বাংলার চিত্রনাট্যে নাটক, ধ্বংস আর সৃষ্টি

ভৌগোলিক অবস্থানে দু’টো ক্রিকেট-স্টেডিয়ামের দূরত্ব কতটা হবে? কম করে হলেও হাজার দেড়েক কিলোমিটার।
একটা নয়াদিল্লি। একটা কলকাতা।
একটা জামিয়ামিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ড। একটা ইডেন গার্ডেন্স।
কিন্তু এত দূরত্বেও রেল বনাম বাংলা যুদ্ধের আগুন পুরো নিভল কোথায়? মহারণের উত্তপ্ত চিত্রনাট্য যদি নয়াদিল্লি দেখে থাকে, তা হলে কোয়ার্টার-যুদ্ধের প্রথম দিনে ইডেন যা দেখল, তা-ও যথেষ্ট নাটকীয়।
আর নায়ক? কেন, অশোক দিন্দা!
প্রথম দিনের খেলা সবে শেষ। পাল্টা দিয়ে বঙ্গ-দুর্গের সম্পূর্ণ পতন রক্ষা করে ফিরছেন ঋদ্ধিমান সাহা ও দিন্দা। ইডেনে উপস্থিত হাজার চার অপরাজিত দুইকে দেখে উন্মত্ত।
প্রত্যুত্তরে মাথার উপর বেশ কয়েক বার ব্যাট ঘুরিয়ে দিলেন দিন্দা!
মুরলী কার্তিকের রেল ইডেনে নিজ-আচরণকে নয়াদিল্লির মতো ‘অভব্যতা’-র পর্যায়ে নিয়ে যায়নি। কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন কিছু করেছে, যা স্ফুলিঙ্গ তৈরি করতে পারত। কার্তিকরা অক্লান্ত ভাবে অহেতুক অ্যাপিল করেছেন, দিন্দাকে স্ট্রাইকে আনার জন্য বলকে ‘ইচ্ছাকৃত’ বাউন্ডারিতে যেতে দিয়েছেন। স্লেজিং চলেছে? বঙ্গ পেসার কিছু বললেন না। তবে ব্যাট হাতে তাঁর বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ অন্য কথা বলল।
পরপর দু’টো বাউন্ডারি মেরে বাংলা ড্রেসিংরুমের দিকে ব্যাট উঁচিয়ে দেখালেন একবার। কার্তিক একবার বোলিং রান আপের দিকে ফিরে যাওয়ার সময় সে দিকে মুখ করে দিন্দাকে ‘শ্যাডো’ করতে দেখা গেল! টুকটাক জবাব-পাল্টা জবাবও চলছে। কিন্তু তাতে বিতর্ক কম, নাটকের উপাদান বেশি। দিন্দার ব্যাটিং দেখে ইডেন ছাড়ার সময় বাংলা কোচ রসিকতার মেজাজে বলে গেলেন—“সচিন নেই তো কী, দিন্দা এসে গিয়েছে!”


