বাস ধর্মঘটে সাধারণ মানুষের যে দুর্ভোগ হবে, জানাই ছিল। হলও তাই। তার পরেও ভাড়া না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনড় রইল রাজ্য সরকার।
রাজ্য জুড়ে সোমবারের এই ধর্মঘট রুখতে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বেসরকারি বাসের পারমিট বাতিলের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। এ দিন সকালে পথে নেমে মানুষের দুর্ভোগের ছবিটা নিজের চোখে দেখার পরে হুঁশিয়ারি দিলেন, পথে না-নামা বাসগুলিকে আটক করা হবে। আবার, শহরতলির কোনও কোনও এলাকায় বাস নামাতে শাসক দলের সমর্থকদের চাপও ছিল। তবু ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে বেসরকারি বাস-মিনিবাস মালিকদের ডাকা ধর্মঘট হল প্রায় সর্বাত্মক। যে ধর্মঘটে যোগ দিল বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট, যারা এর আগে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে ধর্মঘট বানচাল করেছে। দিনের শেষে বাস মালিকরা বলেন, “দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে বলেই যে সবাই এককাট্টা, ধর্মঘটের চেহারাই তা স্পষ্ট করেছে। হুমকি, জোর-জবরদস্তি সত্ত্বেও বাস নামাইনি।”
গত প্রায় দেড় বছরে কয়েক দফায় ডিজেলের দাম বেড়েছে লিটার প্রতি আট টাকা। তবু অর্থনীতির সহজ অঙ্ক মেনে বাসভাড়া বাড়াতে রাজি হয়নি সরকার। এ দিনের পরেও সরকার যে তার অবস্থান বদলাচ্ছে না, সে কথা স্পষ্ট জানিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “সরকারের ভাড়া বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। এখন ভাড়া বাড়ানোয় অসুবিধে রয়েছে।” তাঁর দাবি, “যে ভাড়া আছে, সেটা খারাপ নয়।” |
ঘটনা হচ্ছে, ক্রমাগত জ্বালানির দাম বাড়ায় বাস ভাড়া বাড়ানো যে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, সেটা পরিবহণ দফতরের অনেকেই মানেন। তা হলে রাজ্য কেন সেই পথে পা বাড়াচ্ছে না? পরিবহণ দফতর সূত্রেই বলা হচ্ছে, মাস পোহালে লোকসভা ভোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বাস ভাড়া বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্তের ঝুঁকি নিতে চাইছে না সরকার। তাদের আশঙ্কা, এর ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হতে পারে। পরিবহণ ব্যবস্থার রুগ্ণ দশা কাটাতে তা হলে কী ভাবছে সরকার? সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, আগামী মাসেই জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন (জেএনএনইউআরএম) প্রকল্পে প্রায় হাজারখানেক বাস পাচ্ছে রাজ্য। তার মধ্যে একটি বড় অংশ হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বা এসি বাস। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জানান, বাসের ভাড়া না বাড়ায় গত দু’বছরে বহু বাস বসে গিয়েছে। সরকারি বাসও কমে গিয়েছে অর্ধেক। কলকাতা-সহ শহরতলি এলাকায় বাসের এই আকাল এবং সেই কারণে যাত্রী দুর্ভোগের বিষয়টি চোখ এড়ায়নি প্রশাসনের কর্তাদের। তাই জেএনএনইউআরএম-এর বাসের পাশাপাশি কিছু ঝাঁ-চকচকে ‘লাক্সারি’ বাসও পথে নামানোর পরিকল্পনা করেছে পরিবহণ দফতর।
