আশঙ্কা কাটছে না সরকারি আশ্বাসেও
আজ ভোগান্তির পূর্বাভাস দিয়ে আগেই উধাও বাস
শীতের রবিবাসরীয় বিকেলের আমেজ গায়ে মাখতে যাঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন, তাঁরা ফাঁপরে পড়লেন ফেরার পথে। বিকেল গড়াতে না-গড়াতেই কলকাতার পথে বাসের সংখ্যা তলানিতে গিয়ে ঠেকল। বেসরকারি বাস-মালিকদের পাঁচটি সংগঠনের ডাকে আজ, সোমবার রাজ্য জুড়ে বাস ধর্মঘট। তার আগে, রবিবার দুপুরেই রাস্তা থেকে কার্যত উবে গেল বাস। যাকে ধর্মঘট সফল হওয়ার আগাম ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছেন বাস-মালিকেরা। “ভাড়া না বাড়তে বাড়তে এখন আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। রবিবারের পথের ছবি সেটাই প্রমাণ করছে।” বলছেন তাঁরা। এবং মালিকদের হুঁশিয়ারি, দার্জিলিং থেকে সুন্দরবন সোমবার পশ্চিমবঙ্গের কোথাও বেসরকারি বাসের চাকা গড়াবে না।
রাজ্য সরকার অবশ্য এখনও অবিচল। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের দাবি, “ধর্মঘটের রাস্তা এ রাজ্যে ভুল পথ।” বাস ধর্মঘটের প্রভাব যাতে সাধারণ জীবনযাত্রায় না পড়ে, সে ব্যবস্থা সরকার করবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। যদিও রাজ্য পরিবহণ দফতরের কর্তারা মন্ত্রীর মতো এতটা আশাবাদী হতে পারছেন না। বরং তাঁদের অভিমত, শুধু সরকারি বাস দিয়ে বেসরকারি বাস-মিনিবাস ধর্মঘটের মোকাবিলা করা কখনওই সম্ভব নয়। “গত বার বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট ধর্মঘটে সামিল হয়নি। তাদের সাহায্যে পরিস্থিতি সামলানো গিয়েছিল। এ বার তা-ও হবে না।” বলছেন এক পরিবহণ-কর্তা। পুলিশ-সূত্রে বলা হয়েছে, সাধারণ বন্ধের মতো সোমবার ভোর থেকে শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। তারা দেখবে, যাতে জবরদস্তি বাস বন্ধ করা না হয়।
রবিবার ছুটির দিনেও বাসের অভাবে ভোগান্তি মহানগরে।—নিজস্ব চিত্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় এসেই জানিয়ে দিয়েছিল, বাসের ভাড়া বাড়ানো হবে না। ডিজেল ও যন্ত্রাংশের দাম দিন দিন মহার্ঘ হলেও সিদ্ধান্তটি বহাল থেকেছে। ফলে বহু বেসরকারি বাসের মালিক ক্ষতি সামলাতে না পেরে বাস তুলেই নিয়েছেন। সরকারি পরিবহণ নিগমগুলোর হালও তথৈবচ। তাদের বোঝার ভার বাড়িয়েছে বাড়তি কর্মীর চাপ। অর্থাভাবে বিভিন্ন পরিবহণ নিগমের বিস্তর বাস রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। যে ক’টি চলছে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলোও লজ্ঝড়ে। সব মিলিয়ে আমজনতার ভোগান্তির একশেষ। রাস্তায় বেরিয়ে বাস না-পেয়ে বহু নিত্যযাত্রীকে রিকশা-অটো-ট্যাক্সি-মেট্রো ইত্যাদিতে যাত্রাপথ ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। ফলে পকেটে বাড়তি চাপ পড়ছে। হিসেব কষে অনেকেই দেখেছেন, মালিকদের দাবি মতো বাসে উঠে বাড়তি ভাড়া গুণতে হলেও খরচ তুলনায় কম হত। ঝক্কিও এত পোহাতে হত না।
এবং পরিষেবার যথাযথ দাম না-নেওয়ার এ হেন ‘জনপ্রিয়’ সরকারি নীতি পরিবহণের মেরুদণ্ডই ভঙ্গুর করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে বাস-মালিক থেকে সাধারণ মানুষ, এমনকী খোদ সরকারেরও অন্দরমহলে। ‘নিরাপত্তা’র যত বন্দোবস্তই হোক, সরকারবন্ধু বাস-মালিকেরাও (বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট) এ বার ভাড়াবৃদ্ধির আন্দোলনে সর্বাত্মক ভাবে সামিল হয়ে যাওয়ায় সোমবার পথে কত বাস আদৌ নামবে, তা নিয়ে প্রশাসনের মধ্যেই বিস্তর সংশয়। বস্তুত পরিবহণ-কর্তাদের একাংশের অনুমান, আজ আমনাগরিকের জন্য বিস্তর পথ-ভোগান্তি বরাদ্দ রয়েছে।
কোথায় কত
দূরত্ব মুম্বই
ভাড়া

