মধ্যমগ্রাম-কাণ্ডে বৃহস্পতিবার তাঁর রিপোর্ট তলব করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। শনিবার সপার্ষদ উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ লাইনে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়।
মধ্যমগ্রামে এক কিশোরীকে দু-দু’বার ধর্ষণ এবং তার জেরে নির্যাতিতার মৃত্যুর তদন্তের ভার কেন সিবিআই-কে দেওয়া হবে না, বৃহস্পতিবার তার জবাবদিহি করার জন্য রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবকে সাত দিনের সময় দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্ট এ-ও বলে, যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলে ওই কিশোরীকে দ্বিতীয় বার ধর্ষিতা হতো না। এই পরিস্থিতিতে এ দিন রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি, এডিজি (সিআইডি) শিবাজি ঘোষ এবং আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মাকে নিয়ে দোলতলায় গিয়ে বাসুদেববাবু বৈঠক করেন উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশের সঙ্গে। সেখানে জেলার সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন স্বরাষ্ট্রসচিব।
এই বৈঠকে জেলার এসপি, এএসপি ও ডিএসপি-র মতো পুলিশ কর্তারা তো ছিলেনই, হাজির ছিলেন জেলার সব ওসি-ও। এ ছাড়া ছিলেন বারাসত কোর্টের সরকারি কৌঁসুলি মহেশ্বর ভট্টাচার্য। পুলিশ সূত্রের খবর, মধ্যমগ্রাম ধর্ষণ কাণ্ডে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে এ দিন বিশদে খোঁজ নেন স্বরাষ্ট্রসচিব। জেলার এক পুলিশকর্তা বলেন, গত বছরের ২৫ অক্টোবর প্রথম বার গণধর্ষণ করা হয় কিশোরীটিকে। সেই মামলায় চার্জশিট হয়ে গিয়েছে। শুনানিও শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় বার ধর্ষণের ঘটনার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। সেটির ক্ষেত্রে যাতে দ্রুত চার্জশিট দেওয়া হয়, জেলার পুলিশ সুপারকে এ দিন সেই নির্দেশই দেন ডিজি। জেলা পুলিশ সূত্র মনে করছে, আগামী সপ্তাহে চার্জশিট দিয়ে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে শুনানিও শুরু হয়ে যাওয়ার যথেষ্টই সম্ভাবনা।
প্রথম বার ধর্ষণের পরে মেয়েটি যে নিরাপত্তা পায়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল হাইকোর্ট। বিচারপতিদের এ হেন মন্তব্যে রাজ্য প্রশাসনের যে অস্বস্তি বেড়েছে, এ দিন তা জেলা পুলিশকে বুঝিয়ে দিয়েছেন নবান্নের কর্তারা। কী পরিস্থিতিতে ওই কিশোরীকে সঠিক সময়ে নিরাপত্তা দেওয়া গেল না, এ দিনের বৈঠকে সেই প্রসঙ্গও উঠেছিল। শুধু মধ্যমগ্রামেই নয়, ওই কিশোরীর পরিবার বিমানবন্দর এলাকায় চলে যাওয়ার পরেও যথাযথ নিরাপত্তা পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। মধ্যমগ্রাম থানার পাশাপাশি বিমানবন্দর থানার বক্তব্যও জানতে চাওয়া হয় বলে নবান্ন সূত্রের খবর।
স্বরাষ্ট্রসচিব জানান, মহিলাদের উপরে অপরাধ নিয়ে সরকার কোনও অবস্থাতেই ঢিলেমি বরদাস্ত করবে না। প্রশাসনের তরফে যাঁদের গাফিলতি থাকবে, তাঁদেরও কড়া শাস্তির মুখে পড়তে হবে। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে মধ্যমগ্রাম এবং বিমানবন্দর থানার পুলিশকর্মীদের কারও কোনও গাফিলতি প্রমাণ হলে তাঁদের বিরুদ্ধে যে রাজ্য সরকার ব্যবস্থা নেবে, স্বরাষ্ট্রসচিবের কথায় সেই ইঙ্গিতই মিলেছে।
সরকারি তথ্য বলছে, প্রথম বার ধর্ষণের পরে বারাসত হাসপাতালে মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা হয়। কিন্তু পরের দিনই তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেন চিকিৎসকেরা। সে দিনই ফের তাকে দ্বিতীয় বার ধর্ষণ করে দুষ্কৃতীরা। ছেড়ে দেওয়ার সময়ে হাসপাতাল কেন কিশোরীটির নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশকে অবহিত করেনি, সেই প্রশ্ন উঠেছে এ দিনের বৈঠকে। ভবিষ্যতে যেন এমন সমন্বয়ের অভাব প্রকট না হয়, সে জন্য উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশলকে সতর্ক থাকতে বলেন