সোমবার রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বৈঠক করলেন প্রাক্তন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়। আর তার পরেই রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে তাঁর ইস্তফা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে উঠল। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বা রাজভবন সূত্র কোনও পক্ষ থেকেই অবশ্য সোমবার রাত পর্যন্ত ইস্তফার খবর স্বীকার করা হয়নি।
তবে প্রাক্তন বিচারপতির ঘনিষ্ঠ একটি মহল থেকে বলা হচ্ছে, অশোকবাবু এ দিন একটি সাদা খাম রাজ্যপালের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, মানবাধিকার কমিশনের কাজ করতে তাঁকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁর ইস্তফা দেওয়াই ভাল। বস্তুত, আনন্দবাজারের প্রশ্নের উত্তরেও এ দিন এমন কথা বলেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
এক ইন্টার্নের আনা যৌন হেনস্থার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ইস্তফা চেয়ে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ ক্রমেই বাড়ছিল। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাও তাঁর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের তদন্ত চেয়ে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সে’ ছাড়পত্র দিয়েছে। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দায়ের করা জনস্বার্থ মামলাও এ দিন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
পদত্যাগে অনড় অশোকবাবু অবশ্য এত দিন ‘শেষ দেখে ছাড়ার’ কথাই বলছিলেন। সোমবারও তিনি নিয়মমাফিক ভবানী ভবনে মানবাধিকার কমিশনের অফিসে যান। কেশপুরের এক শিক্ষিকার আবেদনের ভিত্তিতে জেলা স্কুল পরিদর্শকের কাছে রিপোর্ট তলব করেন। বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ কমিশনের দফতর থেকে বেরিয়ে তিনি রাজভবনে যান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর সচিব লাইমা চোজা। রাজ্যপালের সঙ্গে অবশ্য তাঁর একান্তেই আলোচনা হয়। রাজভবন থেকে বেরিয়ে খিদিরপুরে নিজের বাড়িতে ফিরে যান অশোকবাবু। |
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় রাজভবনে যাওয়ার পরে তাঁর ইস্তফা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে ওঠে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়ে দেয় তিনি পদত্যাগ করেছেন। প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল সোলি সোরাবজিও সংবাদ সংস্থাকে বলেন, “এটা ভাল যে উনি আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলার পরের দিনই ইস্তফা দিয়েছেন।” কিন্তু আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ইস্তফার জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “যার যা ইচ্ছা বলে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম তো ঘোষণা করে দিয়েছিল যে, আমি ইস্তফা দিতে চেয়ে সোলি সোরাবজিকে চিঠি দিয়েছি। কেউ কি সেই চিঠি দেখাতে পারবেন? সমস্ত মিথ্যে কথা। কিন্তু আমি তো কাউকে কিছু বলা থেকে আটকাতে পারি না।”
তিনি রাজ্যপালের কাছে কেন গিয়েছিলেন, এই প্রশ্নে অশোকবাবুর জবাব, “রাজ্যপাল আমার বন্ধু মানুষ। কিছু কথা বলতে যেতেই পারে। আলোচনা থাকতে পারে।” ইস্তফার বিষয়টি তাঁর বিবেচনায় রয়েছে কি না জানতে চাওয়া হলে প্রাক্তন বিচারপতির মন্তব্য, “সে রকম কিছু হলে আমি নিজেই সবাইকে জানাব। এখনও সেটা ঘোষণার প্রশ্ন আসছে না। আর কিছু ব্যাপারে বাধানিষেধও থাকে। রাজ্যপালের কিছু অনুরোধ আমাকে মানতে হবে।” নবান্ন সূত্রেও বলা হচ্ছে, অশোকবাবুর সঙ্গে রাজ্যপালের কী কথা হয়েছে, বা তিনি কী চিঠি দিয়েছেন, রাত পর্যন্ত তা রাজভবন থেকে জানানো হয়নি।
অশোকবাবুর ঘনিষ্ঠ মহলের একটি বড় অংশ কিন্তু বলছেন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে এ দিন ইস্তফাই দিয়ে দিয়েছেন তিনি। ওই সূত্রের মতে, গত সপ্তাহের শেষে ব্যক্তিগত সফরে দিল্লি গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ কর্তাদের মনোভাব আঁচ করার চেষ্টা করেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু কোনও মহল থেকেই তাঁর পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস পাননি। উল্টে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, স্বেচ্ছায় পদ না-ছাড়লে তাঁকে ইমপিচ পর্যন্ত করা হতে পারে। যা তাঁর পক্ষে সম্মানজনক হবে না। এর পরেই অশোকবাবু ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের মত। সেই মতো আজ সকালে দিল্লি থেকে ফিরে দেখা করেন রাজ্যপালের সঙ্গে।
অশোকবাবুর ইস্তফার খবর প্রচার হওয়ার ফলে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ওকে (বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়) যে ভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হল, তাতে আমি দুঃখিত। এ রকম না-হলেই ভাল হতো।” আর লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “ভারত যে আইনের দেশ, এই ঘটনার পরে তা আর বলা যাবে না।”
