|
|
|
|
বল বিকৃতির দায়ে রোষে মুরলীরা
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা |
পাগলের মতো ক্লাব হাউস গেট দিয়ে এক বার বাইরে যাচ্ছেন, এক বার দৌড়ে ভেতরে ঢুকে আসছেন মুরলী কার্তিক। হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছেন উগ্র সমর্থকের কাছে! অসংখ্য ক্যামেরার গুঁতোগুঁতি, ইলেকট্রনিক চ্যানেলের বুম অগ্রাহ্য করে কাকুতি-মিনতি করে চলেছেন, “দাদা, মুঝে ছোড় দিজিয়ে! আমাকে ছেড়ে দিন। আমিও মানুষ। ভুল আমারও হয়।”
ক্ষিপ্ত অনুরীত সিংহ মুহুর্মুহু তেড়ে যাচ্ছেন বঙ্গ সমর্থকদের দিকে। অশ্রাব্য গালাগাল থেকে ধাক্কাধাক্কি— কোনও কিছুই বাদ দিচ্ছেন না! এক জন কানের কাছে চিত্কার করে ‘ট্যাম্পারিং কেন করেছ’ বললেন কি বললেন না, রেলওয়েজ পেসার হিংস্র ভঙ্গিতে ছুটে গেলেন ওই সমর্থকের দিকে। প্রথমে এক রামধাক্কা এবং চিত্কার, “গুলি করে তোমাকে উড়িয়ে দেব! আর কাল মাঠে ওড়াব বাংলাকে!”
ড্রেসিংরুমের বাইরে একটার পর একটা হুঙ্কার ছাড়ছেন বাংলা ম্যানেজার দেবব্রত দাস। “ওরা ক্রিকেটার? ছিঃ! লজ্জা করে না এ ভাবে ক্রিকেট খেলতে? জানেন, বলের চামড়া টেনে তুলে নিয়েছে! উপরে যদি ঈশ্বর থাকেন, রেল এই ম্যাচ জিতবে না!”
ক্রিকেটের স্বর্গোদ্যান নয়, শুক্রবারের ইডেন কুরুক্ষেত্র! দিল্লির পর আবার উত্তপ্ত রেল বনাম বাংলা ম্যাচ। যার কেন্দ্রে মুরলী কার্তিক ও তাঁর টিমের বিরুদ্ধে বল-বিকৃতির অভিযোগ। যে অভিযোগে ম্যাচ শেষে তাঁদের কার্যত ইডেনে অবরুদ্ধ হয়ে যেতে হল।
প্লেয়ার বনাম সমর্থক উত্তেজনা-জনিত কলঙ্ক ইডেনের ইতিহাসে অবশ্য আগেও ছিল। অতীতে এই মাঠই দেখেছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বাদ দেওয়ার পর কলকাতায় গ্রেগ চ্যাপেলের ভারতের তীব্র ধিক্কার-ধ্বনির মুখে পড়ে যাওয়া। যার পর মুম্বইয়ে নেমে রাহুল দ্রাবিড় বলে ফেলেছিলেন, “মনে হচ্ছে যেন দেশে ফিরলাম!” তারও আগে দেখেছে শোয়েব আখতার সন্দেহজনক ভাবে সচিন তেন্ডুলকরকে রান আউট করার পর বিদ্রোহের আগুন কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। ’৯৯-এ এশীয় টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সেই ম্যাচের স্মৃতিতে খুব ধুলো জমেছে কি? |
সেই মুহূর্ত। আম্পায়ার সতর্ক করছেন মুরলীকে। |
কিন্তু কোনও রঞ্জি ম্যাচকে ঘিরে এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হতে কবে দেখেছে ইডেন? সূদূর ’৬২ সালে বাংলা বনাম হায়দরাবাদ রঞ্জি ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেসার গিলক্রিস্টের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল বাংলা অধিনায়ক পঙ্কজ রায়ের। চুনী গোস্বামীর সেটা ছিল প্রথম রঞ্জি ম্যাচ। প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ক রাতে বলছিলেন, “গিলক্রিস্ট খেলছিল হায়দরাবাদের হয়ে। পঙ্কজদাকে পরপর বাউন্সার দেওয়ার পর বেশ কিছু দর্শক তেতে গিয়েছিলেন। গিলক্রিস্টও তাঁদের দিকে পাল্টা অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন। কিন্তু যা শুনলাম, এত কিছু হয়নি সে দিন।” সাম্প্রতিক অতীতেও এমন কিছু ঘটেছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। এবং এত দিন যে অভিযোগ উঠত মূলত পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে, ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রম, শোয়েব আখতার সবার বিরুদ্ধে— সেই বল-বিকৃতির অভিযোগ এ বার রঞ্জিতেও উঠল। উঠল মুরলী কার্তিক ও তাঁর টিমের বিরুদ্ধে।
ঠিক কী হয়েছিল?
