ইস্টবেঙ্গল আগেই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়ায় শনিবারের ডার্বির গুরুত্ব ছিল না, মোটেই মনে করি না। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দু’দলের কাছেই এই ম্যাচের সম্মান সব সময়ই বিরাট। সে জন্য অন্তত মানসম্মানের দিক দিয়ে এ দিন মোহনবাগানের জয়ের একশো শতাংশ গুরুত্ব আছে।
চিফ কোচ আর্মান্দো কোলাসোর ছুটি মঞ্জুর করে দিয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন ইস্টবেঙ্গল যদি বোঝাতে চেয়ে থাকে, তাদের কাছে ডার্বি ম্যাচের গুরুত্ব ছিল না, তা হলে আমার মতে সেই মনোভাবটা ভুল। তাও যদি ইস্টবেঙ্গলে পাঁচ-ছ’জন বাঙালি ফুটবলার থাকত, ভিনরাজ্যের কোচ ছাড়াই মাঠে দলটার মধ্যে তেড়েফুঁড়ে খেলার একটা সম্ভাবনা দেখা যেত। কিন্তু এ দিন সৌমিক দে ছাড়া ইস্টবেঙ্গলে সবাই ভিন রাজ্যের বা বিদেশি। এই ম্যাচটা ঘিরে বাঙালির চিরকালীন সেন্টিমেন্টের মূল্য কোনও এক মোগা বা কোনও গুরবিন্দর কিংবা নওবা-লোবোরা বুঝবে কী করে?
ম্যাচটা দেখে আমার মনে হল, ইস্টবেঙ্গল ফুটবলাররা যেন অপেক্ষা করছিল, কতক্ষণে খেলাটা শেষ হবে! আমি অবাক হব না যদি এর পর কোলাসো ফিরলে ওর টিমের কেউ কেউ কোচের ছুটি নিয়ে ফোড়ন কাটে! ইস্টবেঙ্গলে ডার্বি হারের ময়নাতদন্তে কোনও ফুটবলারের ঘাড়ে দোষ চাপলে সেই প্লেয়ার বলতেই পারে যে, কোচ কোথায় ছিল? হয়তো সবটাই চুপিচুপি হবে, ক্লাবের অন্দরে। কিন্তু ফেড কাপের ঠিক আগেই ডার্বির হার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েও ইস্টবেঙ্গলকে খুব একটা ভাল জায়গায় রাখল বলে আমার মনে হয় না। আমি কোলাসো হলে লিগ জেতার পর স্পোটিং ইউনিয়ন ম্যাচ থাকলেও ছুটি নিতাম না। ফুটবলারজীবনে বাবা মারা যাওয়ার খবর পেয়েও বেঙ্গালুরু থেকে না খেলে ফিরিনি। |
তা ছাড়া টুর্নামেন্টের ফয়সালা হয়ে গিয়েছে, ট্রফি জিতে গিয়েছি বলে সম্মান-মর্যাদারক্ষার ম্যাচকে গুরুত্ব দেব না, এতটা নির্মম পেশাদার আমাদের দেশের ফুটবল এখনও হয়নি। বিদেশেও এমন সেন্টিমেন্ট খুব একটা বেশি দেখা যায় কি? আজ বার্সেলোনা লা লিগা জিতে গেলে কি রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে মেসি-কে বিশ্রাম দিয়ে নামবে? বিদেশি লিগে বিখ্যাত ক্লাবগুলোর পারফরম্যান্সের উপর তাদের শেয়ারের ওঠা-নামা ঘটে। সে ক্ষেত্রে মেসি-রোনাল্ডো-রুনি-রিবেরিরা যে কোনও ম্যাচই জানপ্রাণ দিয়ে খেলে। খেলতে হয়।
মোহনবাগানের সুবিধে ছিল, ওদের পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ফুটবলার বাঙালি কিংবা বাংলার। ফলে দলের ব্যর্থ মরসুমের মধ্যে অন্তত ডার্বিটা জিততে আরও মরিয়া হয়ে খেলেছে। ইস্টবেঙ্গলের কোনও ফুটবলারকে এ দিন হারায় কাল সকালে পাড়ায় বেরিয়ে শুনতে হবে না যে, কী রে, মোহনবাগানের কাছে হেরে গেলি? যেটা আমাদের সময়ে শুনতে হত। এ দিন প্রীতম কোটাল, শিল্টন পাল, শঙ্কর ওঁরাও, কিংশুক দেবনাথরাও হারলে কাল ওদেরও পাড়ায় বেরোলে শুনতে হত। চিফ কোচ বিহীন, আগেই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়ায় মোটিভেশন-শূন্য একঝাঁক অবাঙালি আর বিদেশি ফুটবলারে ঠাসা ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে মোহনবাগান কোচ করিম এ দিন এই সুবিধেটার ফায়দা অন্তত তুলতে পেরেছে বাঙালি ফুটবলারদের কাছে ডার্বির বাড়তি আবেগ, তার জন্য মাঠে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।
তাও ইস্টবেঙ্গল কিছু না খেলেও দুটো সহজ গোলের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। তবে দু’দলের সব ক’টা প্রাপ্ত সুযোগ থেকে গোল হলেও ম্যাচের রেজাল্ট মোহনবাগানের পক্ষেই ৩-২ থাকত। যদিও ডার্বি জিতে ফেড কাপের আগে মোহনবাগান যে দারুণ অবস্থায় ফিরল সেটা বলব না। বরং আমার মতে এটা করিমের দলের একটা বিক্ষিপ্ত বড় জয়। মানছি মোহনবাগানে বেশ ক’জন ভাল বাঙালি তরুণ ফুটবলার রয়েছে। কিন্তু একঝাঁক উঠতি তরুণ প্লেয়ার সব ম্যাচেই ভাল খেলবে ভাবাটা ভুল। তা হলে আমরা চুয়াত্তরে সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে ডুরান্ড চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর পঁচাত্তরে পাঁচ গোল খেতাম না। তার পরের দু’বছরে যখন একে-একে হাবিব-আকবর, সুভাষ, পিন্টু চৌধুরী, সুধীর, গৌতমরা এল, তখনই মোহনবাগান অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল। ওই সিনিয়ররা আমাদের মতো তরুণদের সাহস দিয়ে বলত, আমরা পিছনে আছি, তোরা মন খুলে খেল।
এই মোহনবাগান টিমে ওডাফার মতো সিনিয়ররা নিজেদের বাঁচাতেই জেরবার, তো টিমের জুনিয়রদের গাইড করবে কী? ডার্বি জিতলেও তাই মোহনবাগানের রাতারাতি পট পরিবর্তন মনে হয় সম্ভব নয়। |