স্বরাষ্ট্রসচিব। রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় আধিকারিকেরা আরও প্রশ্ন তোলেন, পুলিশই বা কেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মেয়েটির নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করল না? দ্বিতীয় বার ধর্ষণের পরে মেয়েটির আবার ডাক্তারি পরীক্ষা হবে, সেটাই নিয়ম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করেন বলে অভিযোগ নির্যাতিতার পরিবারের। প্রশাসন সূত্রের খবর, এ দিন স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠকে এই বিষয়টিও ওঠে। যে ঘরে মেয়েটি অগ্নিদগ্ধ হয়, সেই ঘরের ফরেন্সিক তদন্তের ক্ষেত্রেই বা কেন গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে, আলোচনা হয় তা নিয়েও।
ওই জেলার শিশুকল্যাণ কমিটির ভূমিকা নিয়েও এ দিনের বৈঠকে আলোচনা হয়। ওই কমিটির সদস্যরা কেন ওই মেয়েটির মুখ থেকে সব শোনার পরেও পরবর্তী পদক্ষেপ করেননি, কেন মেয়েটির নিরাপত্তার খাতিরে তাকে হোমে রাখার ব্যবস্থা করা হয়নি এই সব প্রসঙ্গ নিয়ে এ দিনের বৈঠকে আলোচনা হয়। সরকারি সূত্রের খবর, বাসুদেববাবু জেলাশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন যে, মধ্যমগ্রাম-কাণ্ডের সব গাফিলতির দিকই খতিয়ে দেখা হোক। যাতে ভবিষ্যতে আর এমন অভিযোগ না ওঠে। ঘটনাটি নিয়ে জেলার পুলিশ-প্রশাসনকে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করতেও বলা হয়েছে।
নারী নিগ্রহে কেন বারাসতই বারবার খবরের শিরোনামে উঠে আসে? কেন অন্য জেলার চেয়ে উত্তর ২৪ পরগনায় এ জাতীয় সামাজিক অপরাধের সংখ্যা বেশি? কেনই বা কামদুনি, মধ্যমগ্রাম, হাবড়া, বিড়ার মতো একের পর এক ঘটনার পরেও ওই জেলার পুলিশ সক্রিয় হয়ে ওঠে না? এমন সব প্রশ্ন উঠেছিল এ দিনের বৈঠকে। কিন্তু সদুত্তর মেলেনি রাজ্যের পুলিশকর্তাদের কাছ থেকে। তবে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত অপরাধের জন্য যে ওই জেলা রাজ্য প্রশাসনের মাথাব্যথা, এ কথা ঠারেঠোরে স্বীকার করেছেন তাঁরা। এবং সেই কারণেই ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যে সরকার কোনও ভাবেই বরদাস্ত করবে না, এ দিনের বৈঠকে সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন বাসুদেববাবু।
স্বরাষ্ট্রসচিব এ দিন রাতে বলেন, “উত্তর ২৪ পরগনার কয়েকটি থানা এলাকায় বারবার মহিলাদের উপরে আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। কেন এমন হচ্ছে, তা পর্যালোচনা করতেই জেলার অফিসারদের ডাকা হয়েছিল।”
স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, উত্তর ২৪ পরগনার অধিকাংশ থানা এলাকায় নারী নির্যাতন সংক্রান্ত অপরাধ কেন ঠেকানো যাচ্ছে না, তা পর্যলোচনা করতে গিয়ে মধ্যমগ্রাম-কাণ্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। জেলার পুলিশ অফিসারদের জানিয়ে দেওয়া হয়, এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে মামলা রুজু করেই পুলিশের কাজ শেষ হয় না। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করে চার্জশিট জমা দেওয়ার পাশাপাশি নির্যাতিতার সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাও পুলিশের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বারাসতের একাধিক ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা কার্যত সমালোচনারই মুখে।
নবান্নের কর্তারা এ দিন জেলার পুলিশ অফিসারদের সতর্ক করে বলেন, ওই তল্লাটে মহিলাঘটিত অপরাধ ঠেকাতে অভিযোগ আসামাত্রই সক্রিয় হতে হবে পুলিশকে। কোনও প্রভাবশালী মহল অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টা করলেও চাপের মুখে মাথা না নোয়াতেই জেলার পুলিশ প্রশাসনকে পরামর্শ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব।
এ দিন যখন দোলতলায় এই বৈঠক চলছে, তখন নির্যাতিতার পরিবার তৈরি হচ্ছে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে দেখা করার জন্য। আজ, রবিবার সাক্ষাতের সময় দিয়েছেন নীতীশ। |