নীল-সাদা কাপড়ে বাঁধা মঞ্চ। মাঠ জুড়ে বাঁশের ব্যারিকেড, সিসিটিভি। গোটা এলাকা পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। ঘরোয়া মেজাজে দু’-দশ জন সাধারণ মানুষকে কাছে টেনে দু’টো কথা বলার সুযোগ মেলাই ভার। সব দেখেশুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মুখ্যমন্ত্রীর।
মঙ্গলবার একদা মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি বেলপাহাড়ির আমলাশোলে এলাহি প্রশাসনিক আয়োজন দেখে ক্ষুব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে তো উঠলেনই না, পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের রীতিমতো ধমকও দিলেন। তার পর মাঠে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে জনতাকে বললেন, “এখানে মিটিং করতে আসিনি। জায়গাটা দেখতে এসেছি। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।” জনতার সঙ্গে তাঁর ব্যবধান তখন বড়জোর ফুট পনেরো। এর পর সেটুকুও আর রাখলেন না মমতা। নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে ঢুকে পড়লেন জনতার মাঝে। তখন তিনি যেন মুখ্যমন্ত্রী নন, সকলের দিদি।
আমলাশোলে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর মূল কর্মসূচি ছিল নতুন রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের শিলান্যাস। ‘ফার্ম নেট’ নামে এই প্রকল্পে প্রত্যন্ত গ্রাম ও চাষের জমি থেকে মূল সড়কের সঙ্গে সংযোগকারী রাস্তা তৈরি হবে। এ দিন কাঁকড়াঝোর থেকে আমলাশোল ১ কিলোমিটার ঢালাই রাস্তা তৈরির শিলান্যাস করে প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। জানান, গোটা রাজ্যে ৩,৩৪৯টি গ্রামে ১৬ হাজার কিলোমিটার রাস্তা হবে। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ কদমডিহায় নামে মুখ্যমন্ত্রীর কপ্টার। তার পর গাড়িতে কাঁকড়াঝোর পৌঁছন তিনি। সেখানে ‘ফার্ম নেট’ প্রকল্পের শিলান্যাস সেরে গাড়িতেই যান আমলাশোল। গ্রামের ফুটবল মাঠে তখন হাজার মানুষের ভিড় জমেছে। |
রাস্তায় আসতে আসতে দু’ধারে ব্যারিকেড দেখেই কিছুটা ভুরু কুঁচকেছিল মুখ্যমন্ত্রীর। আমশোলের ফুটবল মাঠে পৌঁছে একেবারে মেজাজ হারান। পাশে থাকা পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ ও রাজ্যের নিরাপত্তা অধিকর্তা বীরেন্দ্রকে রাগত স্বরে জিজ্ঞাসা করেন, “কী করে এমন হল? এটা কি সভা করার জায়গা?” মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের মুখে কেউ রা কাড়েননি। পরে ঘনিষ্ঠ মহলে অবশ্য পুলিশ-প্রশাসনের একাধিক কর্তা বলেছেন, “জঙ্গলমহলের যে এলাকায় এ দিনের সভা ছিল, সে এলাকায় মাওবাদী গতিবিধির খবর আমাদের কানে আছে। তার পরে কি আর ঝুঁকি নেওয়া যায়?”
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিরাপত্তার তোয়াক্কা না-করেই মঞ্চের নীচে দাঁড়িয়ে স্থানীয় ১৩৯ জনকে বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারি সাহায্য দেন। তার পর কর্ডলেস মাইক হাতে নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তিনি জানান, পথে কিছু মানুষ তাঁকে জানিয়েছেন, এলাকায় স্কুল-কলেজ দরকার, পানীয় জলেরও সমস্যা রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, “আমরা এখানকার অর্ধাহার, অনাহার মেটাতে পেরেছি। ১০০ দিনের প্রকল্পে কিছু মানুষ বছরে ৯৫ দিন পর্যন্ত কাজ করেছেন। ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া হচ্ছে। বাকি সমস্যাও দ্রুত মেটানো হবে।” কাঁকড়াঝোরে পর্যটন কেন্দ্র তৈরি, অলচিকিতে পরীক্ষা দিয়ে সরকারি আধিকারিকের চাকরির বন্দোবস্তের আশ্বাসও দেন তিনি।
এর পরই জনতার মাঝে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী। গ্রামের মেয়ে-বউ-কচিকাঁচারা তাঁকে ঘিরে ধরেন। জবলা গ্রামের বিলাসি সিংহ, শান্তি শবরদের অভিযোগ বার্ধক্য ভাতা জোটেনি। জুজারধরা গ্রামের কল্পনা মাহাতোর ক্ষোভ, স্বামী প্রতিবন্ধী ভাতা পান না। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আপনাদের এই সব কথা শুনতেই তো আমি এসেছি। একে একে সব সমস্যা মেটাব।” মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতো প্রত্যেকের খুঁটিনাটি দাবি লিখেও নেন জেলাশাসক ও অতিরিক্ত জেলাশাসক। স্বামী নিখোঁজ এমন কয়েক জন মহিলা প্ল্যাকার্ড হাতে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ সুপারকে বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন। |
পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম আমলাশোলে এই প্রথম কোনও মুখ্যমন্ত্রী এলেন। তবে মমতার আমলাশোল সফর এই নিয়ে দ্বিতীয় বার। ২০০৪-এ এই গ্রামে অনাহার-অপুষ্টিতে পাঁচ আদিবাসীর মৃত্যুর খবর পেয়ে এসেছিলেন তখনকার বিরোধী নেত্রী। মাঝের পেরিয়ে যাওয়া এতগুলো বছরে একটু একটু করে উন্নয়ন পৌঁছে গিয়েছে আমলাশোলে। উন্নয়নের ধারা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে বলে এ দিন আশ্বাস দেন মুখ্যমন্ত্রী। বার্তা দেন, জনসংযোগের মাধ্যমেই তাঁর সরকার উন্নয়নের কাজ করবে। নির্দেশ দেন, প্রতি গ্রাম থেকে ১০ জন করে যুবক-যুবতী নিয়ে অতিরিক্ত জেলাশাসকের নেতৃত্বে কমিটি গড়তে হবে। এই কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে উন্নয়নের রূপরেখা নির্ধারণ করতে হবে। প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়মিত গ্রামে গিয়ে হৃদয় দিয়ে কাজ করার নির্দেশও দেন তিনি।
মাওবাদীদের নাম না-করে এ দিন গ্রামবাসীদের কাছে মুখ্যমন্ত্রী আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আর যেন রক্ত না ঝরে। বাইরে থেকে আসা কাউকে গুন্ডামি করতে দেবেন না। এলাকায় শান্তি থাকলে উন্নয়ন হবে, মানুষ ভাল থাকবেন।”
|