পদত্যাগপত্রেও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করলেন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়।
গত সোমবার বিকেলে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণের সঙ্গে দেখা করে যে সাদা খাম দিয়ে এসেছিলেন অশোকবাবু, সেটাই ছিল তাঁর পদত্যাগপত্র। যদিও তিনি নিজে বা রাজভবন সূত্র, কেউই সে দিনে ইস্তফার কথা স্বীকার করেনি। মঙ্গলবার দুপুরে রাজ্যপাল প্রাক্তন বিচারপতির পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে তা নবান্নে পাঠিয়ে দেন।
দু’পাতার পদত্যাগপত্রের গোড়াতেই অশোকবাবু লিখেছেন, “আমি জোরের সঙ্গে বলছি, সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগের কথা প্রকাশিত হয়েছে, সে সবই প্রমাণরহিত এবং ভিত্তিহীন। সমস্ত অভিযোগ আমি অস্বীকার করছি।” তা হলে তিনি ইস্তফা দিচ্ছেন কেন? চিঠিতেই তাঁর ব্যাখ্যা দিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, প্রথমত, “আমি বিতর্ক আর বাড়াতে চাই না। বরং আমার পরিবারের শান্তি এবং স্বস্তিই নিশ্চিত করতে চাই।” দ্বিতীয়ত, “যদি সম্মান এবং মর্যাদা নিয়ে কাজ করতে না-পারি, তা হলে কোনও পদের প্রতিই আমার টান থাকে না। আমি বুঝতে পারছি, এই পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব নয়।”
পদত্যাগ না-করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকাকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিলেন। বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ায় এখন তাঁর সম্মানহানির চেষ্টা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেও অভিযোগের আঙুল তুলে বলেছিলেন, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর একাধিক সুপারিশ ও মন্তব্য পছন্দ না-হওয়াতেই ক্ষুব্ধ রাজ্যের শাসক দল। এ দিন পদত্যাগপত্রে স্পষ্ট ভাবে না-বললেও সেই অভিযোগের ইঙ্গিত রেখে দিয়েছেন অশোকবাবু।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মহলের একটা বড় অংশেরও অভিযোগ ছিল, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সুষ্ঠু মীমাংসা নয়, তাঁকে সরানোই শাসক পক্ষের মূল উদ্দেশ্য। অশোকবাবুর ইস্তফার খবর জানার পরে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “সরকার যা চেয়েছিল, সেটাই হল। অসহনীয় অবস্থায় মানসিক চাপে পড়েই উনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তো এখন এ রকম হচ্ছে!”
অশোকবাবুর বিরোধীরা অবশ্য মনে করাচ্ছেন যে, সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রাথমিক ভাবে ঠিক বলেই মনে করেছিল। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, অশোকবাবু ওই ইন্টার্নের সঙ্গে অবাঞ্ছিত আচরণ করেছেন বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
তবে ওই ইন্টার্ন কেন এখনও পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেননি, সেই রহস্য কাটছে না। তরুণ তেজপালের ক্ষেত্রে গোয়া পুলিশ যেমন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করেছিল, দিল্লি পুলিশ এ ক্ষেত্রে কেন তেমন কিছু করল না, সেই প্রশ্নও থাকছে। গোটা বিষয়টিই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল অশোকবাবুকে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরানোর লক্ষ্যে। সে জন্য সুপ্রিম কোর্টের তদন্ত চেয়ে রাষ্ট্রপতির নির্দেশের (প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স) ব্যাপারে ছাড়পত্রও দিয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা।
অশোকবাবুর ইস্তফার পরে অবশ্য সেই রেফারেন্সের আর কোনও প্রয়োজন থাকছে না। এ দিন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে নবান্নের কাছে ওই ইস্তফাপত্রের প্রতিলিপি চেয়ে পাঠানো হয়। রাজ্য সরকার এ দিনই তা দিল্লি পাঠিয়ে দিয়েছে। দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মানবাধিকার বিভাগের এক কর্তা বলেন, “বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে। ফলে পদত্যাগপত্রের প্রতিলিপি রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠিয়ে ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে নেওয়া হবে।”
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ইস্তফার পরে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন চলবে কী ভাবে? তিন সদস্যের কমিশনে এখন রইলেন শুধু প্রশাসনিক সদস্য, রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। বিচারবিভাগীয় সদস্যের পদ আগে থেকেই খালি ছিল। এ বার খালি হল চেয়ারম্যান পদ। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা এ দিন জানান, দ্রুত বিচারবিভাগীয় সদস্য নির্বাচন করা হবে। তার পর সময় নিয়ে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হবে। আইন অনুযায়ী কোনও হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি অথবা সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতিই রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারেন। তবে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে কমিশনের কোনও সদস্যকে কাজ চালাতে বলতে পারেন রাজ্যপাল। যদিও সেই কাজের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কমিশনের একমাত্র সদস্য নপরাজিতবাবুকেই রাজ্যপাল দায়িত্ব দিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “কমিশনকে সচল রাখার জন্য সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। মুখ্যমন্ত্রী জেলা সফর থেকে ফিরলেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করা হবে।”
তবে অশোকবাবু আর চেয়ারম্যান থাকছেন না জেনে বেশ খানিকটা মুষড়েই পড়েছেন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের কর্মী-অফিসারদের একাংশ। তাঁদের দাবি, ২০১২-র এপ্রিলে কমিশনে যোগ দেওয়ার পর থেকেই কাজে গতি এনেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১-’১২ সালে যেখানে সারা বছরে মাত্র হাজার পাঁচেক অভিযোগ আসত, ২০১৩-’১৪ (ডিসেম্বর পর্যন্ত) সালে সেই অভিযোগের সংখ্যা সাড়ে ১২ হাজারে পৌঁছেছে। মঙ্গলবারও ৫০ জন অভিযোগকারী প্রতিকার চাইতে মানবাধিকার কমিশনে এসেছিলেন। কমিশনের এক অফিসারের আক্ষেপ, “উনি (বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়) ছাতার মতো ছিলেন। সব সময় আগলে রাখতেন। কমিশনকে একটি উচ্চতায় তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। জানি না এখন কী হবে! ” |