|
|
|
|
উত্তপ্ত বিতর্কের দিনে নায়ক দিন্দা-লক্ষ্মী
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু বাংলা ক্রিকেটের বর্তমান গতিপ্রকৃতি বোঝাতে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের নামটা বোধহয় আজ ধার করাই যায়।
একা এবং কয়েকজন।
চলতি রঞ্জি মরসুমে গ্রুপ ম্যাচ হোক কিংবা নকআউট, বাংলা ৫০-৪ হোক কিংবা ৩৬-৪, ইডেনের বাউন্ডারি লাইনের ধারে বঙ্গ ছাউনি থেকে যে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির চেহারাটাকে প্রায় রোজ বেরিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে, তিনি অবশ্যই ‘এক’ এবং একক মহানায়ক। বাকি দশ তাঁকে ঘিরে শুধু আবর্তিত হচ্ছে। কোনও দিন সে নামগুলো অশোক দিন্দা, কোনও দিন সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, কোনও দিন সৌরাশিস লাহিড়ী। পার্শ্বনায়কের চরিত্রের নামে অদলবদল ঘটলেও নায়ক ওই পাঁচ ফুট দশই থেকে যাচ্ছেন।
তিনি— লক্ষ্মীরতন শুক্ল। বাংলা অধিনায়ক।
ইডেনে রঞ্জি কোয়ার্টারের তৃতীয় দিনের যুদ্ধে প্রথম ইনিংসে শিরশিরে উত্তেজনার মধ্যে তিন রানের লিড নেওয়ার পরেও বাংলার পারফরম্যান্স গ্রাফ যখন ঝট করে নেমে গেল, মুরলী কার্তিকদের গালিগালাজ এবং বল নিয়ে ‘দুষ্কার্যের’ প্রভাবে যখন আচমকাই ম্যাচ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা, আচমকাই যখন তারা ৩৬-৪, রক্ষাকর্তা হিসেবে আবারও আবির্ভূত হলেন লক্ষ্মী। যিনি আজ চেয়েছিলেন ওই বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতেও কড়া প্রতিআক্রমণে যেতে। যিনি আজ চেয়েছিলেন, কার্তিকদের শত প্ররোচনাতেও মনঃসংযোগ হারিয়ে আউট হয়ে ফেরার ‘অপরাধ’ না করতে। |
অশোক দিন্দা: ১০৫ রানে ৬ উইকেট। শুক্রবারের ইডেনে। |
লক্ষ্মী ফেরেননি। আছেন। আপাতত ৬৩ নট আউট। সঙ্গে আছেন ঋদ্ধিমান সাহা। ৩০ ব্যাটিং। বাংলা ১৩৩-৪। লিড ধরলে ১৩৬-৪। ম্যাচের যা পরিস্থিতি, তাতে এখনও সেটা যে কোনও দিকে যেতে পারে। বাংলা বা রেল— যে কেউ এখনও জিততে পারে। কারণ এখনও দু’দিন বাকি। কিন্তু অক্সিজেন মাস্ক খুলে উঠে বসা রোগী যদি আবার আইসিসিইউ-এ ঢুকে যায়, তখন যে বিপদের পাগলাঘণ্টি বাজে, সেটা অন্তত লক্ষ্মী-ঋদ্ধির ইনিংসের পর আর নেই। শনিবারের ইডেনে বাংলা যদি রানটা তিনশোর আশেপাশে নিয়ে যেতে পারে, তা হলে স্লেজিং করে পার পাবেন না কার্তিকরা। ব্যাটিং করে ম্যাচটাও জিততে হবে, জিততে হবে তখন কঠিন ম্যাচ। কিন্তু আড়াইশোর নীচে যদি কিছু টার্গেট দাঁড়ায়, তা হলে সেটা আবার বাংলার পক্ষে অশনি সঙ্কেত। কারণ— তৃতীয় দিনের পরেও ইডেন পিচে কোনও পরিবর্তন নেই। কোনও ‘রাফ’ নেই। পুরনো বলেও বাউন্সার কাঁধে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সময় সময় ব্যাটসম্যান যেমন সুবিধে পাচ্ছে, তেমনই পাচ্ছেন পেসাররা। বাংলার যদি একটা লক্ষ্মীরতন শুক্ল থাকে, একটা ঋদ্ধিমান সাহা থাকে, তা হলে রেলেও কিন্তু একটা মহেশ রাওয়াত আছে। একটা অরিন্দম ঘোষ আছে।
চরম রোম্যান্টিসিজমের প্রেক্ষাপট তৈরি করেও বাংলার ‘বঞ্চিত’ সন্তান শুক্রবার সেঞ্চুরি পেলেন না। রেলের অরিন্দমকে আটকে যেতে হল ৯৭ রানে। কিন্তু তাতে ইডেনে উপস্থিত দর্শককুলের আক্ষেপ থাকার কথা নয়। পরিবর্তে তো তৈরি হল রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়া টেনশন এবং টানটান থ্রিলারের চিত্রনাট্য। অরিন্দম যখন আউট হন, তখন রেল ২৯৬-৮। বাংলার প্রথম ইনিংসের স্কোর টপকাতে চাই ২২ রান। হাতে দুটো উইকেট।
আধ ঘণ্টা পর— চাই ১২ রান, হাতে সেই দুটো উইকেট। পড়বে? না, পড়বে না?
