একই পরিবারের তিন মহিলাকে খুনে অপরাধীকে শনাক্ত করা গিয়েছে বলে দাবি করল পুলিশ। বহরমপুরের একটি আবাসনের ফ্ল্যাট থেকে সোমবার তরুণী আত্রেয়ী বসু, তাঁর মা মধ্য চল্লিশের বিজয়া বসু ও বিজয়াদেবীর পিসি বৃদ্ধা প্রভা দাসের দেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ এ দিন জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তের পরে অনুমান, শনিবার রাতে অপরাধী একাই ঢুকেছিল ওই ফ্ল্যাটে। সে ওই তিন মহিলার খুবই পরিচিত। তাই শীতের সন্ধ্যায় তাকে শুধু যে দরজা খুলেই দেওয়া হয়েছিল তাই নয়, চা দিয়ে আপ্যায়নও করা হয়েছিল। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বৃহস্পতিবার বলেন, “অপরাধী মানসিক বিকৃতি এতটাই যে, সে বিজয়াদেবী ও আত্রেয়ীদের গলায় ফাঁস লাগিয়েছিল তাঁদেরই অন্তর্বাস দিয়ে।”
আত্রেয়ীরা যে আবাসনে থাকতেন তার বাসিন্দা কয়েক জন মহিলা এই দিন পুলিশ সুপারের কাছে খুনের দ্রুত কিনারার দাবিতে স্মারকলিপি দিতে যান। তখনই পুলিশ সুপার তাঁদের বলেন, “খুনিকে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। খুনি খুব দ্রুতই আমাদের জালে ধরাও পড়বে। সে এই পরিবারের খুব পরিচিত। তাই তাকে কোনও সন্দেহ করেননি ওই মহিলারা।” পুলিশ অবশ্য এখনও জানায়নি, অপরাধী এই পরিবারের আত্মীয়, না তাদের অন্য কোনও ভাবে পরিচিত। যে কারণে পুলিশ এই ঘটনায় ওই পরিবারের আত্মীয় স্বজন মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত মোট ২৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। |
নিহত আত্রেয়ী বসুর ছবি ঘিরে স্মরণ। বৃহস্পতিবার বহরমপুরে। — নিজস্ব চিত্র |
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাঁধুনি চিত্রা হাজরাও। পুলিশের দাবি, তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, সে দিন অন্য দিনের তুলনায় বাড়তি কিছু পরোটা তৈরি করতে বলা হয়েছিল তাঁকে। মোট ২২টা পরোটা করেছিলেন তিনি। যার মধ্যে পাঁচটি তাঁকেই বাড়িতে নিয়ে যেতে বলা হয়। বাকি ১৭টির মধ্যে ১১টি পুলিশ উদ্ধার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, চিত্রাদেবী দাবি করেছেন, সে দিন বাড়িতে কেউ আসবেন কি না, সে সম্পর্কে তাঁকে বিজয়াদেবীরা কিছু জানাননি। পুলিশের দাবি, সেই সঙ্গেই চিত্রাদেবী পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই বাড়িতে সাধারণত বাইরের লোক কেউ আসতেন না, রাতে বা দুপুরে কাউকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোরও রেওয়াজ ছিল না। তবে সে রাতে ওই বাড়িতে যে কেউ আসবেন, তা বিজয়াদেবীরা আগে থেকেই জানতেন বলে এখন পুলিশের অনুমান। যে কারণেই অতিরিক্ত পরোটা করানো হয়েছিল। সেই ব্যক্তিই হাতে সন্দেশের প্যাকেট নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকেছিলেন বলে অনুমান পুলিশের। ওই প্যাকেট থেকে ৬টি সন্দেশ পাওয়া গিয়েছে। অন্তত আরও চারটি সন্দেশ সেখানে থাকার কথা বলে পুলিশের অনুমান। তাই পুলিশের সন্দেহ, সেই প্যাকেট থেকেই মাদক মেশানো তিনটি সন্দেশ আত্রেয়ীদের তিন জনকে দেওয়া হয়েছিল। তাতে তাঁরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তারপরে আত্রেয়ীয়ের মাথায় এবং বিজয়াদেবী ও প্রভাদেবীর বুকে আঘাত করা হয়। পুলিশ সুপার বলেন, “তবে কী দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, তা এখনও পরিষ্কার নয়।” তার পরে আত্রেয়ীদের শ্বাসরোধও করা হয়। তবে মাদকাচ্ছন্ন থাকার ফলে তিন জনের কেউই আততায়ীকে কোনও বাধা দিতে পারেননি।
