অত্যাচারে রাশ কোথায়, প্রশ্ন তুলে মৃত্যু দগ্ধ ধর্ষিতার
খুব বাঁচতে চেয়েছিল মেয়েটি। তেরো দিন দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে চালিয়েছিল লড়াই। শেষমেশ তাকে হার মানতে হয়। ২০১২-র ২৮ ডিসেম্বর দিল্লির গণধর্ষিতার মৃত্যুসংবাদে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল সারা দেশ।
এক বছর বাদে, ২০১৩-র ৩১ ডিসেম্বর বেলা দেড়টা নাগাদ কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে মারা গেল মধ্যমগ্রামের গণধর্ষিতা কিশোরী। বারবার ধর্ষণ আর কুৎসার জ্বালা জুড়োতে যে কি না নিজের গায়ে আগুন লাগিয়েছিল, আট দিন আগে।
প্রথম বারের গণধর্ষণের অভিযোগ থানায় জানানোর ‘অপরাধে’ ফের গণধর্ষণের শিকার হয় ওই ষোড়শী। পরিবারের অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা গ্রেফতার হওয়ার পরেও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ নিরন্তর হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল মামলা প্রত্যাহারের জন্য। বাড়িতে ভাঙচুর হয়েছিল, ধর্ষিতার নামে রটানো হচ্ছিল নানা কুৎসা। এত অপমান আর নিগ্রহ সয়ে দরিদ্র ট্যাক্সিচালকের মেয়ে আর বাঁচতে চায়নি। আগুনে পুড়তে পুড়তে মাকে সে বলে গিয়েছিল, ‘মা, আর বাঁচতে চাই না। তুমিও পুড়ে মরে যাও। তুমিও তো মেয়ে!’
দিল্লির ঘটনার পরে দেশজোড়া ধিক্কার-প্রতিবাদ এবং তার জেরে ধর্ষণ-আইনের সংশোধন কিছুটা হলেও আমজনতাকে স্বস্তি দিয়েছিল। তাতেও কি ধর্ষকদের বাগ মানানো গিয়েছে?
বছরের শেষ দিনে মধ্যমগ্রামের মেয়েটির মৃত্যু এই প্রশ্নটাই ফের তুলে দিয়ে গেল। আঙুল তুলল পুলিশি নিরাপত্তার কার্যকারিতার দিকেও। পরিবারের দাবি: গণধর্ষণের অভিযোগ জানানোর পরে দুষ্কৃতীরা মেয়েটিকে ‘বেয়াদপির শাস্তি’ দিয়েছিল ফের গণধর্ষণ করে। তখন এলাকাবাসী, বিরোধী দল, এমনকী রাজ্য মহিলা কমিশনও পুলিশি-সুরক্ষার গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরে ছয় অভিযুক্ত ধরা পড়ে, মেয়েটির বাড়ির সামনে পুলিশি প্রহরা বসে। কিন্তু ক’দিন পরে প্রহরা উঠেও যায় বলে পরিবারের দাবি। পরিজনেরা জানিয়েছেন, দুষ্কৃতীদের লাগাতার হুমকিতে ভয় পেয়ে মেয়েকে নিয়ে তার মা-বাবা মাসখানেক আগে মধ্যমগ্রামের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে এয়ারপোর্ট থানা-এলাকায় এক-কামরা বাড়িতে উঠে গিয়েছিলেন।
তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। সেখানে গিয়েও শাসানি-অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই মেলেনি। পরিবারের অভিযোগ, মামলা তোলার হুমকিতে কাজ না-হওয়ায় পাড়ায় মেয়েটির নামে কুৎসা ছড়ানো শুরু হয়। এমনকী, ২৩ ডিসেম্বর তার বাড়িতে ভাঙচুরও চলে, সঙ্গে ফের শাসানি। আর তার পরেই সে চরম পথ বেছে নেয়। পরিবারিক সূত্রের খবর: হামলাকারীরা চলে যেতেই ঘরের দরজা বন্ধ করে গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় ওই কিশোরী। তাকে আরজিকরে আনা হয়, যেখানকার ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, ওর শরীরের প্রায় ৬৫% পুড়ে গিয়েছিল। উপরন্তু একচিলতে ঘরে লাগানো আগুনের ধোঁয়া শ্বাসনালী দিয়ে ঢুকে ফুসফুসকে জখম করেছিল মারাত্মক।
