ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ উসুল করতে কোনও মতেই গা-জোয়ারি করা যাবে না। এ জন্য ঋণ-গ্রহীতার বাড়িতে ‘বাউন্সার’ পাঠানোও বরদাস্ত করা হবে না বলে ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষদের হুঁশিয়ার করে দিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তাদের সঙ্গে সোমবার এক বৈঠকে প্রশাসনের এ হেন কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। “কোনও অবস্থাতেই সরকার এমন অনৈতিক বলপ্রয়োগ মেনে নেবে না।” ব্যাঙ্ক-কর্তাদের বলেছেন তিনি। এ দিন অর্থ দফতরের সঙ্গে ব্যাঙ্কগুলির ওই সমন্বয় বৈঠকে (পরিভাষায়, স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটি, সংক্ষেপে এসএলবিসি) অর্থমন্ত্রীকে পুরোপুরি সমর্থন জানিয়েছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি এ কে মজুমদার, যাঁর বক্তব্য, “খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম-কানুন মেনে। বাউন্সার নিয়ে বাড়িতে চড়াও হওয়ার পদ্ধতি চলতে পারে না।”
বস্তুত ব্যাঙ্ক-ঋণের বকেয়া কিস্তি পরিশোধের জন্য জবরদস্তির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ক’দিন আগেই রাজ্যে এমন দু’টি ঘটনা ঘিরে শোরগোল পড়েছে। রাজ্য অর্থ দফতরের খবর: বর্ধমানে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক পাওনা টাকা আদায় করতে এক গ্রাহকের বাড়িতে বাউন্সার পাঠিয়েছিল। খবর পেয়ে পাড়া-পড়শি এসে বাউন্সার ও ম্যানেজার-সহ ব্যাঙ্কের দলটিকে ঘিরে ধরেন। উত্তেজনা ছড়ায়। পুলিশ এসে কোনও ক্রমে আটকদের উদ্ধার করে। সম্প্রতি এমন আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। দু’টিতেই সংশ্লিষ্ট ঋণ-গ্রহীতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দুই ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের তরফে সরকারের সহায়তা চাওয়া হয়। শেষমেশ খোদ অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ধৃত ম্যানেজারেরা জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। |
অমিতবাবু এ দিন এসএলবিসি-কে ওই দুই ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “ঋণ আদায়ের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে নীতি স্থির করে দিয়েছে, তা উপেক্ষা করা যায় না। এর বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক কেন বলপ্রয়োগ করবে?” উপরন্তু এ সব ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা সৃষ্টি হলে রাজ্য প্রশাসনকেই সামলাতে হয়। এর প্রেক্ষাপটে অমিতবাবুর আশা, আইনবিরুদ্ধ কাজ যাতে না হয়, ব্যাঙ্ক-অফিসারেরা সে দিকে নজর রাখবেন। আরবিআই প্রতিনিধি একই বার্তা দেন। দফতরের খবর, বৈঠকে উপস্থিত ৩৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তারা এ ব্যাপারে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এ তো শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ও সমবায় ব্যাঙ্কের কথা! বেসরকারি ব্যাঙ্কের উপরে রাশ টানা হবে কী ভাবে?
অর্থ দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা: আইন আইন-ই। রাষ্ট্রায়ত্ত হোক, বা বেসরকারি সব ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেই তা সমান ভাবে প্রযোজ্য। রিজার্ভ ব্যাঙ্কই নিশ্চিত করবে, তাদের বিধি বেসরকারি ব্যাঙ্ক ঠিকঠাক মেনে চলছে কি না। “তবে ব্যাঙ্ক যদি সাধারণ মানুষের জমি-বাড়ি গায়ের জোরে দখল করতে যায়, তা সব সময়ই বেআইনি। এ নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই।” মন্তব্য করেন অর্থ-কর্তাটি।
পাশাপাশি, রাজ্যের সামাজিক ক্ষেত্রে ঋণদানে সব ব্যাঙ্ককে আরও বেশি এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বিশেষত সংখ্যালঘুদের ঋণদানের উপরে জোর দিয়ে তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে ২৫% মানুষ সংখ্যালঘু শ্রেণিভুক্ত। অথচ ব্যাঙ্কগুলোর দেয় মোট ঋণের সাকুল্যে ১৫% পান সংখ্যালঘুরা, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম।” ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পে ছাত্রীদের অ্যাকাউন্ট খোলায় কিছু ব্যাঙ্কের তরফে কিছু অনীহা দেখা যাচ্ছে বলেও আক্ষেপ করেছেন অর্থমন্ত্রী। সরকারি হিসেবে, কন্যাশ্রীতে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে দু’লক্ষ অ্যাকাউন্ট খোলা গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি খুলেছে ইউবিআই। “ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট না-থাকলে ছাত্রীরা কন্যাশ্রীর সহায়তা পাবে না। তাই ইউবিআইয়ের মতো সব ব্যাঙ্ককে আরও তৎপর হতে হবে।” বলেন অমিতবাবু।
একই ভাবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ঋণদানের প্রশ্নেও ব্যাঙ্কের ভূমিকায় অর্থমন্ত্রী বিশেষ খুশি নন। এসএলবিসি’তে তিনি বলেন, “এ পর্যন্ত ৩৩ হাজার স্বনির্ভর গোষ্ঠী ২০৭ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক-ঋণ পেয়েছে। অথচ রাজ্যের অন্তত দেড় লক্ষ গোষ্ঠীকে গড়ে ৮৩ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া প্রয়োজন। মোট প্রায় ১২০০ কোটি টাকা।” এসএলবিসি-র চেয়ারম্যান তথা ইউবিআইয়ের সিএমডি অর্চনা ভার্গব অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য মেনে নিয়ে জানান, কিষাণ ক্রেডিট কার্ড বিলি এবং স্বনির্ভর-ঋণ বাড়াতে ব্যাঙ্ক ও রাজ্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে দু’টো বিশেষ কমিটি গড়া হয়েছে।
তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় ব্যাঙ্কের ঋণ-আমানত অনুপাত এ বার কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দিনের বৈঠকে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
|