জবানবন্দি ধরে খুনেরই মামলা
মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে হাসপাতালের বেডে শুয়ে মেয়েটি পুলিশকে বলেছিল, সে আদৌ আত্মহত্যা করতে যায়নি। বরং দুষ্কৃতীরাই তার গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। মধ্যমগ্রামে কিশোরীটিকে গণধর্ষণ ও আগুনে পুড়ে তার মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে যুক্ত অফিসারেরা এমনই জানিয়েছেন। এবং তাঁদের অনুমান, গণধর্ষিতা ষোড়শী যাতে আদালতের সামনে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে না-পারে, সে উদ্দেশ্যেই গত ২৩ ডিসেম্বর দুষ্কৃতীরা বাড়িতে ঢুকে তাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে। মেয়েটির বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর ও শাসানির অভিযোগে যে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করারা জন্য বুধবারই ব্যারাকপুর আদালতে আর্জি জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের এডিসিপি সন্তোষ নিম্বলকর।
পাশাপাশি, পুলিশের দাবি, মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। ময়না-তদন্তের সময়ে তার গর্ভস্থ ভ্রূণটিও সংগ্রহ করা হয়েছে। সেটির ডিএনএ পরীক্ষা এবং ময়না-তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে এ বার যথাযথ ভাবে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বলে দাবি করছেন প্রশাসনিক কর্তারা।
মধ্যমগ্রামের মৃতা কিশোরীর মা। বুধবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
কিন্তু কিশোরীটি ২৬ ডিসেম্বর হাসপাতালে জবানবন্দি দিলেও ওই ঘটনায় ধৃত তাদের বাড়িওয়ালা রতন শীল ও স্থানীয় যুবক মিন্টা শীলের বিরুদ্ধে এত দিন খুনের চেষ্টার মামলা করা হয়নি কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের ব্যাখ্যা, তাঁরা ভেবেছিলেন, মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠবে। তাঁদের দাবি, কারও দেহের ৬০% পুড়ে গেলেও বেঁচে যাওয়ার নজির বিরল নয়। “তাই ভাবা হয়েছিল, সুস্থ হয়ে উঠলে মেয়েটির সঙ্গে বিশদে কথাবার্তা বলে ধৃতদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার ধারাটি জুড়ে দেওয়া হবে।” মন্তব্য এক পুলিশ-কর্তার। যদিও পুলিশেরই অন্য একটি অংশের মতে, এ ধরনের অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই খুনের চেষ্টার মামলা করা উচিত ছিল। মেয়েটি মারা যাওয়ার পরে স্বাভাবিক নিয়মেই যা বদলে যেত খুনের মামলায়।
এ নিয়ে অবশ্য অন্য প্রশ্নও উঠেছে। বলা হচ্ছে, মেয়েটিকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে, সে কথা তার মা বা পরিবারের অন্য কেউ পুলিশকে জানাননি কেন? মেয়েটির মা ঘটনার দিন রাতে পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে, পুড়তে পুড়তে মেয়ে তাঁকে বলেছিল, ‘আমাকে কেন বাঁচাতে আসছ? তুমিও পুড়ে মরে যাও। তুমিও তো মেয়ে!’ তিনি এ দিন জানান, ২৩ ডিসেম্বর তিনি কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে দেখেন, মেয়ে জ্বলছে। “কী যে হয়েছে, প্রথমে তো আমি বুঝতেই পারিনি। এখন মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড হতাশা আর যন্ত্রণা থেকেই ও কথাগুলো বলেছিল। আসল ঘটনাটা তখন আমরা ধরতে পারিনি।’’