বাংলা বনাম রেলওয়েজ যুদ্ধে লক্ষ্মীরতন শুক্লদের দ্বিতীয় ইনিংসের ন’নম্বর ওভার চলছে তখন। আচমকাই বাংলা শিবির আবিষ্কার করে যে, বল রিভার্স সুইং করতে শুরু করে দিয়েছে, যেটা এত তাড়াতাড়ি অসম্ভব। এবং বলতে না বলতে অভিমন্যু ঈশ্বরণের স্টাম্প সেই রিভার্স সুইংয়েই ছিটকে যায়। গোলমেলে কিছু ঘটছে আঁচ করে বাংলা শিবির থেকে প্রথমে ফিল্ড আম্পায়ারদের সতর্ক করা হয়। তার পর বল এক বার দেখতেই নাকি পরিষ্কার হয়ে যায় পুরো ব্যাপারটা।
বলের এক দিকের চামড়া ক্ষতবিক্ষত। টেনে-টেনে মোটামুটি ছিঁড়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। যার ফল, ইনিংসের গোড়া থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে রিভার্স সুইং!
শোনা গেল, ওই ঘটনার পর আর এক মুহূর্ত দেরি করা হয়নি। সোজা ম্যাচ রেফারি রাজেন্দ্র জাডেজার কাছে দৌড়ন বাংলার কোচ অশোক মলহোত্র এবং ম্যানেজার। সরকারি ভাবে অভিযোগ করা হয়— বল বিকৃতি চলছে, বন্ধ করুন। আম্পায়ারের কাছেও নির্দেশ চলে যায় মুহূর্তে। কার্তিককে ডেকে পাঠান আম্পায়ার। আরও কয়েক জন রেল ক্রিকেটারকে ডাকা হয়। বল দেখিয়ে নাকি রেল ক্যাপ্টেন কার্তিকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এটা কী চলছে? তাঁকে সতর্কও করে দেওয়া হয়। প্রেসবক্স থেকে দেখা যাচ্ছিল যে, বারবার বল নিয়ে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন কার্তিক। আম্পায়াররা সে সবে পাত্তা না দিয়ে বল পাল্টে দেন কয়েক ওভার পর থেকে। এবং তার পর যত বার কার্তিকের কাছে বল যাচ্ছিল, তত বার দেখা গিয়েছে আম্পায়ার ঘুরে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কার্তিকের দিকে! ভুল হল, কার্তিকের হাতের দিকে।
খেলা শেষে ম্যাচ অফিশিয়ালদের পিচের কাছে নিয়ে গিয়ে একটা স্পট দেখিয়ে নাকি রেলের পক্ষ থেকে এমনও বলা হয় যে, ওখানে পড়েই বলকে ও রকম ক্ষতবিক্ষত দেখাচ্ছিল। টিমের পক্ষ থেকে সরকারি বক্তব্য যদিও উল্টো। কোচ অভয় শর্মা বলে গেলেন, বাউন্ডারির লোহার বোর্ডে লেগে-লেগে নাকি ওই অবস্থা। কোনও যুক্তিতেই চিঁড়ে ভেজেনি। কার্তিকের নামে বল নিয়ে ‘দুষ্কর্মে’র অভিযোগ পেশ করে দেন আম্পায়াররা। |
গুলি করে তোমাকে উড়িয়ে দেব! আর কাল
মাঠে ওড়াব বাংলাকে! সমর্থককে হুমকি অনুরীতের। |
পরে ম্যাচ রেফারি জাডেজা বলেছেন, “বলটা ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল। বল নিয়ে একটা ইস্যু আছে। রেলকে সতর্কও করা হয়েছে।” বিকৃতিই ঘটানো হয়েছে কি না, পরিষ্কার করে বলতে চাননি ম্যাচ রেফারি। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণ হলে কী শাস্তি হতে পারে কার্তিকের? আইসিসি ম্যাচ রেফারি রাজু মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “আমি যা শুনলাম তাতে কার্তিককে ফার্স্ট অ্যান্ড ফাইনাল ওয়ার্নিং দিয়ে ছাড়া হয়েছে। এখন ওর জরিমানা বা অন্য কোনও শাস্তি হবে না। কিন্তু আর এক বার যদি ও এটা করে, তা হলে কিন্তু বোর্ডের কোড অব কনডাক্টের লেভেল টু ধারায় পড়ে যাবে। তখন নির্দিষ্ট প্লেয়ারকে ধরতে না পারলে কার্তিকেরই ম্যাচ ফি-র পঞ্চাশ থেকে একশো শতাংশ কেটে নেওয়া হবে। যেহেতু ও ক্যাপ্টেন।”
অর্থাত্, অপরাধ করেও কার্তিক আপাতত বেঁচে যেতে পারেন। আর্থিক শাস্তির সম্মুখীন না-ও হতে পারেন। কিন্তু বাংলার দর্শককুল তাঁর সঙ্গে যা চালিয়ে গেল ওই ঘটনার পর থেকে, সেটাও কম শাস্তি কি?