বিজয়াদেবী ২০১২ সালের নভেম্বর থেকে জীবনবিমা নিগমের এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। আত্রেয়ীয়ের মাসি ইরা মিত্র জানিয়েছেন, জীবনবিমা করানোর জন্য ওই বাড়িতে বিজয়াদেবীর কাছে কখনও সখনও কয়েক জনকে আসতে দেখেছেন। ইরাদেবী বলেন, “বোনের বাড়ি গিয়ে অনেক সময়ে দেখেছি খাবার টেবিলে কোনও অচেনা ব্যক্তি বসে রয়েছেন। জীবনবিমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই তাঁদের ওই বাড়িতে আনাগোনা ছিল। কিন্তু তার মধ্যে এমন কাউকে মন পড়ছে না, যাঁর সঙ্গে ওই বাড়ির বেশ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল।”
জীবনবিমা নিগমে বিজয়াদেবী কাজ করতেন দেবাশিস ব্রহ্মচারীর অধীনে। তাঁকে এবং যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে দেবাশিসবাবুর সঙ্গে বিজয়াদেবীর যোগাযোগ হয়, সেই পীযূষকান্তি দাসের সঙ্গেও কথা বলেছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, জেরার মুখে কেউ কেউ তাঁদের জানিয়েছেন, জয়াদেবীদের পরিবারে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি ছিল না বলে তাঁদের মনে হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, বিজয়াদেবীর সংসার চলত প্রধানত প্রভাদেবীর টাকাতেই। জীবনবিমার এজেন্টের কমিশন হিসেবে বিজয়াদেবীর রোজগার দু’আড়াই হাজার টাকার বেশি হতো না। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের ধারণা হয়েছে, সব মিলিয়ে মাসে পরিবারের আয় ছিল ষোলো-সতেরো হাজার টাকার মতো। কিন্তু তাতে ওই সংসার যে ভাবে চলত, তার ব্যয় সঙ্কুলান সম্ভব নয় বলে পুলিশের কাছে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞানের ছাত্রী আত্রেয়ীর জন্য ছ’জন গৃহশিক্ষক ছিলেন। স্কুলেও তার বেতন ছিল পনেরোশো টাকা। স্কুলবাসে যাতায়াতের খরচও ছিল। প্রভাদেবীর ওষুধের জন্যও মাসে ভাল টাকা ব্যয় হত। মধ্যবিত্ত এই পরিবারের জীবনযাপনেও কখনও তেমন অভাবের চিহ্ন চোখে পড়েনি। পুলিশের দাবি, তদন্তের জন্য কথা বলার সময় বিজয়াদেবীদের ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কেউ তাঁদের জানিয়েছেন, এই পরিবারে অন্য কোনও সূত্র থেকে টাকা আসত কি না, তা নিয়েও তাঁদের সন্দেহ রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সব দিক খতিয়ে দেখেই তদন্ত এগোচ্ছে।
তবে প্রথমে অভিযোগের তির ছিল শুধু বিজয়াদেবীর স্বামীর দিকেই। ইরাদেবী সেই অভিযোগ করেছিলেন পুলিশের কাছে। তবে পুলিশ এখন শুধুই বিজয়াদেবীর স্বামীর দিকেই সন্দেহের আঙুল না তুলে রেখে, বাকি সব দিকও খতিয়ে দেখছে বলে জানা গিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, বছর দু’য়েক ধরে বিজয়াদেবীর পরিবারের সঙ্গে তাঁর স্বামীর কোনও যোগাযোগ নেই।
স্ত্রী ও মেয়ের খুনের ঘটনার পরেও তাঁকে বহরমপুরে দেখা যায়নি।
পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, সেই ব্যক্তি কোথায় রয়েছেন, তার খোঁজ প্রশাসনের কাছে রয়েছে। |