এক মমতার সংবেদনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন অন্য মমতা।
মধ্যমগ্রামে এক কিশোরীকে বারবার গণধর্ষণ এবং তার জেরে আগুনে পুড়ে নির্যাতিতার মৃত্যুতে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকায় খেদ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন মমতা শর্মা। গণধর্ষণ ও মৃত্যুর এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণ ‘অসংবেদনশীল’ বলে মঙ্গলবার দিল্লিতে মন্তব্য করেন তিনি। শর্মা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত। যে-রাজ্যে এক জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন, সেখানে এই ঘটনা অবাঞ্ছিত। মুখ্যসচিব বা রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে ডেকে মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনা করা উচিত, কেন এই ঘটনা ঘটল এবং কী ভাবে এর পুনরাবৃত্তি রোখা যায়। তা হলে ফল মিলতে পারে।”
মধ্যমগ্রামের ঘটনায় অভিযোগ উঠেছে কিছু পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধেও। তাই অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের সাসপেন্ড করে তদন্ত চালানোর সুপারিশ করেছে জাতীয় মহিলা কমিশন। শর্মা বলেন, “এই বিষয়ে আমি এ দিনই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখছি।” বিষয়টি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে একটি কমিটিও গঠন করছে কমিশন। ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় আসছেন শর্মা।
মধ্যমগ্রামের গণধর্ষিতা কিশোরীর বাবা এবং অন্য কয়েক জন আত্মীয় এ দিন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করেন। কিশোরীর মা-ও দিল্লিতে এসেছেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি রাষ্ট্রপতি ভবন বা মহিলা কমিশনে যেতে পারেননি। সিপিএম নেতৃত্বের তরফেই দুপুরে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁদের দেখা করার ব্যবস্থা হয়েছিল। মহিলা কমিশনেও বামপন্থী মহিলা সংগঠনের নেত্রীরা ওই কিশোরীর পরিবারের সঙ্গে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে কিশোরীর বাবা বলেন, “আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছি। দোষীদের ফাঁসি চাই। উনি এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, আমাদের আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।” |
কিশোরীর আত্মীয়েরা সকালে মহিলা কমিশনে গিয়েছিলেন। কী ভাবে পুলিশ মৃতদেহ নিয়ে টানাহেঁচড়া করেছে, কমিশন-প্রধানকে তা বিস্তারিত ভাবে জানান কিশোরীর বাবা। তাঁর অভিযোগ, আইপিএস অফিসারের সামনেই তাঁদের গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বিহারে চলে যেতেও বলা হয়। তাঁদের কথা শুনে শর্মা বলেন, “প্রথম বার ধর্ষণের পরেও যেখানে দ্বিতীয় বার ধর্ষণ হয়েছে, সেখানে এটা স্পষ্ট যে, ধর্ষিতা বা তার পরিবারের জন্য কোনও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি। কিশোরী যে আত্মহত্যা করেনি, তা-ও এখন স্পষ্ট। তাই গণধর্ষণ ও খুনের মামলা হিসেবেই এর বিচার হওয়া উচিত।”
মধ্যমগ্রামের ওই ঘটনাকে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের সঙ্গেও তুলনা করেন কমিশনের চেয়ারপার্সন। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতার সমালোচনা করেন তিনি। সামগ্রিক ভাবে নারী-নির্যাতনের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রশাসনের তরফেও গাফিলতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেন শর্মা। বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ এমন একটা রাজ্য, যার প্রশাসন কোন ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার ‘অ্যাকশন টেকেন’ রিপোর্ট পাঠায় না। মধ্যমগ্রামের ঘটনায় অবশ্য রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।”
পরে সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “নারী-নির্যাতনে পশ্চিমবঙ্গ এখন দেশের মধ্যে শীর্ষে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মধ্যমগ্রামের ঘটনায় যে-মনোভাব দেখিয়েছে, তার পরে অন্তত বিহার সরকার সক্রিয় হয়েছে, এটাই ভাল কথা।” তবে মৃতার পরিবারের পাশে তাঁদের দাঁড়ানোর পিছনে রাজনীতি রয়েছে বলে
মানতে নারাজ সিপিএম নেতারা। সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাট বলেন, “মেয়েটির বাবা-মায়ের সাহসই আমাদের পথ দেখিয়েছে।”
মধ্যমগ্রাম কাণ্ডের প্রতিবাদে এ দিন কলকাতায় মৌনী মিছিল করে কংগ্রেস এবং বিজেপি। ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবিতে সন্ধ্যায় এক্সাইড মোড় থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মোমবাতি-মিছিলে ছিলেন কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া, প্রদেশ যুব সভাপতি সৌমিক হোসেন। পরে মানসবাবু বলেন, “ওই কিশোরীকে হত্যার তদন্তে পুলিশ-প্রশাসন ঠিক ভূমিকা নিয়েছে কি না, সিবিআই তদন্ত হলে তা জানা যাবে।” বিজেপির মৌনী মিছিল দলের রাজ্য দফতর থেকে ধর্মতলায় যায়। পরে বিজেপি নেতা ঋতেশ তিওয়ারি বলেন, “এই ঘটনায় তিনটি মামলায় তথ্যের অসঙ্গতির ফাঁক গলে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে। তাই সব ক’টি অভিযোগকে একত্র করে একটিই মামলা চালু হওয়া দরকার।”
ধর্ষণ ও মৃত্যু নিয়ে বিরোধী দলগুলির ভূমিকার সমালোচনা করেন তৃণমূল নেতারা। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “এই মামলার সব অভিযুক্তই ধরা পড়েছে। তার পরেও রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য ঘৃণ্য রাজনীতি করা হচ্ছে।” এর প্রতিবাদে এ দিন তৃণমূলও মধ্যমগ্রামে পাল্টা মিছিল বার করে। মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, প্রশাসন যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গেই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে। ৫৫ দিনের মাথায় চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই কাজ করছেন। পার্থবাবুর কথায়, “এটা নিয়ে যাঁরা নোংরা রাজনীতি করছেন, তাঁদের সময়ে (বাম জমানায়) এ রাজ্যে মহিলারা অভিযোগ জানানোরও সুযোগ পেতেন না। আমাদের সময়ে মহিলারা অভিযোগ জানাতে পারছেন। আমরা বারে বারেই বলছি, এই ঘটনা নিন্দনীয়, এটা সামাজিক ব্যাধি। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সামাজিক ভাবেই এর মোকাবিলা করতে হবে।”
রাজনৈতিক চাপান-উতোরের মধ্যেই কিশোরী খুনে অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে মামলা না-লড়ার ব্যাপারে এককাট্টা হয়েছেন ব্যারাকপুর আদালতের আইনজীবীরা। ধর্ষিতা কিশোরীকে খুনের অভিযোগে ধৃত রতন শীল ও মিন্টা শীলকে এ দিন ব্যারাকপুর এসিজেএম ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায় এজলাসে তোলা হয়। কিন্তু তাদের হয়ে কোনও আইনজীবীই দাঁড়াতে চাননি। পরে বিচারকের নির্দেশে সাব-ডিভিশনাল লিগাল সার্ভিসের প্যানেলভুক্ত এক আইনজীবী তাদের পক্ষে দাঁড়ান। বিচারক দুই অভিযুক্তকে ১৪ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
|