বাংলার ম্যাচ থাকলে ভদ্রলোককে দেখা যায়। নাম— মুকুল ভট্টাচার্য। কার্তিকের বল বিকৃতির ব্যাপারটা জানাজানি হতেই ক্লাব হাউস থেকে রেল ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ করে বাছা-বাছা বিশেষণ প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন তিনি। বিকেল সাড়ে চারটের পর যেটা আরও বাড়ল। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর কার্তিকের জন্য ড্রেসিংরুমের বাইরে অপেক্ষা করে ছিলেন ওই উগ্র সমর্থক। রেল অধিনায়ক বেরোতে না বেরোতেই ‘কার্তিক গো ব্যাক’, ‘বিকৃতি কেন করেছ’— মার্কা চিত্কার করতে শুরু করে দেন। তাঁর মুখের সামনে তারস্বরে বাঁশিও বাজিয়ে দেওয়া হয়। কার্তিক এক বার তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হয়নি। ইতিমধ্যে রেল অধিনায়ক ইডেন ছেড়ে বেরোতে যেতেই এত ক্ষণের বিদ্রূপটা বিস্ফোরণে বদলে যায়। বাইরে কয়েকশো লোকের জমায়েত থেকেও তখন ‘কার্তিক, কোর্টনি ওয়ালশকে দেখে শেখো’ জাতীয় কথাবার্তা উড়ে আসতে থাকে। প্রচারমাধ্যমের দাপাদপিও বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
প্রথমে কিছু বলছিলেন না কার্তিক। হাতজোড় করে ক্ষমাও চাইলেন। কিন্তু পরে মেজাজ হারিয়ে বলতে থাকেন, “আমি তিন বছর এই শহরে ছিলাম। কখনও এ ভাবে অপমানিত হইনি। এটা আপনাদের শহরের সভ্যতা?” তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, আপনি বল-বিকৃতি করেছেন, না করেননি? কার্তিক ফুঁসে উঠে বলে দেন, “যা জানার ম্যাচ রেফারির কাছে জেনে নিন না। আমাকে বলছেন কেন? আমি কিছু বলব না।” তত ক্ষণে নতুন আগুন ধরে গিয়েছে। ওই সমর্থকের দিকে তেড়ে গিয়েছেন রেল পেসার অনুরীত। সঙ্গে হিংস্র হুঙ্কার— গুলি করে উড়িয়ে দেব!
বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। ঘটনার সময় কোনও সিএবি কর্তাকে দেখা যায়নি আশেপাশে। পুলিশও পর্যাপ্ত ছিল না। অসহায় ভাবে দু-চার জনকে ঘুরতে দেখা গিয়েছে। সিএবি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া বললেন, “কাল থেকে নিরাপত্তা বাড়ানো হবে। আমরা কথা বলে দেখছি যাতে এ রকম কোনও কাণ্ড না ঘটে।” কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, রেল বনাম বাংলা ম্যাচ যে নিরামিষ যুদ্ধ হবে না, সেটা তো আগেভাগেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল। নয়াদিল্লিতে যা ঘটেছিল, তা নিয়ে এমনিতেই বাংলা ড্রেসিংরুম উত্তপ্ত ছিল। তার পর কোয়ার্টার ফাইনালে লোক আনার জন্য প্রবল ভাবে নেমে পড়েছিল সিএবি। লোক এসেওছে। ইডেনে হাজার পাঁচেক বসে রঞ্জি দেখছেন— এমন দৃশ্য বহু দিন দেখেনি বঙ্গ ক্রিকেট। তাই প্রশ্ন উঠছে, কেন আরও সতর্ক হয়নি সিএবি?
রাতে এক কর্তা বললেন, তাঁরা আন্দাজ করতে পারেননি এমন হতে পারে। ভেবেছিলেন, কিছু ঘটলে মাঠে হবে। মাঠের বাইরে নয়। এক দিক থেকে বোধহয় সেটাও ঠিক। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া মাঠে গ্রুপ লিগের বাংলা বনাম রেল ম্যাচে সন্দীপন দাসকে চরম বিতর্কিত ভাবে কার্তিকের আউট করা, অশোক দিন্দার সঙ্গে অভব্য আচরণ— সব কিছুর প্রতিশোধ যে ইডেন এ ভাবে নেবে, সেটাই বা কে জানত! |
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
|
|
|
|
|