দিশাহারা পুলিশ বাড়াল রাজনীতির টানাপোড়েন
মৃতদেহ নিয়ে আঠাশ ঘণ্টার টানাপোড়েন। সরকার এবং বিরোধীরা পরস্পর পরস্পরকে দুষছেন। কিন্তু সব ছাপিয়ে সামনে আসছে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের ব্যর্থতা ও সমন্বয়ের অভাব।
মধ্যমগ্রামের ধর্ষিতা কিশোরীর মৃত্যু নিয়ে কামদুনির মতো উত্তেজক পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু কলকাতা পুলিশ ও বিধাননগর কমিশনারেটের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে মধ্যমগ্রামের ঘটনা বিরোধীদের হাতে নতুন রাজনৈতিক অস্ত্র তুলে দিল। ফের প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন বিশিষ্ট জনেরাও। শ্মশান থেকে মৃতদেহ দু’-দু’বার ফিরিয়ে আনতে হল। এক বার ধর্ষিতার বাড়িতে। আর এক বার সিটুর দফতরে। বুধবার বিকেলে, মৃত্যুর প্রায় ২৮ ঘণ্টা পরে তৃতীয় বারের চেষ্টায় সৎকার হল কিশোরীর।
মঙ্গলবার দুপুরে কিশোরীর মৃত্যুর পরেই আসরে নেমেছিল সিটু। মৃতার বাবাকে দিয়ে থানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করানো থেকে শুরু করে কী ভাবে সৎকার হবে সেটা পর্যন্ত ছকে ফেলেন তাঁরা। নবান্নে খবর পৌঁছয়, রাতভর পিস হেভ্নে রাখার পর কিশোরীর মৃতদেহ নিয়ে সিপিএমের মহিলা সংগঠন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি বুধবার দুপুরে মিছিল বার করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ওই মিছিল রাজভবন পর্যন্ত পৌঁছনোর চেষ্টা করবে। রাজ্যপাল যাতে বেরিয়ে এসে মৃতদেহ দেখেন, সেই দাবিও তোলা হবে। নবান্নে এই খবর পৌঁছনোর পরই নড়াচড়া শুরু হয় প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে। পুলিশ সূত্রের খবর, কলকাতা ও বিধাননগর কমিশনারেটে নির্দেশ যায়, মঙ্গলবার রাতেই নিমতলা শ্মশানে মৃতদেহের সৎকার সেরে ফেলতে হবে। মৃতার পরিবারের লোকজন অবশ্য দাবি করছেন, পুলিশ তাঁদের এ নিয়ে কিছু জানায়নি।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ এয়ারপোর্ট আড়াই নম্বর গেট এলাকায় মৃতার বাড়ি থেকে পিস হেভ্নের উদ্দেশে শববাহী গাড়িতে মৃতদেহ রওনা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল বিধাননগর কমিশনারেটের তিনটি গাড়ি। সাধারণত ভিআইপি রোড হয়ে উল্টোডাঙা ধরে পিস হেভ্নের পথে যাওয়ার কথা। তা না-করে শববাহী গাড়িটিকে নিয়ে নাগেরবাজারের পথে যেতে শুরু করে পুলিশ। পিছনে একটি গাড়িতে ছিলেন মৃতার কাকা। তাঁর কাছেই মৃতার ডেথ সার্টিফিকেট ছিল। তাঁর বক্তব্য, “হঠাৎ অন্য রাস্তা ধরা হল কেন, বুঝতে পারলাম না। টালা সেতুতে ওঠার পরে বুঝলাম, পুলিশ শববাহী গাড়িটিকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।” কাচের গাড়ি রাজবল্লভপাড়ার রাস্তা ধরতেই মৃতার কাকা নিজের গাড়ি ঘুরিয়ে নেন। বাড়িতে ফোন করে তিনি বিষয়টা জানান। কাকার কথা, “বাড়ি থেকে সবাই আমাকে ফিরে আসতেই বলে। কারণ, পিস হেভ্ন ছাড়া অন্য কোথাও শবদেহ নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না।”
পরিবারকে অন্ধকারে রেখে মৃতদেহ শ্মশানের দিকে নিয়ে যাওয়া হল কেন? এ ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী কথা বলছে কলকাতা এবং বিধাননগরের পুলিশ। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেন, “ঘটনাটি বিধাননগর কমিশনারেট এলাকার। সেখানকার পুলিশই শববাহী গাড়ির সঙ্গে ছিল। আমরা ওদের সহযোগিতা করেছি মাত্র।” অর্থাৎ পরিবারকে জানানোর দায়িত্ব বিধাননগর কমিশনারেটের ছিল বলে কলকাতা পুলিশের দাবি। আবার বিধাননগর কমিশনারেটের এয়ারপোর্ট ডিভিশনের অতিরিক্ত কমিশনার সন্তোষ নিম্বলকরের বক্তব্য, “কলকাতা পুলিশ কেন পিস হেভ্নের বদলে নিমতলাঘাট শ্মশানে গাড়ি নিয়ে গেল, সেটা আমরাও জানি না।” কলকাতা পুলিশ শববাহী গাড়ি নিয়ে বাগবাজার পৌঁছনোর পর বিধাননগর কমিশনারেটের তিনটি গাড়িও ফিরে চলে গিয়েছিল।
