রেলের ‘ডাবল ইঞ্জিনে’ ধাক্কা খেল দিন্দাদের দৌরাত্ম্য

থাটা শোনামাত্র চোয়াল শক্ত অশোক দিন্দার। ভ্রূ কুঁচকে জানতে চাইলেন, ঠিক কী হয়েছে?
বঙ্গ মিডিয়াকুল তাঁকে গড়গড়িয়ে বলে গেল, মহেশ রাওয়াত শুনিয়ে গিয়েছেন যে আপনি যত শর্ট করবেন, উনি তত পুল করে ফেলে দেবেন, যেমন আজ দিলেন!
আর পারবেন আটকাতে?
গাড়ির দরজা সশব্দে বন্ধ করার আগে ঘুরে তাকালেন এক বার। “তাই? কিন্তু আমি শর্ট করার আগেই তো ও সেট হয়ে গিয়েছিল। ভরসা রাখুন, কাল নিয়ে নেব!”
ইডেনে চার ঘণ্টার চূড়ান্ত থেঁতলানির পর ‘বেঙ্গল এক্সপ্রেসের’ এমন মনোভাব নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু দিন্দা প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করতে পারবেন, কে জানে! ইডেনে বৃহস্পতিবারের পর কোয়ার্টার-যুদ্ধে অ্যাডভান্টেজ ‘টিম এলআরএস’, আর বোধহয় বলা যাবে না। এক নয়, একসঙ্গে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ চালিয়ে রেল শুধু ম্যাচে মহানাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটায়নি। ম্যাচকেও ঢুকিয়ে ফেলেছে এমন এক জংশনে যেখান থেকে সেমিফাইনালে যাওয়ার ‘বুকিং’-টা রেলও করিয়ে ফেলতে পারে। ঠিক যতটা এখনও পারে বাংলা।
কতটা নাটকীয় সেই প্রত্যাবর্তন? দু’টো দৃশ্যের বর্ণনায় বোধহয় স্পষ্ট হবে।
দুপুর সাড়ে বারোটা। লাঞ্চ শেষ। ডেল স্টেইনের পরিচিত ভঙ্গিমায় পরপর তিনটে ‘কিলার পাঞ্চ’ দিয়ে ক্লাবহাউসে উপস্থিত জঙ্গি বঙ্গ-সমর্থকদের মধ্যে প্রায় আগুন ধরিয়ে দিলেন দিন্দা। রেল ৩৮/৩। এক মিনিটের মধ্যে শিবশঙ্করের রণহুঙ্কার— রেল ৩৮/৪! মাঝে কয়েকটা বল, একটা বাউন্ডারি এবং আবার দিন্দা! মুরলী কার্তিকরা বিধ্বস্ত। রেল— ৪২/৫।
বিকেল সাড়ে তিনটে। স্ট্রেট ড্রাইভটা মেরে দৌড়তে দৌড়তে শূন্যে একটা লাফ দিলেন অরিন্দম ঘোষ। একটু দূরে লক্ষ্মীরতন শুক্ল সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। কাকে বল দেবেন? দিন্দা? লাইন খুঁজে পাচ্ছেন না। শর্ট পড়ছে। শিব? ক্লান্ত, শরীর দিচ্ছে না। অধিনায়ক নিজে? প্রভাবহীন।
রেলও ৪২-৫ থেকে ২৩৩-৫-এ চলে গেল। একটা ১৯১ রানের অপরাজিত পার্টনারশিপে। ঋদ্ধিমান সাহার ৮৭, বাংলার ৩১৭, লোয়ার অর্ডারে দিন্দা-শিবশঙ্করের ভাল ব্যাটিং— সব ব্যাকফুটে পাঠিয়ে।