এর বিপরীত মতের লোকের সংখ্যাও অবশ্য কম নয়। তৃণমূল সাংসদ তথা আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা প্রথম থেকেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করছিলাম। উনি আগে তা করলে ভাল হতো।” অশোকবাবুর বিরুদ্ধে সরব হয়ে অভিযোগকারী ইন্টার্নের বয়ান প্রকাশ্যে আনা অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ইন্দিরা জয়সিংহও বলেছেন, “ইস্তফা আরও আগে দেওয়া হলেই ভাল হতো।”
অশোকবাবু ইস্তফা দিয়েছেন না দেননি, তা নিয়ে ধোঁয়াশা না-কাটলেও ওই পদে কাজ করতে যে তাঁর অসুবিধা হচ্ছে, সে কথা এ দিন নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন তিনি। বুঝিয়েছেন, সে জন্য ইস্তফার বিষয়টিও তাঁর ভাবনায় রয়েছে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “কমিশনের কাজ যে ভাবে করতে চাইছি, সেটা এখন করা যাচ্ছে না। অনেক বাধা আসছে। এর থেকে অবসর নেওয়া ভাল হবে। তবে আমি ভয় পেয়ে পিছু হঠছি ভাবলে ভুল হবে।”
ঘটনাচক্রে এ দিন সকালেই অশোকবাবুর অপসারণের জন্য শুরু হওয়া সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ চেয়ে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলা খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত বলেছে, প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার সরকারের রয়েছে। এই মামলার সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই বলে দাবি করলেও এই রায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পক্ষে বড় ধাক্কা বলেই মনে করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক অতিরিক্ত সচিব এ দিন ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, সর্বোচ্চ আদালত থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যে স্বস্তি পাবেন না, সেটা তাঁর জানা ছিল। বস্তুত, যে ধরনের অভিযোগ ও তথ্যপ্রমাণ অশোকবাবুর বিরুদ্ধে রয়েছে তাতে তাঁর নিস্তার পাওয়া মুশকিল।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য এ দিন বলেন, “যে মহিলা ইন্টার্নকে নিয়ে এত কিছু, মজার কথা, তিনি নিজে এখনও পর্যন্ত কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। যদি ভবিষ্যতে তিনি সেটা করতে পারেন, তা হলে আইনি লড়াইয়ের পথেই যাব।”
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের অলিন্দে তাঁর জন্য কোনও স্বস্তি অপেক্ষা করছে না বুঝেই অশোকবাবু পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আইনজীবী মহলের একটি বড় অংশের মত। জাতীয় বা রাজ্যস্তরের মানবাধিকার কমিশনের পদ থেকে চেয়ারম্যান বা কোনও সদস্যকে অপসারণের বিষয়ে মানবাধিকার আইন (১৯৯৩)-এর ২৩ নম্বর ধারায় বলা রয়েছে, অযোগ্যতা বা অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে চেয়ারম্যান বা কোনও সদস্যকে একমাত্র রাষ্ট্রপতিই অপসারণ করতে পারেন। তার আগে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে (প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স) সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্ট সদস্য বা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দেখবে। তার পর সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতিকে রিপোর্টে জানাবে যে তাঁকে অপসারণ করা উচিত হবে কি না। মানবাধিকার আইনের ৫(২) ধারায় অবশ্য এ-ও বলা হয়েছে যে, কমিশনের কোনও সদস্য বা চেয়ারম্যানকে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টকে তদন্তের নির্দেশ দেবেন কি না, সে ব্যাপারে তাঁকে মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিতে হবে।
কিন্তু এই প্রক্রিয়া শুরুর আগে সুপ্রিম কোর্টের যে তিন সদস্যের কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেছিল, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইতিমধ্যেই প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়েছেন অশোকবাবু। এবং সেই সূত্র ধরে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, ওই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের অনুমোদন দেওয়া যায় না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অবশ্য রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো নোটে বলেছে, প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের আগে কোনও আইনি তদন্তের প্রয়োজন নেই। প্রাথমিক ভাবে পাওয়া তথ্যপ্রমাণ ও নথি দেখে রাষ্ট্রপতি সন্তুষ্ট হলেই চলবে। এ ক্ষেত্রে সেটাও করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি মহলের যুক্তি, তদন্ত কমিটি বৈধ না অবৈধ, সেটা বিতর্ক-সাপেক্ষ। কিন্তু ওই কমিটি যে অশোকবাবুর বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ প্রাথমিক ভাবে সঠিক বলে মনে করেছে, সেটাও উপেক্ষা করার নয়।
|