গণধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়েছিল এক কিশোরী। শাস্তি হিসেবে ফের তাকে ধর্ষণ করল প্রধান অভিযুক্ত যুবকটিই।
কামদুনি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মধ্যমগ্রামের বাদু রোডের ঘটনা। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরেও এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। কয়েক মাস আগেই কামদুনিতে এক কলেজছাত্রীর গণধর্ষণ ও খুনকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজ্য। ওই ঘটনার পরেই বারাসত থানার অধীনে থাকা মধ্যমগ্রাম তদন্ত কেন্দ্রকে পূর্ণাঙ্গ থানা করা হয়েছে। এর পরেও ওই এলাকায় মহিলাদের নিরাপত্তা যে বাড়েনি, এই ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বলে মনে করছেন এলাকাবাসীরা।
পুলিশ সূত্রের খবর, প্রথমে মধ্যমগ্রামের পাটুলি-শিবতলার বাসিন্দা বছর চোদ্দোর ওই কিশোরীকে শুক্রবার রাতে গণধর্ষণ করে ছোট্টু তালুকদার-সহ সাত দুষ্কৃতী। শনিবারই মধ্যমগ্রাম থানায় অভিযোগ জানান মেয়েটির বাবা-মা। রবিবার বারাসত হাসপাতালে ডাক্তারি পরীক্ষার পর বাবা-মায়ের সঙ্গে একটি ভ্যানরিক্শায় চেপে বাড়ি ফিরছিল ওই কিশোরী। মাঝপথে মেয়েটিকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে ছোট্টু ফের তাকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ।
পুলিশ জানায়, ধর্ষণের পরে মারধর করে মধ্যমগ্রাম স্টেশনের কাছে রেললাইনে মেয়েটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ওই দুষ্কৃতী। কিন্তু স্থানীয় কয়েক জন বাসিন্দা চলে আসায় মেয়েটিকে ছেড়ে চম্পট দেয় সে। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “গণধর্ষণ এবং ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে। মেয়েটির বাড়ির সামনে পুলিশ পিকেটও বসেছে। অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়েছে।”
কিশোরীর বাড়ি বিহারের সমস্তিপুরে। তার বাবা কলকাতায় ট্যাক্সি চালান। মাস পাঁচেক আগে ওই কিশোরী ও তার মা কলকাতায় এসে থাকতে শুরু করেন। বিহারে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল ওই কিশোরী। আগামী শিক্ষাবর্ষে এখানে ফের স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। প্রধান অভিযুক্ত ছোট্টু বাঁশতলা বাজারে মাছ বিক্রি করে। সেখানেই মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তার। মেয়েটির বাবা এ দিন বলেন, “বিহারেই ওরা ভাল ছিল। কেন যে ওদের এ রাজ্যে আনতে গেলাম! আমার জন্যই মেয়েটার এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল।”
কিশোরী জানিয়েছে, শুক্রবার তার বাবা ট্যাক্সি নিয়ে বেরোনোর সময় রাতে ফিরবেন না বলে জানিয়েছিলেন। রাত সাড়ে ন’টার মধ্যে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়েছিল মা-মেয়ে। রাত দশটা নাগাদ ছোট্টু এসে জানায়, মধ্যমগ্রাম চৌমাথার কাছে কিশোরীর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এ কথা শুনে মাকে কিছু না জানিয়েই সে ছোট্টুর সঙ্গে বেরিয়ে যায়। পুলিশকে মেয়েটি জানিয়েছে, বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা মাঠের কাছে যেতেই ছোট্টুর ছয় শাগরেদ হাজির হয়। এর পর মেয়েটির হাত-মুখ বেঁধে সারা রাত ধরে ধর্ষণ করে তারা। ভোর হতে মেয়েটিকে ফেলে চম্পট দেয়।