দুপুর ১২-৪৫

বিকেল ৪-৩০
অশোক দিন্দা। রেল ৪২-৫। লক্ষ্মীরতন শুক্ল। রেল ২৩৩-৫।
বিকেলে এক বাংলা নির্বাচক আতঙ্কিত মুখে ঘুরছিলেন। মহেশ রাওয়াতকে দেখে তাঁর মনে হচ্ছে ম্যাচে নয়, নেটে ব্যাট করছেন! কিন্তু তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। চলতি রঞ্জিতে মহেশ এবং অরিন্দমের সম্মিলিত রান প্রায় চোদ্দোশো। এই দুইয়ে নিয়ম করে চলতি রঞ্জিতে রেলকে টানছেন, বাংলার বিরুদ্ধে নামার আগে দু’জনেরই রান সাড়ে ছ’শোর উপর ছিল। বরং আশ্চর্যের হচ্ছে বাংলা অধিনায়কের স্ট্র্যাটেজি। শিবশঙ্কর-দিন্দারা লম্বা স্পেল করে-করে ক্নান্ত হয়ে পড়ছেন দেখেও তিনি কেন সৌরাশিস লাহিড়ীর কথা ভাবলেন না? গোটা দিনে তাঁকে দেওয়া হল মাত্র তিনটে ওভার। অথচ আগের তামিলনাড়ু ম্যাচে একাই সাত উইকেট নিয়ে বাংলাকে জিতিয়েছেন সৌরাশিস! রঞ্জিতে এখনও পর্যন্ত যাঁর ১৫২ ওভার বল করে কুড়িটা উইকেট আছে। কোচ অশোক মলহোত্র— তিনিও তো মাঠে সৌরাশিস নিয়ে অধিনায়ককে একটা বার্তা পাঠাতে পারতেন। দু’টোর একটাও হল না। পরে লক্ষ্মী স্বীকার করলেন, ভুল হয়েছে। পেসারদের দিয়েই কাজ হবে ভেবে সৌরাশিসকে আর ডাকেননি। কিন্তু বাংলাকে যদি এমন পর্বতসম পার্টনারশিপ ভাঙতে হয়, তা হলে ইডেনে সবুজ আভা পিচেও স্ট্র্যাটেজি পাল্টাতে হবে অধিনায়ককে। ফাটকা খেলতে হবে। নতুন কিছু ভাবতে হবে। শুক্রবার আনতে হবে সৌরাশিসকে। তিনি এবং দিন্দা— এঁরা দুই ছাড়া বঙ্গ বোলিংয়ে নির্ভরযোগ্য ব্রহ্মাস্ত্র আর কোথায়? গ্রিন টপে উত্তরপ্রদেশ ম্যাচে সৌরাশিসকে এক ওভারও দেননি অধিনায়ক। কিন্তু রোজ-রোজ এক স্ট্র্যাটেজি না-ও চলতে পারে। কখনও কখনও ভুলের ক্ষমা না-ও হতে পারে।
আজ যেমন দিন্দার একটা ভুলের ক্ষমা হল না। স্কোরবোর্ডে ৪২-৫ দেখে অতি উত্তেজনার চোটে কি না কে জানে, স্টাম্প টু স্টাম্প ছেড়ে রাওয়াতকে অফস্টাম্পের বাইরে বল করে গেলেন। উত্তরে পরপর ছ’বলে ছ’টা বাউন্ডারি গিলতে হল! আর ওই যে ‘বেঙ্গল এক্সপ্রেস’-এর দৌরাত্ম্যের বারোটা বাজল, পরবর্তী চার ঘণ্টায় তো ফিরলই না বরং টিমের এক নম্বর পেসারকে চোখের সামনে গুঁড়িয়ে যেতে দেখে বাকি পেস-ব্যাটারির কাঁধও ঝুলে গেল। মহেশ আপাতত ১০৫। তাঁর ব্যাটিং-বর্ণনায় বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীর যন্ত্রণা বাড়িয়ে লাভ নেই। পরের দিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পেসারদের মেরে দিলেন। এবং তাঁর তাণ্ডবের চোটে বাংলা টেরও পেল না, উল্টো দিকেও এক ‘উপেক্ষিত’ বঙ্গসন্তান আস্তে আস্তে নতুন ভোগান্তির প্রেক্ষাপট তৈরি করছেন।
তিনি— অরিন্দম ঘোষ। ময়দান যাঁকে ডাকত ‘নিঃশব্দ ঘাতক’ নামে!
নিঃশব্দ ঘাতক কারণ বাইশ গজে যে অরিন্দম বলে কেউ আছেন, সেটা নাকি প্রথম দিকে বোঝা যায় না। প্রথম দশ-কুড়ি রান করতে প্রচুর সময় নিয়ে ফেলেন বলে। এবং বাংলাতেও নিজের ক্রিকেটজীবনের প্রচুর সময় খরচ করেছেন অরিন্দম। রেলের অবৈতনিক কর্মী হিসেবে বসে থেকেছেন বাংলায় খেলার আশা নিয়ে। বাংলা তাঁকে ‘উপহারে’ বঞ্চনা আর উপেক্ষা ছাড়া কিছু দেয়নি। দিনের পর দিন টুয়েলফথ ম্যান করে ফেলে রেখেছে। বর্তমানে যিনি রেলে, এখন যিনি বাংলার বিরুদ্ধে ৭৮ ব্যাটিং। প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ক রাজু মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, তিনি যেমন বাংলার জয় চান, ঠিক তেমনই চান অরিন্দমের সেঞ্চুরি। শোনা গেল, সুদীপ-ঋত্বিকের মতো সৃষ্টি অ্যাকাডেমির অরিন্দমও নাকি গত রাতে ছোটবেলার কোচ প্রসেনজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলে ফেলেছেন যে, বাংলা যত পারে তুলুক। তিনি সেঞ্চুরি করেই মাঠ ছাড়বেন।
আজ তাঁর বাংলার বিরুদ্ধে বহু কাঙ্খিত সেঞ্চুরি আসবে কি না, জানা নেই। কিন্তু বৃহস্পতিবার অরিন্দমের একটার পর একটা কভার ড্রাইভে, এগারোটা বাউন্ডারিতে, হাফসেঞ্চুরির পর উল্লাস-লাফে, বারবার ব্যাট ঝাঁকানোর সময় শিরা-উপশিরায় লোহিতকণার দৌড়োদৌড়ি বৃদ্ধিতে বোধহয় একটা বার্তাই বেরিয়ে এল।
বাংলা, তোমার জন্য!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

বাংলা ৩১৭ (সুদীপ ৯৬, ঋদ্ধি ৮৭)
রেল ২৩৩-৫ (মহেশ ১০৫ ন:আ:, অরিন্দম ৭৮ ন:আ:, দিন্দা ৩-৮৩, শিব ২-৩৬)।

ছবি শঙ্কর নাগ দাস।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.