ধর্ষকদের শাসানি, জ্বালা
জুড়োতে গায়ে আগুন
কুতি বলছে, অনেক অনেক কথাই আছে বলার। কিন্তু মুখ থেকে যা বেরোচ্ছে, সেটা গোঙানি ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিছু ক্ষণ আগেই সে যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল, বাঁচাতে গিয়েছিলেন মা। সোমবার সকালে তখনই শেষ বারের মতো কথা বলেছিল ১৬ বছরের মেয়েটি। বলেছিল, “আমাকে কেন বাঁচাতে আসছ মা? তুমিও পুড়ে মরে যাও। তুমিও তো মেয়ে!” গুরুতর অগ্নিদগ্ধ কিশোরীটি এখন আর জি কর হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
দু’মাস আগে, ২৫ অক্টোবর দুষ্কৃতীরা গণধর্ষণ করে মধ্যমগ্রামের একটি মাঠের পাশে ফেলে গিয়েছিল মেয়েটিকে। পরে সে অভিযোগ জানাতে থানায় গিয়েছিল ট্যাক্সিচালক বাবা এবং গৃহবধূ মাকে নিয়ে। থানা থেকে ফেরার সময়েই তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফের গণধর্ষণ করে ওই দুষ্কৃতীরা। ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় কিশোরীটিকে রেললাইনের ধার থেকে উদ্ধার করেন এলাকার মানুষ। তাঁদের চাপে গ্রেফতার করা হয় মূল অভিযুক্ত ছোট্টু-সহ ছ’জনকে।
তার পরেই ছোট্টু এবং তার দলবলের নানা অপরাধ প্রকাশ্যে আসে। গণধর্ষণের মামলার বিচারও শুরু হয়। আস্তে আস্তে মেয়েটির বাড়ির সামনে থেকে পুলিশি পাহারাও উঠে যায়। দুষ্কৃতীদের শাগরেদ বাহিনীর টানা হুমকি থেকে মেয়েকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত মধ্যমগ্রামের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে এয়ারপোর্ট থানা এলাকার একটি বাড়িতে উঠে গিয়েছিলেন বাবা-মা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। এ দিন সকালে গায়ে কেরোসিন ঢেলে সব যন্ত্রণা শেষ করে দিতে চেয়েছে কিশোরীটি।
কেন এই কাজ করল সে? সন্ধ্যায় আর জি কর হাসপাতালের বার্ন ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটির বাবা বলেন, “ছোট্টুর শাগরেদ মিন্টা আমাকে ফোন করে মামলা তুলতে চাপ দিচ্ছিল। আমি পুলিশকে সব জানাই। পরে ফোন ধরা বন্ধ করে দিই। কিন্তু মিন্টা আমাদের খোঁজখবর করে এক দিন কয়েক জনকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসে। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আমাদের নানা ভাবে ভয় দেখায় ওরা।” তার পরেও মামলা তোলেননি ওই ট্যাক্সিচালক। তিনি বলেন, “চেয়েছিলাম, আমাদের মেয়েকে যারা এত কষ্ট দিয়েছে, তারা সাজা পাক। মেয়েও তা-ই চাইছিল। কিন্তু কী কপাল করে যে জন্মেছিল মেয়েটা!”
