গত মরসুমে লক্ষ্যমাত্রা অধরা থেকে গিয়েছে। এ বারেও তা গোড়া থেকে নাগালের বাইরে। তা দেখেও কোটা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন ফাঁপরে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। শেষমেশ সরকারকে মানতে হচ্ছে, কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়া লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া অসম্ভব।
বিষয়টি হল ধান সংগ্রহ। সহায়কমূল্যের বিনিময়ে চলতি মরসুমে চাষিদের থেকে রাজ্য সরকার কত ধান কিনবে, খাদ্য দফতর বছরের গোড়াতেই সেই তথ্য দিয়ে ক্যালেন্ডার বার করে ফেলেছে। গত ২ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই ক্যালেন্ডারে আগাম ঘোষণা করা হয়েছে দফতরের সারা বছরের কাজের ফিরিস্তি। কিন্তু ঘটনা হল, নতুন বছরের শুরুতেই ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা থেকে দফতর পিছিয়ে পড়েছে! “এ বার কোনও মাসেই ধান কেনার কোটা পূরণ করা যাবে না। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে কেন্দ্রের থেকে চাল নিতে হবে।” স্বীকার করেছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। এ জন্য তিনি খোলা বাজারের বেশি দামকেই দায়ী করছেন। |
চলছে ধান শুকোনোর কাজ। দুবরাজপুরে। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত। |
পশ্চিমবঙ্গে কৃষি মরসুমের সময়কাল ১ অক্টোবর থেকে পরের বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর। সিংহভাগ ধান কেনা হয় নভেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে, কারণ খরিফের ধান তখনই ওঠে। সহায়কমূল্যে কেনা ধান চালকলে পাঠানো হয়। সেই চাল বিলি হয় রেশন ও মিড-ডে মিলে। রাজ্যবাসীকে ন্যায্য দরে চাল জোগানোর জন্য চাষিদের থেকে কত ধান সংগ্রহ করা হবে, কৃষি মরসুমের গোড়ায় রাজ্য সরকার সেই লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করে দেয়। গত মরসুমে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন, যা থেকে ২২ লক্ষ মেট্রিক টন চাল পাওয়ার কথা ছিল। তবে ধান সংগৃহীত হয়েছিল তার সাড়ে ৩ লক্ষ টন কম।
এ বারেও সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা এক। কিন্তু প্রথম চার মাসেই (অক্টোবর-জানুয়ারি) লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরকার পিছিয়ে পড়েছে। খাদ্যমন্ত্রী নিজেই জানান, চলতি কৃষি মরসুমের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত চাষিদের থেকে যা ধান কেনা হয়েছে, তা থেকে চাল মিলবে ২ লক্ষ টন, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ২৬ হাজার টন কম। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, কৃষি মরসুমের প্রথম তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি দেখেও জানুয়ারিতে তড়িঘড়ি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে কোটা পূরণের প্রতিশ্রুতি কেন?
মির্জা গালিব স্ট্রিটে খাদ্য দফতরের কর্তারা সরাসরি কোনও উত্তর দিতে রাজি হননি। খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিয়েছেন, এ বারেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। জ্যোতিপ্রিয়বাবুর যুক্তি, “চাষিরা সহায়কমূল্যের অনেক বেশি দাম পাচ্ছেন খোলা বাজারে। তাই সংগ্রহ মার খাচ্ছে।” দফতরের তথ্য বলছে: কুইন্টালপিছু ধানের সরকারি দর যেখানে ১৩১০ টাকা, সেখানে খোলা বাজারে ধান বেচে চাষিরা পাচ্ছেন ১৩৩০ থেকে ১৩৫০ টাকা।
তবে দুই দামের ফারাকের পাশাপাশি সংগ্রহে ঘাটতির পিছনে আরও কিছু কারণ দেখছেন খাদ্য-কর্তাদের একাংশ। ওঁদের বক্তব্য: পড়শি এক রাজ্য ধান-বিক্রেতা চাষিকে কুইন্টালপিছু ১০০ টাকা বোনাস দিচ্ছে। অনেকে তাই সেখানে গিয়ে ধান বিক্রি করছেন। নিজের ফলন নিজের রাজ্যের সরকারকে বেচতে এই যে অনীহা, তার জন্য আবার সরকারি নিয়ম-কানুনের নেতিবাচক ভূমিকার কথাও বলছেন কেউ কেউ। কী রকম?
রাজ্য নিয়ম করে দিয়েছে, যে চাষির থেকে ধান কেনা হবে, তাঁকে চাষের জমির দলিল-পর্চা দেখাতে হবে। অথচ রাজ্যের অধিকাংশ চাষির কাছে জমি সংক্রান্ত সে সব কাগজপত্র নেই। কাজেই তাঁরা সরকারকে ধান বিক্রির পথে হাঁটতে চাইছেন না বলে খাদ্য-কর্তাদের একাংশের অভিমত। উপরন্তু খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ধান-বিক্রেতা চাষি যে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা, তার প্রমাণপত্রও লাগবে। কর্তাদের একাংশের বক্তব্য: এত সব নিয়ম-কানুনও ধান সংগ্রহে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকার সাফ জানিয়ে দিয়েছে, নিয়ম বদলানোর প্রশ্ন নেই।
একই ভাবে সরকারি নিয়মের জেরে চালকল-মালিকদের মধ্যেও কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। এ বছর নিয়ম হয়েছে, মিল বা সমবায় সংস্থাগুলো কে-কবে-কত ধান কিনছে, তার বিস্তারিত তথ্য প্রতি দিন এসএমএস করে খাদ্য দফতরকে জানিয়ে দিতে হবে। ব্যতিক্রম হলে সরকারি রোষে পড়তে হবে, এমন আশঙ্কাতেও চাষির ধান কিনতে অনেক মিল-মালিক ও সমবায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে দফতর-সূত্রের ইঙ্গিত।
সঙ্গে জুড়েছে বকেয়া পাওনা না-পাওয়ার ক্ষোভ। অভিযোগ, গত বছর সরকারকে চাল সরবরাহের টাকা অনেক মিল-মালিক এখনও পাননি। যদিও খাদ্যমন্ত্রীর দাবি: গত বছরের বকেয়ার বেশিটাই মেটানো হয়েছে। চালকল ও সমবায় সংস্থারা এ বার ধান কেনার পনেরো দিনের মধ্যে টাকা পেয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন মন্ত্রী। |