মঙ্গলবার তখন বেলা এগারোটা বেজে গিয়েছে। হন্তদন্ত হয়ে ভবানী ভবনের তিনতলায় পৌঁছালেন নদিয়ার ডিএসপি (সদর) ও নাকাশিপাড়া থানার ওসি।
একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন দু’সপ্তাহ আগে তাঁদের সমন পাঠিয়ে জানিয়েছিল, এ দিন তার শুনানি। সেখানে দু’জনকে হাজির থাকতে হবে। সেই মতো দুই পুলিশ অফিসার ডিএসপি দিব্যজ্যোতি দাস আর ওসি মানস চৌধুরী এ দিন ভবানী ভবনে কমিশনের অফিসে আসেন। কমিশনের রেজিস্ট্রার রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ঘরে ঘণ্টা দুয়েক বসে থাকার পরে তাঁরা জানতে পারেন, শুনানি-ই হবে না। কেন?
কারণ, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান-পদে বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইস্তফা এ দিন গৃহীত হওয়ায় কমিশন পরিণত হয়েছে এক সদস্যের সংস্থায়। সেই একমাত্র সদস্য হলেন রাজ্য পুলিশের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়, যিনি একা কোনও শুনানি করতে পারবেন না। কেননা ‘কোরাম’ না-হলে কমিশনের পক্ষে শুনানি করা সম্ভব নয়। আর কোরামের জন্য ন্যূনতম দু’জন সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন।
অতএব, রাজ্য মানবাধিকার কমিশন এই মুহূর্তে কার্যত ঠুঁটো হয়ে পড়েছে। নতুন সদস্য নিয়োগ না-হওয়া পর্যন্ত একমাত্র সদস্য হিসেবে নপরাজিতবাবু বড়জোর কোনও অভিযোগ গ্রহণ করতে পারবেন। কিংবা কোনও ঘটনা সম্পর্কে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে পুলিশ-প্রশাসনের রিপোর্ট তলব করতে পারবেন, নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে। তার বেশি কিছু নয়। কোনও ঘটনায় অভিযুক্ত ও অভিযোগকারীর বক্তব্য নথিবদ্ধ করা যাবে না। শুনানি না-হলে কমিশনের পক্ষে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করাও অসম্ভব।
অর্থাৎ, কমিশনে জমা পড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের যাবতীয় অভিযোগ সদস্য তথা শুনানির অভাবে অমীমাংসিতই থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা। যেমন আজ, বুধবার দু’টো পৃথক ঘটনার শুনানির জন্য শ্রীরামপুরের এসডিপিও ও বালি থানার আইসি এবং কাকদ্বীপের এসডিপিও ও কাকদ্বীপ থানার ওসি-কে তলব করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই শুনানিও হবে না। কবে হবে, কমিশনের প্রশাসনিক কর্তারাও তা জানেন না। রাজ্য সরকারের তরফে অবশ্য যত দ্রুত সম্ভব অচলাবস্থা নিরসনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “পরিস্থিতিটা একেবারেই সাময়িক। অতি দ্রুত এক জন প্রাক্তন বিচারপতিকে কমিশনের সদস্য করা হবে।”
মুখ্যমন্ত্রী জেলা সফর সেরে কলকাতায় ফিরলেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র-সচিব। চেয়ারম্যান নিয়োগ অবশ্য সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কিংবা সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ছাড়া কেউ ওই পদের যোগ্য নন। উপরন্তু চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়টিকে রাষ্ট্রপতির দরবার ঘুরিয়ে আনার প্রথা রয়েছে। ফলে সময় লেগে যায়। কিন্তু চেয়ারম্যান না-থাকলেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হল কেন? কেন তিন সদস্যের কমিশনে টিকে রইলেন সাকুল্যে এক জন?
প্রশাসনিক সূত্রের ব্যাখ্যা: ২০০৬-এ মানবাধিকার আইন সংশোধনের পরে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান-সহ তিন সদস্যের সংস্থায় পরিণত হয়েছে। বিচারবিভাগের প্রতিনিধি প্রাক্তন বিচারপতি নারায়ণ শীল গত ১ নভেম্বর অবসর নিয়েছেন। তাঁর জায়গায় এখনও কেউ আসেননি। ফলে প্রাক্তন মুখ্যসচিব সৌরীন রায়ের জায়গায় গত ১৮ নভেম্বর যোগ দেওয়া রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি নপরাজিতবাবুই আপাতত কমিশনের একমাত্র সদস্য। পাশাপাশি তিনিই রাজ্যের প্রথম অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ-কর্তা, যিনি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হয়েছেন।
এবং কমিশনের একমাত্র সদস্য হিসেবে পুলিশের প্রাক্তন ডিজি’র কাছে পুলিশেরই বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন অভিযোগ কতটা গুরুত্ব পাবে, কমিশনের অন্দরমহলে সে সংশয় কিছুটা হলেও দানা বেঁধেছে। নিছক পুলিশি রিপোর্ট তলব করার ব্যাপারেও তিনি সে ভাবে উদ্যোগী হবেন কিনা, তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। এ হেন পরিস্থিতির সরাসরি সমালোচনাও করেছেন কেউ কেউ। কী রকম?
যেমন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান, বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় বলছেন, “কমিশন এখন অকেজো হয়ে পড়ল।” আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের আক্ষেপ, “মানবাধিকার কমিশন এখন পুরোপুরি রাজ্য সরকারের হাতের পুতুলে পরিণত হল।” মানবাধিকারকর্মী সুজাত ভদ্রের মন্তব্য, “মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে কোনও প্রাক্তন পুলিশকর্তার মনোনয়নের বিরোধিতা আমরা বরাবর করে এসেছি। এমন ব্যক্তি স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে চাইবেন না।”
নপরাজিতবাবু কী বলেন? একমাত্র সদস্য তথা প্রাক্তন পুলিশকর্তা হিসেবে কমিশনের কাজ চালিয়ে যেতে তাঁর কি কোনও সমস্যা হতে পারে?
প্রাক্তন ডিজি’র জবাব, “এ ব্যাপারে কিছুই বলব না। যা জিজ্ঞেস করার, রাজ্য সরকারকে করুন।” |