চটি-জুতো সস্থানেই থাকল! হাতে উঠল ঝাণ্ডা! চব্বিশ মাস চার দিন পর।
মোহনবাগান টিম বাস যখন যুবভারতী থেকে বেরোচ্ছে তখন দু’পাশে উড়ছিল সবুজ-মেরুন পতাকা। উচ্ছ্বসিত স্লোগান। কাতসুমি-শিল্টন পালদের অভিবাদন জানাচ্ছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেককেই শেষ ছ’টা ডার্বির পর খালি পায়ে বাড়ি ফিরতে দেখা গিয়েছিল। জুতোগুলো ব্যবহৃত হত মাঠে। কান্নাভেজা, ক্ষুব্ধ, আগুনে মুখগুলো হঠাৎ-ই বদলে গিয়েছে শনিবার সন্ধ্যার পর। পাড়ায় পাড়ায় লুকিয়ে থাকা মুখগুলোতেও শুধুই স্বস্তি। আশ্বস্ত হওয়ার প্রলেপও।
খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই করিম বেঞ্চারিফা দু’হাত তুলে নাচতে শুরু করলেন। ইচে-ডেনসনরা দিলেন ভিকট্রি ল্যাপ। দেখে মনে হচ্ছিল, কলকাতা লিগ জয়ের খেতাব ইস্টবেঙ্গল তাঁবু ছেড়ে গঙ্গাপারের ক্লাবে চলে গিয়েছে।
“ডার্বিটা জিতলাম। কিন্তু কলকাতা লিগটা চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে আরও আনন্দ হত।” সাংবাদিকদের সামনে এসে বাস্তবের জমিতে করিম। আক্ষেপ থাকলেও, হতাশ নন। বরং ফেড কাপের আগে ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে মহার্ঘ্য জয়ের পর তৃপ্ত তিনি। মোহন-কোচের স্বস্তির প্রথম কারণ যদি হয়, প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের উৎসবকে ভেস্তে দেওয়া, তা হলে দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই কলকাতা ফুটবলে মোহনবাগানকে প্রাণ ফিরিয়ে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। |
করিমের কোলে ডার্বির নায়ক কাতসুমি।
তাঁর একমাত্র গোলেই জয়। |
ইস্টবেঙ্গলের খেতাব জয়ে চোনা ফেলে দিলেন করিম! লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ডার্বি হেরে লাল-হলুদ গ্যালারির বিষন্নতা দেখে মনেও হচ্ছিল, উৎসবটা মাটি হয়ে গিয়েছে। এ দিন সত্তর হাজারের গ্যালারির সত্তর ভাগ জুড়েই তো ছিলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। সঙ্গে আনা মশাল তাঁরা জ্বালালেন, কিন্তু তাতে সেই উজ্জলতা কোথায়? আর আবির-পটকা? সেগুলো তো পকেটেই রয়ে গেল! ১৯৪৯ এবং ২০০৬ সালের ইস্টবেঙ্গলের লিগ জয়ের পরেও কি এ রকম ছিল ছবিটা? দু’বারই খেতাব জিতলেও চারটে ডার্বির একটাতেও কিন্তু জিততে পারেনি ইস্টবেঙ্গল!
কিন্তু যে টিমটা ডার্বি জেতা ইদার্নিং অভ্যাস করে ফেলেছিল সেই ইস্টবেঙ্গল কেন এ দিন মুখ থুবড়ে পড়ল? চৌম্বকে যে দু’টো কারণ উঠে আসছে তা হল, এক) হাই ভোল্টেজ ম্যাচে কোচ আর্মান্দো কোলাসোর অনুপস্থিত থাকা। দুই) ফুটবলারদের মোটিভেশনের অভাব।
রিজার্ভ বেঞ্চে ও ড্রেসিংরুমে কোলাসোর অনুপস্থিতি পুরো ইস্টবেঙ্গল টিমটাকে দিশাহীন করে দিয়েছিল ম্যাচের আগে। তীব্র গতিতে ছুটতে থাকা ঘোড়ার উপর থেকে সহিস যদি হঠাৎ উধাও হয়ে যান তা হলে যা হয়! দ্বিতীয়ার্ধের মিনিট কুড়ি ছাড়া চিডি-ডিকা-খাবরাদের দেখে মনে হল লক্ষ্যহীন একটা দল। আর সেটাই অনেকখানি সুবিধা করে দিয়েছিল বাগান কোচকে। করিমের অঙ্ক কষা আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল।
|
ডার্বি জয়ের গোল। শনিবার যুবভারতীতে। |
কোলাসোর অনুপস্থিতি নিয়ে ম্যাচের পর তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। পেশাদারিত্বের যুগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও শুধু আবেগের জন্য ডার্বিকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তা নিয়ে শুরু হয়েছে চাপানউতর। বিতর্কে না ঢুকেও গোয়া থেকে ফোনে সুভাষ ভৌমিক বললেন, “একটা ম্যাচে কোচের উপস্থিতি দশ পার্সেন্ট সুবিধা করে দেয় টিমকে। এবং সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর ডার্বির মতো ম্যাচে তো কোচকে থাকতেই হয়। ডার্বির গুরুত্ব বাঙালির কাছে সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলায় না থাকলে সেটা বোঝা যায় না।” ডেরেক পেরিরা বা এলকো সাতোরির মতো কোচেরা আবার একমত নন। তাঁদের কাছে চ্যাম্পিয়ন হওয়াই আসল। লাল-হলুদের এ দিনের কোচ রঞ্জন চৌধুরীও বলে দিলেন, “ডার্বি হারলেও দিনের শেষে কিন্তু আমরাই কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন।”