কিশোরীর বাবা জানান, মামলা তুলতে রাজি না-হওয়ায় পাড়ার লোকেদের কাছে মেয়ের বদনাম রটাতে থাকে দুষ্কৃতীরা। ওকে যে দু’-দু’বার গণধর্ষণ করা হয়েছিল, তা সকলকে জানিয়ে দেয় ওরা। বাবা বলেন, “বিহারের গ্রাম থেকে ওকে এখানে এনেছিলাম পড়াশোনা করাব বলে। এয়ারপোর্টে এসে এক গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তির প্রস্তুতিও শুরু করেছিল মেয়ে। কিন্তু ওই ছেলেগুলো লাগাতার কুৎসা ছড়াতে থাকায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে ও। এখানে থাকাই দুষ্কর হয়ে ওঠে আমাদের।”
কী হয়েছিল এ দিন? হাসপাতালে মেয়ের শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে কিশোরীর মা জানান, সকালে হঠাৎ কয়েক জনকে নিয়ে তাঁদের ঘরে ঢোকে মিন্টা। মায়ের অভিযোগ, সাতসকালেই ওরা খুব মদ খেয়েছিল। ঘরে ঢুকেই ওরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে দিতে থাকে। বলতে থাকে, ‘মামলা তুলে না-নিলে কোথাও গিয়ে পার পাবি না। পুলিশ কেন, কেউ কিছু করতে পারবে না’ ইত্যাদি। মেয়ে ভয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে বলে জানান মা। তিনি বলেন, “ওর বাবা ট্যাক্সি নিয়ে কৃষ্ণনগরে ভাড়া খাটতে গিয়েছিল। বাড়িতে আমরা দু’জনেই ছিলাম। ভয়ে আমিও কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে ওদের বলি, ‘বাবা, আমরা আর সহ্য করতে পারছি না। আমাদের ছেড়ে দাও।’ কিন্তু ওরা কথা শোনোনি।” তাণ্ডব চালিয়ে তখনকার মতো চলে যায় মিন্টারা।
শাসানি ও হামলার বৃত্তান্ত জানিয়ে হাসপাতালেই পোড়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মা বললেন, “বলেছিলাম, পোড়ারমুখী, তোর রূপের জন্যই এত কাণ্ড!’’ তার কিছু পরেই পাশের দোকানে যান মা। তখনই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় মেয়ে। মা বলেন, “ঘরে ফিরে দেখি, দরজা বন্ধ। ভিতরে আগুন জ্বলছে। চিৎকার করছে মেয়ে। চিৎকার করতে থাকি আমিও।”
মা-মেয়ের চিৎকার শুনে পড়শিরা ছুটে এসে দরজা ভেঙে ফেলেন। কিশোরীটিকে উদ্ধার করে জল ঢেলে আগুন নেভান তাঁরাই। মা বলেন, “মেয়ে তখনও চিৎকার করে চলেছে, ‘মা, আমি আর বাঁচতে চাই না মা। তুমিও পুড়ে মরে যাও। তুমিও তো মেয়ে!’ আমি ওকে বলতে থাকি, তুই আমার মেয়ে না, তুই বেটা। তুই স্কুলে পড়বি। লড়াই করবি।”
এলাকার বাসিন্দারাই দগ্ধ মেয়েকে নিয়ে যান আর জি কর হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, মেয়েটির শ্বাসনালি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবস্থা সঙ্কটজনক। হাসপাতালে চলে আসেন মেয়েটির বাবা, অন্য আত্মীয়েরাও। পরে তাঁরা যান এয়ারপোর্ট থানায়। বাবা বলেন, “এয়ারপোর্ট থানা প্রথমে অভিযোগ না-নিয়ে মধ্যমগ্রাম থানার সঙ্গে কথা বলে। পরে অভিযোগ নেয়।” রাতে বিধাননগরের কমিশনার রাজীব কুমার বলেন, “বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
মেয়েটির জেঠতুতো দাদা হাসপাতালে দাঁড়িয়ে জানান, পড়াশোনা করে নতুন জীবন গড়ে তোলার কথা বলত তাঁর বোন। নতুন জায়গায় এসে শুরুও করেছিল। “কিন্তু এখানেও ওরা পিছু ছাড়ল না। ওরা কাউকে ভয় করে না। বাঁচলেও বোনকে কী অবস্থায় পাব কে জানে,” দাদার গলায় উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা।
হাসপাতালের ভিতরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তখনও কাঁদছেন মা। বাবা কাঁদছেন বাইরে। আর মাকে দেখলে চোখ মুছে বাবা বলছেন, ‘‘সব ঠিক হয়ে যাবে।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.