারপতি কুমারের বিরুদ্ধে অবাঞ্ছিত ভাবে ছোঁয়া ও চুমু খাওয়ার অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগ প্রকাশ্যে চলে আসার পরে প্রাক্তন বিচারপতি কুমার আজ রাতে দু’টি টিভি চ্যানেলকে আইনি নোটিস পাঠান। তাঁর দাবি, ‘অবিশ্বাস্য ও ভুয়ো’ খবর দেখানোর জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্তে ক্ষমা চাইতে হবে তাদের।
প্রাক্তন বিচারপতি কুমারের ভবিষ্যৎ এ বার কী দাঁড়াবে তার অনেকটাই নির্ভর করছে শীর্ষ আদালত এই ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নেয় তার উপরে। কারণ, অশোক গঙ্গোপাধ্যায় যে সময় যৌন হেনস্থা করেছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে সময় তিনি ছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি। তাঁর ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট তদন্ত কমিটি গড়লেও জানিয়ে দিয়েছিল, প্রাক্তন বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এক্তিয়ার তাদের নেই। বিচারপতি কুমারের ক্ষেত্রেও শীর্ষ আদালত প্রাথমিক ভাবে একই অবস্থান নিয়েছে। তবে দু’টি ঘটনার মধ্যে একটা ফারাক রয়েছে। স্বতন্ত্র কুমার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থাকার সময়ই যৌন হেনস্থা করেছেন বলে অভিযোগ। ঘটনার সময় অভিযোগকারিণী তাঁর দফতরে সরকারি ভাবেই ইন্টার্ন হিসেব কাজ করতেন। অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্লগে অভিযোগ ওঠার পরেই সুপ্রিম কোর্ট যে ভাবে সক্রিয় হয়ে তদন্ত কমিটি গড়েছিল, তা দেখেই তিনি সরব হওয়ার সাহস পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তবে শীর্ষ আদালত কোনও পদক্ষেপ না করলে তিনি মামলা করার কথাও ভাবছেন। |
প্রাক্তন বিচারপতি কুমার এখন জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুন্যালের চেয়ারম্যান। ওই পদ থেকে তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। ঠিক যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অশোকবাবুর ইস্তফার দাবি উঠেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে চক্রান্ত আখ্যা দিয়ে প্রথম ক’দিন ইস্তফা দিতে অস্বীকার করলেও কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে সরানোর প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়ার পরে পদত্যাগ করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এখন তেল ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী বীরাপ্পা মইলির হাতে। তিনি বলেছেন, “সন্দেহ নেই, অভিযোগ যথেষ্ট গুরুতর। গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নিয়ম অনুযায়ী অবিলম্বে তদন্তের সুপারিশ করা যেতে পারে।” তবে মইলিও আজ শীর্ষ আদালতের কোর্টেই বল ঠেলে দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, স্বতন্ত্র কুমারের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে কি না, তা বিচার ব্যবস্থাকেই ঠিক করতে হবে।
অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ইন্দিরা জয়সিংহ প্রশ্ন তুলেছেন, “কী ভাবে শীর্ষ আদালত সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে! সুপ্রিম কোর্ট এর তদন্ত করুক এবং নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করুক।” বেশ কয়েক জন প্রাক্তন বিচারপতি, আইনজীবীদেরও অনেকে অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থার দাবি তুলেছেন। লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজও অভিযোগ খতিয়ে দেখে সুবিচারের দাবি করেন।
প্রধান বিচারপতিকে দেওয়া সাত পৃষ্ঠার হলফনামায় অভিযোগকারিণী জানিয়েছেন, তিন বার তাঁর সঙ্গে বিচারপতি স্বতন্ত্র কুমার অবাঞ্ছিত আচরণ করেছিলেন। ২০১১ সালের মে মাসে স্বতন্ত্র কুমারের অফিসে তিনি ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেছিলেন। সে সময়ই এই ঘটনাগুলি ঘটে। প্রথম ঘটনা ঘটে কাজে যোগ দেওয়ার কিছু দিন পরেই। একসঙ্গে অফিস থেকে বেরনোর সময় কুমার তাঁর কোমরের নীচে হাত দেন বলে অভিযোগ। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে ওই বছর ২৮ মে। ইন্টার্ন জানিয়েছেন, তিনি কাজে কিছু ভুল করে ফেলার পর দুঃখপ্রকাশ করতে গিয়েছিলেন। সে সময় বিচারপতি একাই তাঁর ঘরে ছিলেন। তিনি ইন্টার্নকে দুশ্চিন্তা করতে মানা করে টেবিলের পাশে ডেকে নেন। তারপর ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বাঁ কাঁধে চুমু দেন। এর পরেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ওই মহিলা। আর এক বার কথাবার্তার সময় বিচারপতি কুমার ওই মহিলাকে আইন পাশ করার পর তাঁর অধীনেই কাজ করার প্রস্তাব দেন। ওই মহিলা তাঁর সঙ্গে ঘুরতে এবং হোটেলের ঘরে থাকতে স্বচ্ছন্দ কি না, তা-ও জানতে চান তিনি। ওই মহিলা জানিয়েছেন, এ সবের পরেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করে তিনি ইন্টার্নের কাজ শেষ করে কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। বাবা-মা এবং এক জন সহপাঠী ছাড়াও তিনি এই ঘটনার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র রুচিরা গোস্বামীকে জানিয়েছিলেন। গত ডিসেম্বর মাসে তিনি এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ জানান।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য দ্বিতীয় ঘটনার অভিযোগকারিণীকে এখনও শনাক্ত করতে পারেনি। রুচিরাদেবী এ দিন বলেন, “ওটা ২০১১র কথা। তাই ধরেই নেওয়া যায়, ওই ছাত্রী অনেক দিন আগেই আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বেরিয়ে গিয়েছেন।” রুচিরাদেবী জানান, ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে লিখিত ভাবে কোনও অভিযোগ জানাননি। যদি লিখিত ভাবে অভিযোগ জানান, তার উপরে ভিত্তি করে পরবর্তী কালে অভিযুক্ত ওই বিচারপতির কাছে ইন্টার্ন পাঠানো বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
প্রশ্ন হল, লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরে সুপ্রিম কোর্ট এ বার কী করবে? সুপ্রিম কোর্টের কাছে মহিলা ইন্টার্ন আবেদন জানিয়েছেন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা রুখতে শীর্ষ আদালতেরই যে বিশদ নির্দেশিকা রয়েছে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা হোক। যাতে সেখানে তিনি নির্ভয়ে নিজের বক্তব্য জানাতে পারেন। দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি আর এস সোধির মত, মহিলার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হলে তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া যেতেই পারে। আইনজীবী কামিনী জায়সবালের যুক্তি, “ওই বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টে কর্তব্যরত অবস্থাতেই অবাঞ্ছিত আচরণ করেন বলে অভিযোগ। কাজেই সুপ্রিম কোর্টেরই এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া কর্তব্য।” কিন্তু এত দিন পরে ওই মহিলা ইন্টার্ন এই অভিযোগ প্রকাশ্যে আনছেন কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আইনজীবী আভা সিংহ যেমন প্রশ্ন তুলেছেন, কেন ওই মহিলা পুলিশের কাছে গেলেন না? ইন্টার্ন জানান, অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরই মতো এক জন ইন্টার্নকে মুখ খুলতে দেখেই তিনি সাহস পেয়েছেন।
|
ইন্টার্নদের লিখে জানাতে হবে অভিজ্ঞতা |
কোনও ছাত্রী ইন্টার্নশিপ থেকে ফিরলে তাঁর অভিজ্ঞতা জানবে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস। এই ব্যাপারে নতুন কিছু নিয়মকানুনও তারা তৈরি করছে। শনিবার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পি ঈশ্বর ভট্ট জানান, ওই নিয়ম চূড়ান্ত করার আগে পরামর্শ চেয়ে খসড়া পাঠানো হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষানবিশ ছাত্রী যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলেন। তা নিয়ে তোলপাড় হয় দেশ। এরই মধ্যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই আর এক প্রাক্তন ছাত্রী যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আরও এক প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে। পরপর এই ধরনের ঘটনায় মহিলা ইন্টার্নদের সুরক্ষায় বিশেষ কিছু নিয়মকানুন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। ঠিক হয়েছে, ইন্টার্নশিপ পর্ব শেষ করে আসা ছাত্রীদের কাছ থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতা জানবে কর্তৃপক্ষ। উপাচার্য আগেই জানিয়েছিলেন, ইন্টার্নশিপ থেকে ফেরার পর প্রত্যেক ছাত্রীকে ছ’মাসের মধ্যে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানাতে হবে। যদি কেউ তার পরে জানান, তা হলে ওই দেরির কারণও বলতে হবে। এই ব্যাপারে প্রাথমিক ভাবে একটি খসড়া নিয়মও তৈরি করা হয়। সেই খসড়ায় কোন কোন বিষয় রাখা হবে, তা নিয়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সঙ্গে কাল, সোমবার বৈঠক হবে। শনিবার এ বিষয় উপাচার্য বলেন, “খসড়া নিয়ে আলোচনার পরে তা পাঠানো হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে তাঁর পরামর্শের জন্য। কারণ তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য।” |