একই পরিবারের তিন মহিলার দেহ উদ্ধারের পরে পাঁচ দিন কেটে গেলেও এই ঘটনায় পুলিশ কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে নিহত বিজয়া বসুর স্বামীকে বৃহস্পতিবার পুলিশ পুরী থেকে আটক করেছে। শুক্রবার তাঁকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয়। পুলিশের প্রাথমিক ভাবে অবশ্য অনুমান, খুনি অন্য কেউ। তাকে শনাক্তও করা গিয়েছে বলে জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বিজয়াদেবীর প্রতিবেশীদের বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, সেই ব্যক্তি পেশাদার দুষ্কৃতী না হলেও খুব ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে। সে যে ওই পরিবারের পরিচিত তা নিয়েও পুলিশের সন্দেহ নেই। তবে সে এখন কোথায়, সে নিয়ে কোনও তথ্য পুলিশ ভাঙতে চায়নি। তদন্তে অবশ্য কলকাতা থেকে সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপারিনটেন্ডেন্ট চিরন্তন নাগের নেতৃত্বে রাজ্য গোয়েন্দা দফতরের একটি দল এ দিন বহরমপুরে পৌঁছেছে।
গত সোমবার সন্ধ্যায় বহরমপুরে একটি ফ্ল্যাট থেকে বৃদ্ধা প্রভা দাস, তাঁর ভাইঝি বিজয়াদেবী ও বিজয়াদেবীর তরুণী কন্যা আত্রেয়ী বসুর দেহ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক ভাবে অভিযোগের তির ওঠে বিজয়াদেবীর স্বামীর দিকেই। বিজয়াদেবীর দিদি ইরা মিত্র পুলিশের কাছে তাঁর ভগ্নীপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তবে বিজয়াদেবীর স্বামী বছর দু’য়েক ধরেই স্ত্রী-কন্যার সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। বহরমপুরেও থাকতেন না তিনি। এ দিন পুলিশ সুপার বলেন, “পুরী থেকে নিয়ে আসার পরে বিজয়াদেবীর স্বামীর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তিনি নিজে ওই খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত না থাকলেও, খুনের ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন কি না, তার তদন্ত চলছে। তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” তিনি বলেন, “ওই ব্যক্তিকে বহরমপুরের আশপাশেই একটি জায়গায় রাখা হয়েছে।” পুরীর একটি হোটেলে ম্যানেজারের পদে কাজ করতেন ওই ব্যক্তি।
কিন্তু কেন এই তিন মহিলাকে খুন করা হল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। খুনের পরে দরজা ভেঙে দেখা গিয়েছিল, আলমারি খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেখানে কিছু খালি গয়নার বাক্স ছিল। কিন্তু কিছু গয়না পড়েছিল ঘরের মেঝেতেও। সেক্ষেত্রে খুনি গয়না ও নগদ টাকার লোভেই এসেছিল কি না, তা পরিষ্কার নয়। তবে পুলিশের এক সূত্র জানিয়েছে, ওই পরিবারের যা আর্থিক অবস্থা, তাতে খুব দামি গয়না বা এত বেশি নগদ টাকা আলমারিতে থাকার কথা নয়, যার জন্য তিন জনকে খুন করার মতো ঝুঁকি কেউ নিতে পারে। পুলিশ এই মতও উড়িয়ে দিচ্ছে না যে, খুনির মানসিক বিকৃতি ছিল।
পুলিশের একাংশের অনুমান, সম্পত্তির লোভেই এই তিন জনকে খুন করা হয়েছে। ওই ফ্ল্যাটটি ছিল বিজয়াদেবীর নামে। এই পরিবারের বড় সম্পত্তি বলতে এই ফ্ল্যাটটিই রয়েছে। আর ব্যাঙ্কে রয়েছে কিছু স্থায়ী আমানত। তবে সেক্ষেত্রেও একটি এক কামরার ফ্ল্যাট বা ওই সামান্য অঙ্কের স্থায়ী আমানতের জন্য তিন জনকে খুন করার মতো মরিয়া কে হতে পারেন, তা পরিষ্কার নয়। তবে পুলিশ জানিয়েছে, ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ সকলের সঙ্গেই কথা বলা হয়েছে। ইরাদেবীর বক্তব্য, “বিজয়া বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করেছিল। তাই ওর সম্পত্তির উপরে তার স্বামীর এখন আর কতটা অধিকার রয়েছে, জানি না। এ ছাড়া, ওদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলতে আমরাই। পিসির কোনও সন্তান নেই। তবে বিজয়া ও আমার আর এক বোন রয়েছেন। আমাদের এক ভাই ছিল, সে অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছে।”
ইরাদেবী তিন বোনের মধ্যে বড়। বিজয়াদেবী ছোট। মেজো বোন রিঙ্কু বাগ থাকেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজে। বিজয়াদেবীদের মৃত্যুর খবর শুনে বহরমপুরে এসেছিলেন। তারপরে তিনি আবার ফিরে যান। এ দিন ফোনে তিনি বলেন, “বোন, বোনঝি ও পিসির এমন ভাবে মৃত্যু হতে পারে, তা কোনওদিন ভাবিনি। তবে ওদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক ছিল দিদিরই। যা বলার দিদিই বলবেন।”
আত্রেয়ীকে এ ভাবে খুনের ঘটনা তার বন্ধুরা অবশ্য এখনও মানতে পারছে না। আত্রেয়ী খুবই ভাল ছাত্রী ছিলেন। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় স্কুলে তিনি চতুর্থ হয়েছিলেন। দ্বাদশ শ্রেণির হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় আত্রেয়ী প্রথম স্থান পান।
যে শনিবার তাঁকে খুন করা হয়, সে দিন সকালেই জীববিদ্যার গৃহশিক্ষকের কাছে জীবনের শেষ পরীক্ষা দিয়েছিলেন আত্রেয়ী। তাঁর সেই গৃহশিক্ষক পল্লববাগ সান্যাল বলেন, “আত্রেয়ীকে পড়ানোর জন্য শনিবার ওদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। তখন একটা ছোট পরীক্ষা নিয়েছিলাম। বাড়িতে ফিরে উত্তরপত্র দেখে সোমবার রাতে ওকে তা দেখতে দেওয়ার কথা ছিল। তা আর ওকে দেখাতে পারলাম না।” আত্রেয়ী কত পেয়েছিল? পল্লববাবু বলেন, “২৫-এ ২৪।”
|