পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের অপসারণের পথ অবশেষে প্রশস্ত করে দিল মনমোহন সিংহের সরকার। এক ইন্টার্নকে যৌন হেনস্থা-সহ তিন দফা অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি যাতে সুপ্রিম কোর্টকে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন, সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রস্তাবে আজ অনুমোদন দিল
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর আগামিকালই এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে সুপারিশ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী, এর পর বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তদন্ত করে সুপ্রিম কোর্টকে তার মতামত জানানোর জন্য নির্দেশ দেবেন রাষ্ট্রপতি। সর্বোচ্চ আদালতের মত জানার পরে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে প্রাক্তন বিচারপতির অপসারণের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন রাষ্ট্রপতি।
বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আমাকে সরকারি ভাবে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। তবে কে কোথায় কী পদক্ষেপ করবে, সেটা তো আমার হাতে নয়। আমি কিছু বলতেও পারব না। সময় সব বলবে। আমাকে এখন অপেক্ষা করতে হবে আর ভবিষ্যতে কী ব্যবস্থা নেব, সেটা চিন্তা করতে হবে।”
সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের কমিটি এর আগে যৌন হেনস্থার অভিযোগ নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত করে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা অশোকবাবুর বিপক্ষেই গিয়েছে। তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, তাই তাঁর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট কোনও কমিটি গড়তে পারে কি না, তার যৌক্তিকতা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন অশোকবাবু। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়ে তিনি বলেছেন, যে ভাবে সর্বোচ্চ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করেছে, তার কোনও আইনি ভিত্তি নেই। ওই চিঠির প্রতিলিপি রাষ্ট্রপতির কাছেও পাঠিয়েছেন অশোকবাবু।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, যৌন হেনস্থার বিষয় তো রয়েছেই। পাশাপাশি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে পেশাগত অসদাচরণের আরও যে সব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলির গুরুত্বও কম নয়। অশোকবাবু সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি হলেও এই ঘটনায় তদন্তের ঊর্ধ্বে নন। জাতীয় মানবাধিকার আইনেই সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের দাবি, পেশাগত অসদাচরণের প্রশ্নে অশোকবাবুর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট নথি ও প্রমাণ সরকারের কাছে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেগুলি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে আগেই পাঠিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রপতির নির্দেশের পর তদন্ত করে চূড়ান্ত মত জানাতে সর্বোচ্চ আদালত বেশি সময় নেবে না বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে এ-ও বলা হচ্ছে, তার আগে অশোকবাবুকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে।
এ দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সরকারের এক শীর্ষ মন্ত্রী বলেন, “বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের উচিত ছিল আগেই ইস্তফা দিয়ে দেওয়া। তা হলে সরকারকে এই পদক্ষেপ করতে হতো না। ওঁকেও এত অবমাননার মুখে পড়তে হতো না।” কেন্দ্রের ওই মন্ত্রীর কথায়, “রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে তদন্ত করানোর জন্য যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে। তাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়ার জন্য বিশেষ সময় ব্যয় করা হয়নি।” মন্ত্রিসভার বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল শিন্দে প্রস্তাবটি পেশ করেন। তার পর কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল জানান, তাঁর মন্ত্রক এবং পরে অ্যাটর্নি জেনারেল গুলাম বাহানবতী আইনি দিক বিবেচনা করে দেখেছেন, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পাঠানোই এখন একমাত্র পথ। একই মত জানান কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমও। তার পরেই প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়।
তবে বিরোধী নেতাদের একাংশ-সহ অনেকেই মনে করছেন, অশোকবাবুর বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের এই ক্ষিপ্রতার নেপথ্যে অন্য কারণও থাকতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন টু-জি স্পেকট্রাম মামলায় অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের একাধিক পর্যবেক্ষণ কপিল-চিদম্বরমদের অস্বস্তিতে ফেলেছিল। সম্প্রতি অশোকবাবুর অপসারণের দাবিতে তৃণমূল, বিজেপি এক সুরে কথা বলায় সরকারের পক্ষে এগোনো সহজ হয়ে যায়।
বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, “বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নৈতিক দায় নিয়ে ইস্তফা দিয়ে দিলে ভাল করতেন। কারণ সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন একজন বিচারপতির নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকা উচিত বলেই আমরা মনে করি।” একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রাক্তন বিচারপতিকে যে শেষ পর্যন্ত এ দিন দেখতে হচ্ছে, সেটাই সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক।” তৃণমূলের তরফেও বলা হয়েছে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ালে এই ধরনের বিষয়গুলো এড়ানো যেত। |