দোটানায় পড়েছে পুলিশ।
৩১ ডিসেম্বর বর্ষশেষের দিন মারা গিয়েছে মধ্যমগ্রামের নির্যাতিতা কিশোরী। তার পর তিন দিন তদন্ত চালিয়েও পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি, মেয়েটি খুন হয়েছে না আত্মহত্যা করেছে! এখনও পর্যন্ত যা সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তাতে দু’রকম সম্ভাবনার দিকেই কমবেশি যুক্তি রয়েছে। আবার কোনওটাই সুনিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ফলে সংশয় কাটছে না তদন্তকারী অফিসারদের।
বিধাননগর কমিশনারেটের এডিসিপি সন্তোষ নিম্বলকরের কথায়, “কিশোরীকে হত্যা করা হয়েছিল কি না তার সপক্ষে এখনও সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। আরও লোকেদের সঙ্গে কথা বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
আদালত সূত্রের খবর, কিশোরীর মৃত্যুকালীন জবানবন্দি চার্জশিটের সঙ্গে আদালতে জমা দেবে পুলিশ। তার আগেই অবশ্য খুনের মামলা শুরু করার আর্জি মঞ্জুর করা হবে। ৭ জানুয়ারি ধৃতদের ফের আদালতে হাজির করানো হবে। সেই দিনই এ বিষয়টি নিয়ে শুনানি হবে।
খুনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে কী সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে? কিশোরী নিজে তার মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে বলে গিয়েছে, মিন্টা ও রতন শীল তার গায়ে আগুন দিয়েছিল। গোয়েন্দারা এটা জানতে পেরেছেন যে, ২৩ ডিসেম্বর সকালে আগুন লাগার কিছুক্ষণ আগে কিশোরীর বাড়িতে গিয়েছিল মিন্টা শীল। কিশোরীটি যে বাড়িতে ভাড়া থাকত, সেই বাড়ির মালিকের বড় ছেলে রতন শীলও তখন বাড়িতেই ছিল। রতন ও মিন্টা মাসতুতো ভাই। দু’জনেই পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।
মৃতা কিশোরীর বাড়ির লোকেদের বয়ান অনুযায়ী, ২৩ তারিখ সকাল সাড়ে আটটায় মেয়েটির গায়ে আগুন লাগে। এলাকার মানুষ পুলিশকে জানিয়েছেন, সকাল সাড়ে আটটা নাগাদই রতনকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু মিন্টা তখন বাড়িতেই ছিল। সে কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে আগুন লাগার ঘটনার সময়ে বাড়িতে রতন ও মিন্টা যে ছিল, তার নিশ্চিত প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু তারাই মেয়েটির গায়ে আগুন দিয়েছিল কি না, তার সপক্ষে এখনও কোনও প্রমাণ মেলেনি।
আত্মহত্যার সম্ভাবনার সপক্ষে কী প্রমাণ রয়েছে? ময়না-তদন্ত রিপোর্ট এবং বাড়িওয়ালির সাক্ষ্য পরোক্ষে আত্মহত্যার দিকেই ইঙ্গিত করছে বলে পুলিশের মত। |
আদালতে ছোট্টু। —নিজস্ব চিত্র। |
কী রকম? পুলিশের একাংশের যুক্তি, অন্য কেউ জোর করে গায়ে আগুন লাগিয়ে দিলে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হয় ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসা। কিন্তু মেয়েটি তা করেনি। মেয়েটি বেরিয়ে এলে তার শরীরে কার্বন-মনোক্সাইড থেকে বিষক্রিয়া হতো না। বন্ধ ঘরে ধোঁওয়া থেকেই কার্বন-মনোক্সাইড তৈরি হয়। ময়নাতদন্তে জানা গিয়েছে, কার্বন-মনোক্সাইড থেকে বিষক্রিয়া কিশোরীর মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
একটা সম্ভাবনা হতে পারে, খুনিরা মেয়েটির ঘর বাইরে থেকে বন্ধ করে চলে গিয়েছিল এবং সেই জন্যই মেয়েটি ঘর থেকে বেরোতে পারেনি। ঘটনার সময় ঘরটা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল কি না, তা অবশ্য সরেজমিন দেখতে পারেনি পুলিশ। কারণ, অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় কিশোরীকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়নি। কিন্তু বাড়ির মালিক বেলা শীলের দাবি, মেয়েটির ঘর ভিতর থেকেই বন্ধ ছিল।
সেটাও আত্মহত্যারই ইঙ্গিত বলে মনে করছে পুলিশ।
এ দিন কিশোরীর বাড়ি দেখা যায়, সেই ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। একটা পাল্লার কিছুটা ভাঙা। বেলাদেবী বলেন, “সে দিন ধাক্কাধাক্কিতে পাল্লার এক অংশ ভেঙে খিল খুলে যায়। মেয়েকে উদ্ধার করে ওর মা গায়ে জল ঢালতে থাকে।” বাইরের লোক আগুন লাগালে মেয়েটির ঘরের ভিতর থেকে খিল তুলে দেওয়ার কথা নয়।
মৃতার বাবা এবং পাড়াপড়শিদের কথা থেকে উঠে আসা আরও নানা তথ্য বলছে, মেয়েটিকে পড়শিদের কাছে নিয়মিত হেনস্থা হতে হচ্ছিল। সেগুলোও তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ। ৩১ ডিসেম্বর কিশোরীর মৃত্যুর পরে তার বাবা পুলিশকে জানিয়েছেন, ২৩ ডিসেম্বর সকালে বাড়ির সামনের কল থেকে জল আনতে গিয়েছিল কিশোরী। সেই সময়ে প্রতিবেশী এক মহিলাও জল নিতে গিয়েছিলেন। বাবার অভিযোগ, সেই মহিলা তাকে বলেন, ‘‘এত ঘটনার পরেও তুই কী করে বেঁচে আছিস?’’