মেয়েটি জানিয়েছে, শনিবার আলো ফুটলে সে মাঠের পাশে একটি বাড়িতে গিয়ে পুরো ঘটনাটি জানায়। এর পর ওই এলাকার কয়েক জন বাসিন্দা মেয়েটির ছেঁড়া জামাকাপড় পাল্টে অন্য জামাকাপড় পরিয়ে তাকে পাটুলি-শিবতলার বাড়িতে নিয়ে যায়। পুলিশ সূত্রের খবর, শুক্রবার মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা টের পান মা। ভোরবেলা স্বামী ফিরে এলে, তাঁরা মধ্যমগ্রাম থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ থানা থেকে বাড়ি ফিরে মেয়েকে ফিরে পান তারা। গোটা ঘটনা শোনার পর বেলায় ফের থানায় হাজির হন তাঁরা।
পুলিশ জানিয়েছে, মেয়েটির কাছে ঘটনাটি শুনে গণধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু ওই দিন বারাসত হাসপাতালে ডাক্তারি পরীক্ষার সময় পেরিয়ে যাওয়ায় মা ও মেয়েকে সে দিনের মতো থানার মহিলা কোয়াটার্সে রেখে দেওয়া হয়। রবিবার মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা হয়।
অভিযোগ, রবিবার সন্ধ্যায় ভ্যানরিক্শায় চেপে বাড়িতে ফেরার সময় ছোট্টু ফের মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যায়। মেয়েটির বাবা পুলিশকে জানিয়েছেন, মেয়ে বসেছিল ভ্যানরিকশার পিছনে। সামনে তাঁরা দু’জনে বসেছিলেন। সারা দিনের ক্লান্তিতে দু’জনের চোখের পাতা জুড়ে এসেছিল। অভিযোগ, সেই সুযোগে মুখ চাপা দিয়ে মেয়েটিকে অটোয় তুলে নেয় ছোট্টু। এর পর বাদু রোডের একটি বাগানে নিয়ে গিয়ে সে ফের ধর্ষণ করে মেয়েটিকে। তার পর রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ মধ্যমগ্রাম স্টেশনের কাছে রেললাইনের কাছে নিয়ে গিয়ে ট্রেনের সামনে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। একটু দূরেই কিছু লোকজন দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটির চিৎকার শুনে তারা এসে ছোট্টুকে পাকড়াও করে। কিন্তু তাদের হাত ছাড়িয়ে অটো নিয়ে পালিয়ে যায় ছোট্টু। এর পর রেল পুলিশ এসে মেয়েটিকে উদ্ধার করে তার বাড়িতে নিয়ে যায়।
মেয়েটির বাবা জানিয়েছেন, তাঁরা বাড়ি পৌঁছে দেখেন, ভ্যানের পিছনে বসে থাকা মেয়ে নেই। এলাকায় খোঁজাখুঁজি শুরু করেন তাঁরা। ইতিমধ্যে রেল পুলিশ মেয়েটিকে ফেরত দিয়ে গেলে তাকে নিয়ে ফের থানায় ছোটেন বাবা-মা। পুলিশ জানিয়েছে, রাতেই ফের নতুন একটি ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়। মেয়েটির বাড়িতে বসানো হয় পুলিশি পাহারা। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এর আগেও একাধিক যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঘটিয়েছে ছোট্টু।
প্রশ্ন উঠেছে, শনিবার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কেন ধরা গেল না ছোট্টু-সহ বাকি অভিযুক্তদের? পুলিশ জানায়, ঘটনার পরেই এলাকায় হানা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সবাই এলাকাছাড়া।
তা হলে রবিবার সে ফিরে এল কী করে? পুলিশ কর্তাদের কাছে এর সদুত্তর মেলেনি।
সোমবার মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সারা গায়ে কাটা-ছেঁড়ার দাগ নিয়ে এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছে সে। অপরিচিত লোক দেখলেই মুখ লুকিয়ে নিচ্ছে। তার মধ্যেই কোনও মতে সে বলে, “রবিবার রাতে ছোট্টু বলে গিয়েছে, ‘পুলিশকে বলেছিস! এ বার তোকে মেরেই ফেলব। তোর মাকেও ধর্ষণ করব আর বাবাকে খুন করব।” |