কোলাসোর সঙ্গে ফোনে কথা বলেই টিম নামিয়েছিলেন সহকারী রঞ্জন। সেই টিমে সবচেয়ে বড় ভুল অর্ণবকে বসিয়ে রাজু-গুরবিন্দর জুটি স্টপারে নামিয়ে দেওয়া। যে জুটির ভুলে দুরূহ কোণ থেকে বিশ্বমানের গোলটা করে গেলেন বাগানের জাপানি ‘বোমা’ কাতসুমি। যা মনে করাল ২০১০-এ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে করা ব্রাজিলের মাইকনের গোলকে। শঙ্কর ওঁরাওর পাস ধরে হঠাৎ-ই গতি বাড়িয়ে গোলটা করলেন বাগান মিডিও। কাউন্টার অ্যাটাকের সুফল ঘরে তুললেন করিম।
গোলের আগে ম্যাচটা অবশ্য দুলেছে পেন্ডুলামের মতো। প্রথমার্ধটা যদি হয় বাগানের, পরের অর্ধের অনেকটাই বেঙ্গলের। প্রথম পঁয়তাল্লিশ মিনিট করিম বিগ্রেডের দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন চিডি-খাবরারা। তিন মিনিটের মধ্যেই বাগানের এগিয়ে যাওয়ার কথা ২-০ গোলে। পঙ্কজ মৌলার শট রুখলেন গুরপ্রীত। |
ডেনসনের শট গোললাইন থেকে বাঁচালেন লোবো। বাগানের দুই বঙ্গসন্তানগড়িয়ার পঙ্কজ মৌলা আর সোদপুরের শঙ্কর ওঁরাওয়ের দৌরাত্ব্যে লাল-হলুদ তখন দিশাহারা। ওডাফা স্বার্থপর না হলে বাগান আরও দু’টো গোল পেত। পরের অর্ধ অবশ্য ইস্টবেঙ্গলের। তখন চিডি-সুয়োকাদের সঙ্গে লড়াই চলল বাগান কিপার শিল্টন পালের। অন্তত তিনটি নিশ্চিত গোল বাঁচালেন শিল্টন। দুই কোচেরই স্ট্র্যাটেজি ছিল উইং আটকে ডাউন দ্য মিডল দিয়ে আক্রমণে যাওয়া। বাগান খেলল জোনাল মার্কিং-এ। চিডির ঘাড়ে ইচে, সুয়োকার পিছনে ডেনসনকে লাগানো হয়েছিল। ওডাফা চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইস্টবেঙ্গল চাপ বাড়াল। তখন চিডিকে বসিয়ে মোগাকে নামানোটাও ভুল।
কলকাতা ডার্বির পর দুই প্রধানের যুদ্ধক্ষেত্র এ বার কেরল। ফেড কাপের আগে বাগানে ফিরছে আলো, ইস্টবেঙ্গল লিগ জয়ের পরেও আধো অন্ধকারে।
ডার্বি না জিতলে যে কোনও খেতাবই তেতো হয়ে যায় দুই প্রধানের কর্তা-সদস্য-সমর্থকদের কাছে। কলকাতা ফুটবলে সেটাই চলে এসেছে আবহমানকাল। গোয়ায় সফল ‘আর্মান্দো স্যার’ যত তাড়াতাড়ি সেটা বুঝবেন ইস্টবেঙ্গলের ততই মঙ্গল।
মোহনবাগান: শিল্টন, প্রীতম, ইচে, রোউইনসন (কিংশুক), শৌভিক, ডেনসন, সাবিথ, জাকির, পঙ্কজ, শঙ্কর, ওডাফা (কাতসুমি)
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, নওবা, রাজু, গুরবিন্দর, সৌমিক, সুয়োকা, খাবরা, ডিকা, জোয়াকিম (তুলুঙ্গা), কেভিন, চিডি (মোগা)
|
কামব্যাকের আশায়... |
মহম্মদ হাবিব
ডার্বির সঙ্গে অন্য ম্যাচকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ মানে একটা আলাদা টুর্নামেন্টই। একটা আলাদা লিগ। আলাদা উন্মাদনা। কলকাতা লিগ হয়তো ইস্টবেঙ্গল জিতেছে। কিন্তু ডার্বি জেতায় ফেড কাপে মোহনবাগান ফেভারিট। |
উলগানাথন
কলকাতা লিগ হাতছাড়া হওয়ার পর মোহনবাগানের কাছে এই জয়টা গুরুত্বপূর্ণ। ফেড কাপের আগে ওদের ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। ফেড কাপে মোহনবাগানের সাফল্য নিয়ে আমি আশাবাদী। |
সমরেশ চৌধুরী
ডার্বি জেতায় মোহনবাগানের মানসিকতায় পরিবর্তন তো হলই। ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। তবে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। আত্মতুষ্টি যেন না আসে। ফেড কাপ বা আই লিগের সাফল্য কিন্তু একটা ম্যাচের উপর নির্ভর করবে না। এটা ফুটবলাদের মনে রাখতে হবে। |
প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়
মোহনবাগানের অসাধারণ কামব্যাক। এই জয়টাই মোহনবাগানের ভবিষ্যৎ সাফল্যের চাবিকাঠি হবে। পরের টুর্নামেন্টে ওডাফাদের তাতাবে। |
|