রাজ্যপাল বারণ করেন, তাই চুপ ছিলাম
সোমবার সন্ধ্যায় রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে তাঁর হাতে ইস্তফার চিঠি তুলে দিয়েছিলেন। তার ২৪ ঘণ্টা পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুখ খুললেন অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। বললেন, “মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলাম। আমি বুঝেছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সম্ভব নয়।”
খিদিরপুরের কবিতীর্থ এলাকার তিনতলা ‘কমলাভিলা’-র সদর দরজা, এমনকী সব জানলাও মঙ্গলবার সকাল থেকে বন্ধ ছিল। একতলায় দু’জন নিরাপত্তারক্ষী ঠায় বসেছিলেন। কাউকে ঢুকতে-বেরোতে দেখা যায়নি। অন্য দিন বেলা ১০টা গড়ালেই অশোকবাবু অফিস চলে যান। এ দিন তা-ও হয়নি। সোমবার সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত একটাই জল্পনা ছিল, অশোকবাবু ইস্তফা দিয়েছেন কি দেননি। মঙ্গলবার সকালে অশোকবাবু অফিসে না বেরোনোয় ফের প্রশ্নটা সামনে আসে তবে কি তিনি ইস্তফাই দিলেন?
জল্পনার অবসান হতে এ দিন দুপুর গড়াল। আগের দিন বিভিন্ন মহল থেকে তাঁর ইস্তফার কথা বলা হলেও অশোকবাবু নিজে অথবা রাজভবনের তরফে এই নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করা হয়নি। ফলে বিষয়টা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। মঙ্গলবার শেষ বেলায় বিবৃতি দিয়ে সেই সংশয়ের অবসান ঘটায় রাজ্য সরকার। এর পর তাঁর পদত্যাগপত্রের প্রতিলিপি সংবাদমাধ্যমের হাতে তুলে দেন অশোকবাবু নিজেও। রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র দেওয়ার পরেই কেন জানালেন না? সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির উত্তর, “রাজ্যপাল আমাকে বাইরে কিছু না বলার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এ দিন তিনি ইস্তফা গ্রহণের কথা আমাকে জানিয়েছেন। তাই আমি আপনাদের জানালাম।”
মঙ্গলবার নিজের বাড়িতে অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
বিতর্কের শুরু মাস দুয়েক আগে। তবু ইস্তফা না দিয়ে ‘শেষ দেখে ছাড়ব’ বলে জানিয়েছিলেন অশোকবাবু। তবে পণ ভাঙলেন কেন? এ দিন সন্ধ্যায় বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পেয়ে এই প্রশ্নটা করতেই জবাব এল, “ইস্তফা দেওয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না। দেখলেন না, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী পাপ্পু সিংহকেও চাকরি টিকিয়ে রাখার খাতিরে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হল! তা ছাড়া, এই মানসিক চাপটা সহ্য করাও আমার পরিবারের লোকজনের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়েছিল।”
গত দু’মাস ধরে চাপান-উতোরের শেষে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরে দৃশ্যতই ক্লান্ত লাগছিল অশোকবাবুকে। তবে ভেঙে পড়েননি। বরং অনেক অভিমান-অভিযোগ ঝরে পড়ল তাঁর কথায়। “২০১২ সালের এপ্রিল মাসে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিই। পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলাদিত্য-পর্ব, যাদবপুরের অম্বিকেশ-পর্ব, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলমাল-সহ নানা বিষয়ে রাজ্য সরকারের কাছে একাধিক সুপারিশ করেছি। সরকার সে সব ভাল ভাবে নেয়নি। তাই প্রথম থেকেই সরকারের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়।”
অশোকবাবু অভিযোগ অবশ্য একেবারেই মানতে নারাজ রাজ্যের শাসক দল। দলের সাংসদ ও আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া: “ডাহা মিথ্যে কথা। আসলে সব মহল থেকে তাঁর পদত্যাগ চাওয়া হচ্ছিল। উনি নিজেও জানেন, কী করেছেন। সে সব ঢাকা দিতেই এখন সরকার-বিরোধী কথা বলছেন।” তাঁর বক্তব্য, “যে কোনও মামলায় আদালত সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে রায় দেয়। সরকার সে সব আইনের চোখেই দেখে। এটা কোনও বিচারপতির সঙ্গে ব্যক্তিগত ঝগড়ার বিষয় নয়।”
আপনাকে নিয়ে যে ঘটনা ঘটল, তার জন্য কোনও আইনি পথ নেবেন? মানবাধিকার কমিশনের সদ্য-প্রাক্তন চেয়ারম্যানের জবাব, “একেবারেই না। আমি তো ইস্তফা দিয়েছি। সবাই ভাল থাকুক এটাই আমি চাই।”
দীর্ঘ কর্মজীবনে একাধিক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন অশোকবাবু। অবসরের পরে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন। পাশাপাশি ছিল সল্টলেকের আইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজ। সেখান থেকে আগেই ইস্তফা দিয়েছিলেন। আজ, বুধবার থেকে মানবাধিকার কমিশনের ব্যস্ততাও আর থাকবে না। সারা দিন কী ভাবে কাটাবেন?
একটু অন্যমনস্ক মনে হল তাঁকে। পর ক্ষণেই সামলে নিয়ে বললেন, “কয়েক হাজার বই রয়েছে। সে সব উল্টেপাল্টে দেখব। বাড়িভর্তি ফুলগাছ রয়েছে, যত্নআত্তি করব। আমাদের এত বড় পরিবার। সকলের সঙ্গে আরও অনেক বেশি সময় কাটাতে পারব।”



মান্যবরেষু,
আমি জোরের সঙ্গে বলছি, সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগের কথা প্রকাশিত হয়েছে, সে সবই প্রমাণরহিত এবং ভিত্তিহীন। সমস্ত অভিযোগ আমি অস্বীকার করছি। মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আমার অপসারণ চেয়ে যে সুপারিশ গিয়েছে, আমার মতে, তা পুরোটাই ভ্রান্ত ধারণা এবং অসমর্থিত তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কিন্তু আমি বিতর্ক আর বাড়াতে চাই না। বরং আমার পরিবারের শান্তি এবং স্বস্তিই নিশ্চিত করতে চাই। আমি বিচারপতির উচ্চ পদের দায়িত্ব সামলেছি এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছি। এই কথা মাথায় রেখে এবং আমি সম্ভবত আমার কাজের ক্ষেত্রে যে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পেরেছি, সে কথা বিনয়ের সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলাম। এই মুহূর্ত থেকে আমি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিচ্ছি।
যদি সম্মান এবং মর্যাদা নিয়ে কাজ করতে না পারি, তা হলে কোনও পদের প্রতিই আমার টান থাকে না। আমি বুঝতে পারছি, এই পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব নয়।
অতএব মানবাধিকার সুরক্ষা আইন ২৩ (১) ধারা অনুযায়ী এই চিঠি আমার ইস্তফার নোটিস বলে গণ্য করা হোক।
একটা কথা শুধু পরিষ্কার করে বলতে চাই। আমার বিরোধীদের কারও প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই। আমি তাঁদের সকলের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী।
আপনার কাছে ধারাবাহিক ভাবে যে সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার পেয়ে এসেছি, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।


আপনার বিশ্বস্ত
অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.