অনেকেই বলছেন, এর ফলে ঘুরপথে ভাড়া বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে সরকার। কী ভাবে? পুরনো বাস বসে গেলে সেই জায়গায় যদি এসি এবং লাক্সারি বাস নামে, তার ভাড়া তো বেশিই হবে। ফলে তখন সাধারণ মানুষকে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে। সরকারি সূত্রে কেউ কেউ বলছেন, একই ভাবে ঘুরপথে দুধের দাম বাড়িয়েছিল সরকার। সরকারি ভাবে বলা হয়েছে, দাম বাড়বে না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দামি ব্র্যান্ডের দুধ এনে কম দামিটি ধীরে ধীরে বাজার থেকে তুলে নিয়েছে তারা। বিদ্যুতের বেলাতেও প্রায় একই ঘটনা। প্রকাশ্যে কোনও ঘোষণা হয়নি। কিন্তু ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত চুপচার ছ’দফায় বিদুতের দাম বাড়িয়েছে বিদ্যুৎ দফতর।
প্রশ্ন উঠেছে, একই ভাবে পরিবহণের ক্ষেত্রেও উন্নত মানের পরিষেবা দেওয়ার যুক্তিতে কি ভাড়া বাড়ানোরই পথ নিচ্ছে না সরকার? |
পরিবহণমন্ত্রী অবশ্য এই নিয়ে সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ভাল পরিষেবা পেলে বেশি ভাড়া দিতে তো মানুষের আপত্তি নেই। আমরা এখন শুধু বাসের সংখ্যা বাড়াতে চাই।” তা হলে সাধারণ বাসের ভাড়া বাড়ালেই তো বসে যাওয়া বাস রাস্তায় নামতে পারে? মদনবাবু এই প্রশ্নেরও জবাব দেননি। বরং লোকসভা ভোটের আগে এ দিনের বাস ধর্মঘটকে ‘সরকার-বিরোধী চক্রান্ত’ বলেই অভিহিত করেছেন মন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “সব কিছুর মধ্যেই চক্রান্ত রয়েছে। এ হল একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা।” তবে তাঁর দাবি, “এ দিন সরকারি বাস, অটো, ট্যাক্সি চলেছে। এতেও মানুষের হয়তো অসুবিধে হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক পরিবহণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়নি।” বাস মালিকদের প্রতি তাঁর হুমকি, “পারমিট বাতিল, গাড়ি আটক, সবই হবে। যাঁরা বাস চালাতে পারছেন না বলছেন, তাঁরা পারমিট ফিরিয়ে দিন। অনেকে বাসের পারমিট নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।”
দিনের শেষে মন্ত্রীর এই অনড় মনোভাবের কথা জেনে ‘সর্বাত্মক ধর্মঘট’ দাবি করেও তাঁদের হতাশা গোপন করেননি বাস মালিক সংগঠনের নেতারা। জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটসের নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের নেতা দীপক সরকার বলছেন, “সব রকম ভাবে আমাদের শেষ করার ফন্দি এঁটেছে সরকার। এতে সাধারণ মানুষেরই বেশি ক্ষতি হচ্ছে।” তাঁদের বক্তব্য, “মানুষের উপরে বোঝা বাড়বে বলে ভাড়া না বাড়ানোর যুক্তি দিচ্ছে সরকার। অথচ বাস্তবে কিন্তু অনেক বেশি ভাড়া দিয়েই সাধারণ মানুষকে যাতায়াত করতে হচ্ছে। বাস না থাকায় পাঁচ বার অটো পাল্টে যাতায়াত করতে হচ্ছে।”
মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা অবশেষ দাঁ-র মতে, “এই মন্ত্রীই কিছু দিন আগে বলেছিলেন, বেসরকারি বাসের আয় বাড়াতে অন্য পন্থা খুঁজবে সরকার। পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে খারাপ হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রী বলছেন, বাস চালিয়ে নাকি লাভ হচ্ছে! এ থেকেই বোঝা যায়, সরকার এখন আর গণ-পরিবহণ নিয়ে চিন্তিত নয়।”
এর পরে কী করবেন বাস মালিকরা? তপনবাবুরা জানান, আগামী ১০ জানুয়ারি সব সংগঠন একসঙ্গে বৈঠকে বসে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বাস সংগঠনগুলির সঙ্গে সরকার আলোচনায় বসবে কি না, তাই নিয়ে মদনবাবু কিছু বলেননি।
|