মহিলা ইন্টার্ন নিতেই নারাজ বিচারপতিরা
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরই এক ইন্টার্ন যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনার পরে কলকাতা হাইকোর্টের অনেক বিচারপতি এখন মহিলা পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টই (পিএ) নিতে চাইছেন না। অভিজ্ঞ আইনজীবীদের একাংশও মহিলা জুনিয়র বা ইন্টার্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছেন। এর ফলে বিপাকে পড়তে চলেছেন আইনের ছাত্রী ও এই পেশায় সদ্য আসা মহিলা আইনজীবীরা। অভিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছ থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ না পেলে তাঁদের পেশাগত শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে না এই আশঙ্কায় ভুগছেন তাঁরা।
বিচারপতিদের কেউ কেউ সরাসরি জানিয়েছেন, তাঁরা মহিলা পিএ নেবেন না। কেউ কেউ একটু ঘুরিয়ে বলেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞ ও প্রবীণ পিএ দেওয়া হোক। ১৩ বছর ধরে বিচারপতির কাজ করছেন, এমন এক বিচারপতি জানিয়েছেন তাঁর চেম্বারে এবং বাড়িতে যদি সিসিটিভি বসানো হয়, একমাত্র তা হলেই তিনি মহিলা পিএ নেওয়ার কথা ভাববেন। এর ফলে যে রেজিস্ট্রারেরা পিএ দেওয়ার বিষয়টা দেখেন, বিপাকে পড়েছেন তাঁরাও।
বিচারপতিদের পিএ-র কাজ কী? তাঁরাই বিচারপতিদের দেওয়া রায়ের ‘ডিক্টেশন’ নেন। বসেন বিচারপতির চেম্বারেই। অনেক সময় ‘ডিক্টেশন’ নেওয়ার জন্য বিচারপতির বাড়িতেও যেতে হয়। এই সব কারণে বিচারপতিরা মহিলা পিএ-র নেওয়ার ব্যাপারে সংবেদনশীল হয়ে পড়েছেন বলে আদালত সূত্রের খবর। সম্প্রতি হাইকোর্টে কয়েক জন স্টেনোগ্রাফার নিয়োগ করা হয়েছে। এই নবনিযুক্তদের মধ্যেও মহিলাই বেশি। হাইকোর্ট সূত্রের খবর, এখন তাঁদেরও অনেককে কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। সদ্য কাজে যোগ দেওয়া মহিলা স্টেনোগ্রাফারদের বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।
শুধু বিচারপতিরাই নন, ইন্টার্ন ও মহিলা জুনিয়র আইনজীবী রাখার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্ক হচ্ছেন আইনজীবীদের একটি বড় অংশও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক এবং প্রবীণ আইনজীবী ভূদেব ভট্টাচার্য বলেন, “অনেক সময়ে ইন্টার্ন হিসাবে দু’এক জন মহিলাকে নিতাম। কিন্তু এখন তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। এই বৃদ্ধ বয়সে হেনস্থার আশঙ্কা নিয়ে থাকার কী দরকার!” একই উদ্বেগের কথা বলেছেন অরুণাভ ঘোষ, মিলন মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিজ্ঞ আইনজীবীরাও। এমনকী, রাজ্যের এক অতিরিক্ত গভর্নমেন্ট প্লিডার (এজিপি) তপন মুখোপাধ্যায়ের সদ্য আইন পাশ করা মেয়েকেও ঠারেঠোরে প্রত্যাখ্যান করছেন কয়েক জন অভিজ্ঞ আইনজীবী। তপনবাবু বলছেন, “কয়েক জন বন্ধুকে বলেছিলাম, মেয়েকে জুনিয়র হিসেবে নিয়োগ করতে। তাঁরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেননি। আবার মেয়েকে নেনওনি।”
কলকাতা হাইকোর্টের এক বিচারপতির তরুণী ইন্টার্নকে নিজের জুনিয়র হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন অভিজ্ঞ এক আইনজীবী। তরুণী নিশ্চিন্তে ছিলেন, পাশ করার পরে তিনি তাঁর কাছেই কাজ শিখবেন। কিন্তু দিন কয়েক আগে ওই আইনজীবী জানিয়েছেন, মহিলা জুনিয়র তিনি রাখবেন না। ওই তরুণীর কথায়, “এত দিন যেন আমি মহিলা ছিলাম না!”
অভিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছে কাজ শেখার গুরুত্ব কী? কোনও ছাত্র আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তাঁকে প্রথমে বার কাউন্সিলের সদস্য হতে হয়। তার পরেই আইনি পেশার কাজ শুরু করা যায়। কিন্তু আদালতের কাজের যে টেকনিকাল বিষয় রয়েছে, তা শেখা ও জানার জন্যে এক জন অভিজ্ঞ আইনজীবীর জুনিয়র হিসাবে থাকতে হয়। আজ যাঁরা বিখ্যাত আইনজীবী, তাঁরাও পেশার শুরুতে কোনও না কোনও অভিজ্ঞ আইনজীবীর কাছে জুনিয়র হিসাবেই কাজ করেছেন।
সম্প্রতি আইনজীবীরা ইন্টার্ন বা মহিলা জুনিয়র নেওয়ার ব্যাপারে সংবেদনশীল হয়ে পড়ায়, বিপাকে পড়তে পারেন এই পেশায় সদ্য আসা মহিলারা। মহিলারা ইদানীং অনেক বেশি সংখ্যায় আইন পড়তে আসছেন। আইন বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ২০১০-১১ সালে এলএলবি-তে ৯৭ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ছেলেমেয়েদের সংখ্যা প্রায় আধাআধি ছিল। ২০১১ সালে গিয়ে দেখা যায়, মেয়েরাই সংখ্যায় বেশি। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ছাত্রীসংখ্যা আরও বেড়েছে। এমন অবস্থা যে, ছাত্রী হস্টেলে সবার থাকার জায়গা হচ্ছে না। কিন্তু ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়লেও কলকাতায় অভিজ্ঞ মহিলা আইনজীবীর সংখ্যা তুলনায় এখনও অনেকটা কম। তাই সব মহিলা জুনিয়র বা ইন্টার্ন-ই যে অভিজ্ঞ মহিলা আইনজীবীর কাছে কাজ শিখতে পারবেন, এমন সুযোগ নেই। তাই পুরুষ বিচারপতি ও অভিজ্ঞ আইনজীবীরা মহিলা ইন্টার্ন কিংবা জুনিয়র না নিলে পেশাগত ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই মনে করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক ছাত্রী। তাঁর কথায়, “তা হলে আমরা কাজ কী করে শিখব? এত দিন ধরে পড়ার পরে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে?”