এমন অবস্থায় গত আট দিন হাসপাতালে থাকার পর মঙ্গলবার দুপুরে কিশোরীটি মারা যায়। ইতিমধ্যে তাকে শাসানির অভিযোগে বাড়িওয়ালা রতন শীল ও মিন্টা নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট থানায় নালিশ দাখিল হয়। পুলিশ-সূত্রের খবর, রতন-মিন্টাকে গ্রেফতার করে ২৪ ডিসেম্বর বারাসত আদালতে তোলা হয়েছিল। তাদের ১৪ দিনের জেল হেফাজত হয়েছে। হাসপাতালে মেয়েটির জবানবন্দিও নথিভুক্ত হয়েছে দু’দফায়। পুলিশ-সূত্রের খবর, দু’জনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে।
এ দিকে মেয়েটির পরিবারের তরফে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। বাবার দাবি: ঠিকঠাক চিকিৎসা হচ্ছে না দেখে তাঁরা আরজিকর-কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন, ওকে এসএসকেএমে পাঠাতে। কিন্তু আরজিকর বলে দেয়, নিতে হলে বন্ড দিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তারা রেফার করবে না। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর জন্য আরজিকর-কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করে বাবা এ দিন বলেন, “ওদের নামে টালা থানায় নালিশ করেছি। জানি না, সুবিচার পাব কি না!” সরকারের তরফে অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। “চিকিৎসায় কোনও গাফিলতি হয়নি।” এ দিন দাবি করেছেন রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজা। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “আমরা তো দোষীদের আড়াল করছি না! তবু বিরোধী দলগুলো ঘটনাটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। এটা নিন্দনীয়।”
মেয়ের চিকিৎসার জন্য টাকার জোগাড় করতে ক’দিন ধরেই ঘোরাঘুরি করছিলেন তার বাবা। ট্যাক্সিচালকদের সিটু সংগঠনের নেতা প্রমোদ ঝা ওঁর বন্ধুস্থানীয়। প্রমোদবাবু এ দিন জানান, উনি কলকাতায় পড়াশোনা করানোর মেয়েকে বিহারের সমস্তিপুরের বাড়ি থেকে পাঁচ মাস আগে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন। চিকিৎসার খরচ জোগাতে ওঁরা রাজ্যের ট্যাক্সিচালক ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কাছ থেকে তিরিশ হাজার টাকা জোগাড়ও করে ফেলেছিলেন। প্রমোদবাবু বলেন, এ দিন দুপুরে বাঙুরের এক ব্যাঙ্কে মেয়েটির বাবাকে নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন অ্যাকাউন্ট খুলে ওই টাকা রাখতে। বেলা দেড়টা নাগাদ এয়ারপোর্ট থানার ওসি তাঁকে ফোন করে জানান, মেয়েটি মারা গিয়েছে। দুপুরে হাসপাতালে দেখা যায়, সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের সামনে কেঁদে আছড়ে পড়ছেন মা। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, “কী ভুলই করলাম! কেন তোকে কলকাতায় নিয়ে এলাম।” হাসপাতালেই একাধিক বার তিনি সংজ্ঞা হারান।
মেয়েটির বাবা এ দিন জানান, মধ্যমগ্রামে দ্বিতীয় বার গণধর্ষিতা হওয়ার পর থেকে মেয়ে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল। নতুন জায়গায় গিয়েও গোড়ায় বাইরে বেরোতে চাইত না। বাবার বক্তব্য, ২৩ ডিসেম্বর যখন তিনি বাড়িতে ছিলেন না এবং স্ত্রী বাজারে গিয়েছিলেন, তখনই বাড়িওয়ালা এসে মেয়েকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। “আমি জানতাম না, মধ্যমগ্রামে যারা মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল, তাদের এক জন ওই বাড়িওয়ালারই আত্মীয়।” বলেন মৃতার বাবা।
পুলিশ বাড়িওয়ালাকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু মেয়েটিকে যারা দু’-দু’বার ধর্ষণ করল বলে অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা হয়েছে?