বৃহস্পতিবার অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গিয়েছে, মধ্যমগ্রামে থাকতে দু’দু’বার গণধর্ষণের ঘটনা নতুন পাড়ায় জানাজানি হওয়ার পর থেকেই এলাকায় বাস করা কার্যত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল ওই কিশোরীর কাছে। কিশোরীর এক আত্মীয় জানান, মেয়েটির পরিবার এয়ারপোর্টের আড়াই নম্বর গেটের কাছে এই পাড়ায় উঠে এসেছিল মাস খানেক আগে। তখন মধ্যমগ্রামের বিষয়টি কেউ জানত না। “ঘটনার দিন তিনেক আগে জানাজানি হওয়ার পর থেকেই ওকে নানা ভাবে অপমান করতে শুরু করে পাড়ার কয়েক জন। বাড়িওয়ালাও ওদের উঠে যেতে বলেন।”
এলাকার বাসিন্দারাও জানিয়েছেন, আগুন লাগার দিন সকালে কিশোরী ও তার মায়ের সঙ্গে এক প্রতিবেশিনীর ঝগড়া হয়। অভিযোগ, পাড়ার কলে জল তোলা নিয়ে ঝগড়ায় উঠে আসে ধর্ষণ-প্রসঙ্গ। তিক্ততা বাড়তে বাড়তে চটি-জুতো ছোড়াছুড়িও হয়েছিল বলে প্রতিবেশীরা জানান। স্থানীয় এক বাসিন্দার দাবি, শুধু চটি ছুড়ে মারা নয়। সে দিন এমন কতকগুলো কথা কয়েক জন মিলে বলেছিল যে ওই কিশোরী খুবই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎই দ্রুত বেগে ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
পুলিশের এক অফিসারের কথায়, এই সব অভিযোগ গুরুতর। “এ রকম ঘটে থাকলে ওই মহিলার বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ আনতে হয়! কিন্তু সে ক্ষেত্রে রতন ও মিন্টার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ টিঁকবে না।”
তবে আত্মহত্যা বা খুন যাই হোক, কিশোরীর পরিবারকে আর্থিক এবং অন্যান্য সব রকম সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে রাজ্য সরকার। মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এ দিন ঘটনাটিকে দুঃখজনক, লজ্জাজনক এবং নিন্দনীয় বলে উল্লেখ করেছেন। তবে কিশোরীর মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি হয়েছে বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি। মুখ্যসচিব বলেন, “মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতিও একই রকম নিন্দনীয় ঘটনা।”
কিশোরীর বাবা ও মাকে বৃহস্পতিবার পাওয়া গিয়েছে মৌলালির কাছে সিটু অফিসে। আপাতত সিটু অফিসের পাশেই একটি বাড়িতে তাঁরা থাকছেন। ট্যাক্সি চালানো বন্ধ রেখেছেন কিশোরীর বাবা। বিমানবন্দরের কাছে ওই পাড়ায় আর ফিরতে চান না তাঁরা। কলকাতাতেই থাকবেন বলে ঠিক করেছেন। তিনি বলেন, “কলকাতায় থেকেই বিচার চেয়ে লড়াই করব।”
গণধর্ষণের মামলায় ছোট্টু-সহ ছয় অভিযুক্তকে এ দিন বারাসত আদালতে তোলা হয়। ছ’জনের নামেই গণধর্ষণের চার্জশিট দিয়েছে মধ্যমগ্রাম থানার পুলিশ। মধ্যমগ্রামে ছোট্টুর বাড়ির লোকেরাও বলছেন, ছোট্টু যে অন্যায় করেছে তার শাস্তি যেন সে পায়।
|
যত ভাল কাজ করবেন তত চক্রান্ত হবে। রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার
হিম্মত না থাকলে এই সব চক্রান্ত করবেই। ভাল কাজের প্রচার হয় না।
আর খারাপ কিছু হলেই ২৪ ঘণ্টা ধরে তা নিয়ে উত্তেজনা ছড়ানো হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
|