ভাড়া
চেন্নাই
ভাড়া
এখন ভাড়া দাবি
০-৪ কিমি ৬-৮ ৩-৫
৪-৮ কিমি ১০
৮-১২ কিমি ১২-১৬ ৭-৮ ১০
১২-১৬ কিমি ১৫
১৬-২০ কিমি ২০-২৪ ৯-১০ ১২
২০-২৪ কিমি ১৫
* বাস ভাড়ার অঙ্ক টাকায়
পাশাপাশি সরকারি পরিবহণের হাল সম্পর্কে সরকারের যা হিসেব, তা তাঁদের আশঙ্কাকেই জোরদার করছে। কী রকম?
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি পরিবহণ নিগম পাঁচটি। এর মধ্যে কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম (সিএসটিসি)-এর বাস চলে সবচেয়ে বেশি। পরিবহণ দফতর সূত্রের তথ্য বলছে, ২০১১-১২ অর্থবর্ষে সিএসটিসি-তে ৭২৪টি বাস ছিল। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষের শেষে সংখ্যাটা এসে ঠেকেছে ৩৮০-তে! তারও আবার অর্ধেকের বেশি লজ্ঝড়ে। বাস কমেছে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম (এনবিএসটিসি)-তেও। ৪৬৪ থেকে ৪৪১। উপরন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার অধিকাংশের হাল এত জীর্ণ যে, এক সঙ্গে কখনওই গড়ে চারশোর বেশি বাস নামানো যায় না। দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ (এসবিএসটিসি)-এর হালও তথৈবচ। তাদের ৩৫৫টি বাসের মধ্যে আজ বড়জোর ৩২০টি চালানো যাবে। এ ছাড়া কলকাতা ট্রাম কোম্পানি (সিটিসি)-তে ২১১টি বাস রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ভূতল পরিবহণ নিগম (ডব্লিউবিএসটিসি)-এ ১২৫টি।
অর্থাৎ, সরকারি হিসেবেই আজ খুব বেশি হলে সারা রাজ্যে হাজার দেড়েক সরকারি বাস নামতে পারে। যেখানে বেসরকারি বাস-মিনিবাসের সংখ্যা অন্তত ৬৬ হাজার। ৬৬ হাজারের ঘাটতি যে ১৫০০ দিয়ে পূরণ করা অসম্ভব, পরিবহণ দফতরের তাবড় কর্তারা তা একপ্রকার মেনে নিয়েছেন।
সব মিলিয়ে দুর্ভোগের সম্ভাবনা প্রকট। রবিবারের পথ-ছবিতে যেন তারই আঁচ। একেই বাসের দেখা নেই, তার উপরে এ দিন পথে অটোও ছিল তুলনায় কম। কারণ গ্যাসের দাম বাড়ায় কিছু অটো এ দিন রাস্তায় নামেনি। পরিণামে যাত্রী-ভোগান্তির পারদ আরও চড়েছে। বেসরকারি বাস-মালিকদের অন্যতম সংগঠন ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটস’-এর তপন বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “কাল ধর্মঘট কতটা সফল হবে, আজই তা মালুম হয়েছে। জেলা থেকে কলকাতায় বাস ঢোকা বন্ধ হয়ে গিয়েছে রবিবার দুপুরেই।” মিনিবাস-মালিকদের সংগঠন ‘মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটি’র অবশেষ দাঁ’র মন্তব্য, “বাস চালিয়ে লাভ হচ্ছে না। দেনার বোঝা ক্রমশ বাড়ছে। ধর্মঘটে যাওয়া ছাড়া উপায় কী?”
অবশেষবাবুর আক্ষেপ, “গ্যাসের দাম যখনই বাড়ে, অটোরিকশা মর্জিমাফিক ভাড়া বাড়িয়ে নেয়। আমাদের কিন্তু সরকারের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। অথচ বাসের জ্বালানি-যন্ত্রাংশের দাম দিন দিন বাড়লেও সরকার নির্বিকার।”
অক্টোবরে পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরে দেশের বিভিন্ন শহরের বাসভাড়ার তালিকা মালিকদের তরফে তাঁকে পেশ করা হয়েছিল। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের নেতা দীপক সরকার এ দিন বলেন, “আমরা তো অন্য শহরের ভাড়ার তালিকাও মন্ত্রীকে জমা দিয়েছি। সে সব বিচার করে মন্ত্রী এখন দেখুন না, আমরা কত পিছিয়ে!” জয়েন্ট কাউন্সিলের তপনবাবুর অভিযোগ, “সরকার বাস্তব পরিস্থিতিটা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। শুধু মাত্র রাজনৈতিক কারণে ভাড়া বাড়াচ্ছে না।” তাঁর দাবি, “মুম্বইয়ে সরকারি বাসের ভাড়া আগামী মার্চে কত হবে, তা এখনই ওখানকার রাজ্য সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে। প্রতি ধাপে দু’-তিন টাকা করে ভাড়া বাড়বে। এখানে যে-কে-সে-ই!”
দীপকবাবুদের যুক্তি, “সরকারি বাস ভর্তুকি পায়। আমরা তা-ও পাই না। ভাড়া না-বাড়লে চলবে কী করে?” এ অবস্থা চলতে থাকলে পশ্চিমবঙ্গে অচিরেই পরিবহণ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা বেসরকারি বাস সংগঠনগুলির।

পুরনো খবর




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.