রেলকে বেলাইন করার চেষ্টায় সুদীপ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
“মাঠে নামার সময় নিজেকে বলেছিলাম, আমাকে আজ ভাল ক্রিকেট খেলতে হবে।
আউটের বলটায় সিঙ্গলস নিতে গিয়েছিলাম। খোঁচা লেগে গেল। সেঞ্চুরি না পাওয়ায় অবশ্যই হতাশ।
তবে তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে দুটো ইনিংসের চেয়ে আজকের ৯৬ বেশি ভাল।” —
তবে ম্যাচে একটা সময় পর্যন্ত যা চলছিল, তাতে রসিকতার বিশেষ জায়গা ছিল না। দিনের শেষে বাংলাকেও কিছুটা স্বস্তিতে দেখানোর কথা নয়, কয়েকটা ভাল ইনিংস না থাকলে। গোটা দিনে বঙ্গ ব্যাটিংকেও খুব সহজে ভেঙে ফেলা যায়।
ধ্বংস। সৃষ্টি। ধ্বংস। সৃষ্টি।
সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে। প্রত্যেকটা শট খেলার আগে একবার করে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন, তার পর স্টান্স নেবেন! জিজ্ঞেস করলে বললেন, ওটা নাকি তাঁর ‘ট্রিগার মোমেন্ট’। বাংলার ভাগ্য ভাল, আজ এই বাইশ বছরের তরুণের ‘ট্রিগারে’ চাপ পড়েছিল, নইলে কী হত কে জানে! ইডেন-দর্শক তখনও গুছিয়ে বসতে পারেনি, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও এসে পৌঁছননি, কিন্তু বাংলার দু’উইকেট উড়ে গিয়েছে তিন রানে। অনুরীত সিংহের বল অরিন্দম দাসের ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে মিডল আর লেগস্টাম্প শুইয়ে দিল। পরের বলেই ছাড়তে গিয়ে শুভময় দাস বোল্ড! ইডেনের সবুজ পিচে ওই অবস্থায় নামলে টেনশন হত না, সিনিয়ররাও বোধহয় বলতে পারতেন না। কিন্তু ওই অবস্থায়, হিংস্র রেল পেসারদের খেলার চাপ সামলে মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে গেলেন সুদীপ।
২৬৪ মিনিট। ১৭৬ বল। চোদ্দোটা বাউন্ডারি। ৯৬!
যে ইনিংসে আউটের বলটা ছাড়া আর একটাও ভুল শট ছিল না। যে ইনিংসে শুধু নিজেকে নয়, উনিশ বছরের সতীর্থ ব্যাটসম্যান অভিমন্যু ঈশ্বরণকে নির্ভরতা দেওয়ারও দায়িত্ব ছিল। অভিমন্যু প্রথম দিকে একটু নড়বড়ে ছিলেন, পরে বেপরোয়া। সন্ধের দিকে ময়দানে প্রশংসা চলল, সুদীপের টেম্পারামেন্ট নিয়ে। উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে গ্রিন টপে কঠিন পরিস্থিতিতে ৬৬। তামিলনাড়ুর স্কোয়্যার টার্নারে দু’ইনিংসে চল্লিশের কাছাকাছি রান। আজ ৯৬। কোথাও তো আটকাননি বাঁ হাতি বঙ্গসন্তান। ক্রিকেটমহল বলছে, ছেলেটা মনোজ তিওয়ারির জায়গায় নেমে এ রকম খেলল। রঞ্জি মরসুমের শুরু থেকেই তো খেলানো উচিত ছিল সুদীপকে। বাংলার ম্যাচ দেখতে এসে প্রাক্তন বঙ্গ অধিনায়ক চুনী গোস্বামী মুগ্ধ, “ছেলেটা টেস্ট মেটিরিয়াল। বাংলার ও-ই ভবিষ্যৎ।” জানা গেল, বঙ্গ ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় ডাভ হোয়াটমোর পর্যন্ত সুদীপের কোচবিহার ট্রফির একটা ইনিংস দেখে সিএবিকে লিখিত ভাবে বলেছিলেন যে, এমন প্রতিভাকে অবিলম্বে ভাল কোচের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত।
কেন বলেছিলেন, বোঝা গেল অভিমন্যুর সঙ্গে তাঁর ১৬৩ রানের পার্টনারশিপে। বোঝা গেল বিদ্যুৎ গতিতে সুদীপের কাট-ড্রাইভগুলো বাউন্ডারিতে আছড়ে পড়তে দেখে।
আশ্চর্যের হচ্ছে, এমন ইনিংসের পরেও বিপদে পড়েছিল বাংলা। ৩-২ থেকে ১৬৬-২-তে পৌঁছে, ম্যাচের ‘রিমোট কন্ট্রোল’ নিয়েও। লক্ষ্মীরতন শুক্ল যে ভাবে আউট হলেন, তাতে তাঁর যত না দোষ, তার চেয়ে বেশি দুর্ভাগ্য। কার্তিকের বলে সপাট সুইপ ফরোয়ার্ড শর্ট লেগের কাঁধে লেগে চলে গেল উইকেটকিপারের হাতে। রেলের ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ এ দিন আর ফিরতে পারেননি, কিন্তু বাংলা অধিনায়ককে ফিরতে হল। মাঝে একটা সময় ৬৭ রানে পাঁচ উইকেট চলে গেল বাংলার। ঋদ্ধিমান টানছেন, কিন্তু টেল এন্ডারদের নিয়ে। বৃহস্পতিবার সকালে বাংলা ইনিংস কত দূর যাবে, সময় বলবে। কিন্তু স্কোরটা তিনশো পঁচিশ থেকে সাড়ে তিনশো গেলে ভাল।
যদিও বঙ্গ শিবির রাতে সে সব অঙ্কে বিশেষ পাত্তা দিল না। বরং বলা হল, ব্যাট যথেষ্ট হয়েছে। অশোক দিন্দা নাকি এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতে লাল বলটা চান!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

বাংলা ২৭৪-৮ (সুদীপ ৯৬, অভিমন্যু ৬৫, ঋদ্ধিমান ব্যাটিং ৬০, অনুরীত ৪-৭৫)।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.