কাঙ্খিত লিড হাতছাড়া হওয়া মানে পাঁচ দিনের ম্যাচেও একটা ধাক্কা নিশ্চয়ই। মনস্তাত্ত্বিক সুবিধেটা চলে যাবে, রেলও ইচ্ছেমতো ম্যাচটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জায়গায় চলে আসবে। কারণ চতুর্থ ইনিংসটা তারা খেলবে। প্রথম ইনিংসে এক বার কার্তিকের লিড পেয়ে যাওয়া মানে তাঁরা দ্বিতীয় বার ব্যাট করতে নেমে ড্রয়ের খেলাও খেলতে পারেন। তখন তাঁদের ম্যাচ না জিতলেও প্রথম ইনিংস লিডের তিন পয়েন্টের দাক্ষিণ্যে সেমিফাইনাল যাওয়া আটকাবে না। |
সুপার স্যাটারডে
সকালে ইডেন। |
কে তা হলে লিড নেবে? বাংলা? না রেল?
সৌরভ সরকার অফসাইড ফিল্ড সাজিয়ে টানা লেগস্টাম্পে ফেলে যাচ্ছেন। কখনও দু’রান, কখনও সিঙ্গল। ক্যাচও পড়ল দুটো। দিন্দা ঝাঁপিয়েও একটা কট অ্যান্ড বোল্ড ম্যানেজ করতে পারলেন না।
বাংলা পারবে? না, পারবে না?
বলতে না বলতে কৃষ্ণকান্ত উপাধ্যায় বোল্ড। দিন্দা চিত্কার করতে করতে লক্ষ্মীর দিকে ছুটছেন। রেল ৩০৭-৯। আর চাই ১১। বাংলার একটা। আরও সাতটা রান হল...দিন্দার বলে রঞ্জিত মালি একটা স্ট্রেট ড্রাইভ নিতে গেলেন...মিসটাইম হয়ে ক্যাচটা দিন্দার দিকেই আসছে...।
এবং বিস্ফোরণ।
‘বেঙ্গল এক্সপ্রেস’ নিজের ছ’নম্বর উইকেটটা নিয়ে যে দৌড়টা তার পর দিলেন, যে ভাবে লিড নেওয়ার বলটা দর্শকদের দেখাতে দেখাতে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেন, বাংলা শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালে যদি ওঠে, তা হলে ওটা স্বপ্নের ফ্রেম হওয়া উচিত। উল্টো দিকে একটা মহম্মদ শামি ছাড়াই দিন্দা যে বোলিংটা করছেন, তাকেও স্বপ্নের বলা চলে। উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে সাত উইকেট নিয়ে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। এ দিন ছ’টা নিয়ে লক্ষ্মীর বাংলাকে আবার ফ্রন্টফুটে নিয়ে এলেন। রেল বনাম বাংলা কোয়ার্টার যুদ্ধ দেখতে ইডেনে এখনও পর্যন্ত কোনও জাতীয় নির্বাচকের খোঁজ নেই। যদি কেউ আসতেন, দিন্দার বোলিং দেখে অপরাধবোধে তাঁর মুখ বোধহয় কালো হত। কিন্তু ম্যাচটা এখনও জেতা হয়নি। যদি আবার এ রকম আগুনে বোলিং দরকার হয়, তখন? রেলকে যদি আবার এ ভাবে চূর্ণ করতে হয়, তখন? পারবেন?
দিন্দা শুনিয়ে রাখলেন, রেল নাকি চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং না-ও পেতে পারে। আর যদি নামেও বা, আবার দেখে নেবেন!
পয়েন্টের উপর দিয়ে এলআরএস-এর বিশাল ছক্কাটার মতো এই উত্তরও রেলের জ্বলুনি বাড়াবে বই কমাবে না। |
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলা ৩১৭ ও ১৩৩-৪(লক্ষ্মী ৬৩ ব্যাটিং, ঋদ্ধিমান ৩০ ব্যাটিং, অনুরীত ৩-৪১),
রেল ৩১৪ (দিন্দা ৬-১০৫, শিবশঙ্কর ৩-৪৭)। |
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
পুরনো খবর: রেলের ‘ডাবল ইঞ্জিনে’ ধাক্কা খেল দিন্দাদের দৌরাত্ম্য |
|
|
|
|
|