কলকাতা পুলিশ কখন শববাহী গাড়ির দখল নিল? টালা সেতুর উপরে শ্যামপুকুর ও টালা থানার পুলিশ চারটি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। শববাহী গাড়িটি তখনই কার্যত ওই চারটি গাড়ির দখলে চলে যায়। কিন্তু বিধাননগর পুলিশ যে ফিরে যাচ্ছে, সে খবর কলকাতা পুলিশের কাছে ছিল না। এমনকী ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে মৃতার কাকা যে ফিরে গিয়েছেন, সেটাও জানত না তারা। ফল? রাত সাড়ে আটটা নাগাদ নিমতলা শ্মশানে কলকাতা পুলিশ যখন মৃতদেহ নিয়ে পৌঁছয়, তখন তাদের সঙ্গে বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশও নেই। মৃতার পরিবারের লোকজন এবং ডেথ সার্টিফিকেটও নেই।
এমন ঘটল কেন? সেখানেই ফের প্রকট হয়েছে সমন্বয়ের অভাব। কলকাতা পুলিশ জানতই না, শববাহী গাড়িতে মৃতার আত্মীয়রা কেউ নেই এবং ডেথ সার্টিফিকেটও নেই। লালবাজারের এক অফিসারই স্বীকার করছেন, “ডেথ সার্টিফিকেট নেই, কোনও আত্মীয় নেই, এই অবস্থায় মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে পৌঁছলে দুরভিসন্ধির অভিযোগ ওঠাই তো স্বাভাবিক।”
শ্মশানে দেহ নিয়ে পৌঁছে ডেথ সার্টিফিকেট এবং মৃতার আত্মীয় কেউ না থাকায় যথারীতি বিপাকে পড়ে কলকাতা পুলিশ। ডেথ সার্টিফিকেট ও পরিবারের লোককে আনতে শুরু হয় তোড়জোড়। কিন্তু মৃতার পরিবার জানিয়ে দেন, রাতে তাঁরা আর বাড়ি থেকে বেরোবেন না। শেষমেশ মঙ্গলবার রাত ২টো নাগাদ পুলিশ ধর্ষিতার মৃতদেহ বাড়িতেই পাঠিয়ে দেয় আবার। কিন্তু বুধবার সকাল হতেই সৎকারের জন্য ফের চাপাচাপি শুরু হয় বলে পুলিশের প্রতি অভিযোগ মৃতার পরিবারের। বুধবার সকাল পৌনে ৬টায় মৃতদেহ নিমতলা শ্মশানঘাটে নিয়ে যায় পুলিশ। সঙ্গে পরিবারের লোকজনও ছিলেন। কিন্তু শ্মশানে পৌঁছে তাঁরা দাহ করাবেন না বলে বেঁকে বসেন। কেন? মৃতার বাবার বক্তব্য, তাঁদের জোর করে শ্মশানে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁরা তখন দাহ করানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। দুপুরেবিহার থেকে আত্মীয়স্বজন আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা। সেই কারণেই আগের দিন দেহ পিস হেভ্নে রাখতে চেয়েছিলেন।
দাহ করাতে রাজি হওয়া না হওয়া নিয়ে সকালে শ্মশানে পরিবারের সঙ্গে পুলিশের অশান্তি বেধে যায়। একটি সূত্রের খবর, সিটু-র পক্ষ থেকেও এর মধ্যেই পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। দাহ না করানোর জন্য পরিবারটিকে তাঁরাও চাপ দেন। তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন পরে বলেন, “একটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে সিটু সস্তা রাজনীতি করল এ দিন।” বেলা একটু বাড়তেই সিটুর কর্মী-সমর্থকেরা পৌঁছে যান শ্মশানে। তখন রণে ভঙ্গ দেয় পুলিশ। সকাল ১০টায় শববাহী গাড়ি থেকে মৃতদেহ ম্যাটাডরে তুলে রওনা হয়ে যায় সিটু-র দফতরের উদ্দেশে। পরে মৃতার বাবা-মাকে নিয়ে রাজভবনে যান সিটু নেতৃত্ব। মৃতদেহ নিয়ে মিছিলও বের করে সিটু। বিকেল সওয়া চারটে নাগাদ মৌলালি পৌঁছনোর পরে মিছিল মিছিলের মতো এগিয়ে যায়। মৃতদেহটি নিয়ে ফের নিমতলায় চলে আসে পুলিশ। পাঁচটা নাগাদ দাহ হয়ে যায়।
বেঁচে থাকতে উপর্যুপরি আক্রমণের শিকার হয়েছিল মেয়েটি। তার দেহ নিয়েও টানাপোড়েন কম হল না। পরিবারের অভিযোগ, এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ ও স্থানীয় কয়েক জন যুবক তাঁদের বিহারে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। প্রাণনাশের ভয় দেখিয়েছেন। সে কথা রাজ্যপালকেও জানিয়েছেন তাঁরা। তবে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সন্তোষ নিম্বলকর অভিযোগ অস্বীকার করেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.