পরে যখন বুঝলেন, তখনও কেন পুলিশকে জানালেন না? মায়ের ব্যাখ্যা, “হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় ওর মুখ থেকে গোঙানির মতো আওয়াজ বেরোচ্ছিল। তখনও পুরোটা বুঝতে পারিনি। ক’দিন চিকিৎসার পরে কথা যখন কিছুটা স্বাভাবিক হল, তখন সব জানতে পারলাম।” তত দিনে অবশ্য পুলিশও মেয়ের জবানবন্দি নিয়ে নিয়েছে।
পুলিশ সূত্রে বলা হচ্ছে, মেয়েটির ওই বয়ানকেই মৃত্যুকালীন জবানবন্দি হিসেবে গণ্য করা হবে। এ জাতীয় মামলায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “মৃত্যুকালীন জবানবন্দিকে সব সময়েই বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়। পুলিশ যদি বিষয়টা নিয়ে ঠিকমতো এগোয়, তা হলে দুষ্কৃতীদের অপরাধ প্রমাণ করতে খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।”

কিন্তু পুলিশ এখন কী করবে, সেটা পরের কথা দু’-দু’বার গণধর্ষিতা কিশোরীর নিরাপত্তা দিতে তারা চূড়ান্ত ব্যর্থ বলে অভিযোগ উঠেছে। পরিবারের অভিযোগ, প্রথম বার গণধর্ষণের নালিশ জানাতে থানায় যাওয়ার ‘শাস্তি’ হিসেবে মেয়েটিকে ফের গণধর্ষণ করা হয়েছিল। বস্তুত, ডাক্তারি পরীক্ষা সেরে সন্ধ্যায় থানা থেকে বাড়ি ফেরার পথেই তাকে ফেরতুলে নিয়ে যায় ধর্ষকেরা। এক বার গণধর্ষণের শিকার এক নাবালিকার জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষার বন্দোবস্ত তখন করা হয়নি কেন, প্রশ্ন তুলে কড়া মন্তব্য করেছিল রাজ্য মহিলা কমিশন। এ দিন জাতীয় মহিলা কমিশনও মামলাটিতে পুলিশের সমালোচনা করেছে। “পুলিশের ভূমিকা ঠিক ছিল না। পুলিশের গাফিলতি না-থাকে একটি মেয়েকে কী ভাবে দু’বার ধর্ষণ করা হয়?” প্রশ্ন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন মমতা শর্মার। তিনি জানান, “মুখ্যমন্ত্রীকে আজ চিঠি দিচ্ছি। তিন-চার দিনে উত্তর চেয়েছি।”
তদন্তভার সিআইডি’র হাতে দেওয়ার কোনও ভাবনা-চিন্তা রয়েছে কি? রাজ্য প্রশাসনের তরফে তেমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। “এ নিয়ে সিআইডি-তদন্তের কথা ভাবা হচ্ছে না।” এ দিন পরিষ্কার জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “মধ্যমগ্রামে ধর্ষণের ঘটনাটিতে ছ’জন অভিযুক্তই গ্রেফতার হয়েছে। তাদের নামে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। দিন পঞ্চাশের মধ্যেই পুলিশ তদন্ত শেষ করেছে। আর এয়ারপোর্ট থানা-এলাকায় মেয়েটির উপরে হামলা ও শাসানির ঘটনাতেও অভিযুক্ত দু’জন গ্রেফতার হয়েছে। সেখানেও চার্জশিটের প্রক্রিয়া এগোচ্ছে।” স্বরাষ্ট্রসচিবের দাবি, “মেয়েটি মারা যাওয়ার আগেই তো পুলিশ এ সব ব্যবস্থা নিয়েছে! এ ক্ষেত্রে উত্তর ২৪ পরগনা পুলিশ ও বিধাননগর কমিশনারেটের গাফিলতি আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না।”
প্রশাসন-সূত্রের খবর: অক্টোবরের শেষাশেষি মধ্যমগ্রামে কিশোরীটিকে দু’-দু’বার ধর্ষণের ঘটনার দিন চারেকের মধ্যেই ছয় অভিযুক্ত পাকড়াও হয়েছিল। ২৯ অক্টোবর ধরা পড়ে দু’জন, ৩০ ও ৩১ তারিখে আরও দু’জন। ১ নভেম্বর বাকি দু’জন পুলিশের জালে পড়ে।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.