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশ জানিয়েছে, গণধর্ষণে মূল অভিযুক্ত ছোট্টু-সহ মোট ছ’জনকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে বারাসতের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে গত ১৫ ডিসেম্বর। প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, কিছু দিনের মধ্যে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলার বিচার শুরু হবে। হাসপাতাল ও টালা থানা-সূত্রের খবর, দেহের ময়না-তদন্ত চেয়ে মেয়েটির বাবা এ দিন লিখিত আবেদন করায় ময়না-তদন্ত সেরে পরিবারের হাতে দেহ তুলে দেওয়া হয়। তবে অন্ত্যেষ্টি ঘিরেও তৈরি হয়েছে বিতর্ক। কী রকম?
ঠিক ছিল, এ দিন রাতে দেহ রাখা থাকবে পিস হাভ্ন-এ। আজ, বুধবার সকালে সিটু তা নিয়ে মিছিল করবে। কিন্তু রাতে টালা ব্রিজ থেকে শববাহী গাড়ি সমেত মৃতদেহটি হঠাৎই নিয়ে যাওয়া হয় নিমতলা শ্মশানে। আত্মীয়স্বজন না-পৌঁছানোয় গাড়ি শ্মশানের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অনৈতিক ভাবে দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সিটু তথা সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী। কিশোরীর ডেথ সার্টিফিকেট দেখিয়ে শ্যামলবাবু অভিযোগ করেন, “আসল ডেথ সার্টিফিকেট আমাদের কাছে। তা হলে ওরা কী নিয়ে সৎকার করতে গেল? ওটা কি তা হলে জাল সার্টিফিকেট?”
গোটা ঘটনার জেরে আজ, বুধবার বেলা দু’টোয় সিটু দফতরের সামনে থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত শোকমিছিল হবে। তার পরে রাজ্যপালের কাছেও যাবে বামেরা। ধর্ষিতা কিশোরীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শ্যামলবাবু এ দিন দুপুরে আরজিকরেও গিয়েছিলেন। তাঁর মন্তব্য, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজে মহিলা। তা সত্ত্বেও এ রাজ্যে মহিলারা নিরাপদ নন।” বিকেলে আরজিকরের সামনে বিক্ষোভ দেখায় এসইউসি-র ছাত্র, যুব ও মহিলা সংগঠন। বিকেলে মধ্যমগ্রামেও রাস্তা অবরোধ করে বিরোধী দলগুলি। শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী মঞ্চের তরফে সাহিত্যিক তরুণ সান্যাল জানান, আজ বুধবার কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল করবেন তাঁরা। বিশিষ্টদের তরফে চন্দন সেন জানিয়েছেন, কাল বৃহস্পতিবার অ্যাকাডেমির সামনে প্রতিবাদসভা হবে। সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ মধ্যমগ্রামের নির্যাতিতার অনুষঙ্গে দিল্লির ধর্ষিতার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট অপরাধীরা অবাধে ঘুরছে।” লিবারেশনের ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠন এ দিন সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটে বিক্ষোভ দেখায়। আজ তারা মধ্যমগ্রাম চৌমাথায় বিক্ষোভ দেখাবে, রাজ্য জুড়ে পালন করবে প্রতিবাদ দিবস।
অন্য দিকে সিপিআই এ দিনই বৌবাজার ও ঢাকুরিয়ায় প্রতীকী অবরোধ ও মিছিল বার করেছে। মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “মেয়েটির মৃত্যু ফের প্রমাণ করে দিল, বর্ষশেষে আমরা ব্যর্থ। সকলে মিলে পাশে থেকে ওকে বাঁচাতে পারতাম। পারলাম না।” অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের পর্যবেক্ষণেও হতাশা “একটা করে ঘটনা ঘটে। আর আমরা হইচই করি! আলোচনাসভা, প্রতিবাদসভা করি, রাস্তায় নামি। কিন্তু অপরাধীদের মধ্যে কোনও ভয় তৈরি হয় না। আসলে বিচারটা এত দিন ধরে হয় যে, ওরা কোনও ভাবেই ভয় পায় না।” সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়ের কণ্ঠেও উদ্বেগ। “মেয়েরা রাস্তায় বেরোলে অক্ষত শরীরে ফিরবে কি না, তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। আসলে এই সব অপরাধে যে ধরনের প্রতিবাদ হওয়া উচিত, তা হচ্ছে না। অপরাধীরা এখন আর ভয় পাচ্ছে না।”বলেন তিনি।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.