বিষয়টি যে অত্যন্ত গুরুতর, তা মেনে নিয়েছেন জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকারাও। তাঁরা মনে করেন, এই সমস্যার সমাধানে সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনা করতে হবে। একই কথা বলছেন ছাত্রীরাও। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্রী নয়না দাশগুপ্ত বলেন, “এ ভাবে মহিলাদের কাজে না ঢুকিয়ে সমস্যার কোনও সমাধান সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।” একটি সলিসিটর ফার্মে কর্মরত তরুণী আইনজীবীর কথায়, “বিভিন্ন কনফারেন্সে গেলেই পুরুষদের মধ্যে মহিলা সহকর্মীদের সম্পর্কে নানা বিরূপ আলোচনা কানে আসছে। পারস্পরিক বিশ্বাসটাই যেন এই ঘটনার পরে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
এ ব্যাপারে কী বলছেন অভিজ্ঞ মহিলা আইনজীবীরা? বাম আমলে রাজ্যে মহিলা কমিশনের সদস্য, আইনজীবী ভারতী মুৎসুদ্দি বলেন, “এই ধরনের প্রবণতা মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়ার রাস্তায় বিরাট ক্ষতি করবে।” তাঁর মতে, যে ঘটনায় এই আলোড়ন, তার অভিযোগকারিণীরই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। ভারতীদেবী বলেন, “ওই মহিলা যথাযথ পদ্ধতি মেনে অভিযোগ দায়ের না-করলে অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে না। উনি চুপ করে বসে থাকার জন্যই অনেক মেয়েকে এ ধরনের সমস্যায় জেরবার হতে হবে।” তৃণমূলের আইনজীবী, সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিতর্কে জড়াতে চাইছেন না। তিনি বলেন, “কে কাকে ইন্টার্ন রাখবেন, সেক্রেটারি রাখবেন সেটা তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য না করাই ভাল।”
সম্প্রতি প্রবীণ সাংবাদিক তরুণ তেজপালের ঘটনার পরেও সপা নেতা নরেশ অগ্রবাল এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা এই জাতীয় সমস্যার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। দু’জনেই বলেছিলেন, মহিলা কর্মী নিয়োগ করার আগে এ বার সকলে দু’বার ভাববেন। তাই নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্কের জেরে ফারুক তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার করেন। এ বার আইনি পেশায় এই সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে কী ভাবছেন নারী আন্দোলনের কর্মীরা? শাশ্বতী ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, “একটা ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে মেয়েদের কাজের জায়গাটা সঙ্কুচিত করার চেষ্টা চলছে।” তবে এই প্রবণতা স্থায়ী হবে না বলেই আশা করছেন আইনজীবী সেবা রায়। কলকাতা হাইকোর্টে ৪০ বছর ধরে প্র্যাক্টিস করছেন তিনি। বললেন, “মেয়েদের জুনিয়র হিসেবে যে অনেকে নিতে চাইছেন না, সেটা আমার মনে হয় খুবই সাময়িক ব্যাপার। ধীরে ধীরে কেটে যাবে।” একই কথা বলছেন আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, “একটা অনভিপ্রেত ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জেরে আপাতত অনেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। আমার মনে হয় এটা সাময়িক ব্যাপার।”

অভিযুক্ত আর এক বিচারপতিও
অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বিতর্কের জের কাটতে না কাটতেই ফের সুপ্রিম কোর্টের এক প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলেন এক মহিলা ইন্টার্ন। তাঁর অভিযোগ, ঘটনার সময়ে অভিযুক্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদেই ছিলেন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানান ওই ইন্টার্ন। কিন্তু শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, অশোক গঙ্গোপাধ্যায় কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চ সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাক্তন বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করবে না কোর্ট। সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করার কথা ভাবছেন ইন্টার্ন।

(সহ-প্রতিবেদন: কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও কাজল গুপ্ত)

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.