মধ্যমগ্রামে ধর্ষিতা এবং অগ্নিদগ্ধ কিশোরীর মৃত্যুর পরে সরকার কেন নীরব, প্রশ্ন তুলেছিল বিরোধীরা। প্রশাসনের তরফে অবস্থান জানাতে মুখ্যসচিব বৃহস্পতিবার মুখ খোলার পরে রাজনৈতিক তরজা আরও বাড়ল! নবান্নে বসে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তা রাজনৈতিক নেতাদের মতো মন্তব্য করেছেন বলে পাল্টা
সরব হল বিরোধীরা।
মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এ দিন জানিয়েছেন, মধ্যমগ্রাম-কাণ্ডে জড়িতেরা যাতে দ্রুত আইন মোতাবেক শাস্তি পায়, সরকার তা দেখবে। নির্যাতিতার পরিবারের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গেই মন্তব্য করেছেন, “মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতিও অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা!” মুখ্যসচিবের বক্তব্য বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন বলে দাবি করে সমালোচনায় মুখর হয়েছে বামেরা। বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যসচিবের বক্তব্য আসলে হিজ মাস্টার্স ভয়েস! আমরা যারা রাজনৈতিক দল, তারা নিশ্চয়ই রাজনীতি করব! কিন্তু মুখ্যসচিবের রাজনীতি করা সাজে না!”
নির্যাতিতার পরিবারের সুরক্ষার যে আশ্বাস সরকার দিয়েছে, তার প্রেক্ষিতে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সর্বভারতীয় সভানেত্রী তথা প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ মালিনী ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, “সুরক্ষা পেলে কি ওই কিশোরী দু’বার ধর্ষিতা হত? মধ্যমগ্রামের বাড়ি ছেড়ে তাদের চলে আসতে হত? মেয়েটির মৃত্যুর পরে রাতভর বাড়িতে বাবা-মা’কে হুমকি দেওয়া হত? মুখ্যসচিব ভিত্তিহীন দাবি করছেন!” পশ্চিমবঙ্গে নারী নির্যাতনের লাগাতার ঘটনা নিয়ে এ দিনই কলকাতা প্রেস ক্লাবে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন মালিনীদেবীরা। মধ্যমগ্রামের ঘটনার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার কলকাতায় লেনিন মূর্তি থেকে গাঁধী মূর্তি পর্যন্ত মিছিলের ডাক দিয়েছে চারটি বামপন্থী মহিলা সংগঠন। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম নির্যাতিতার পরিবারের জন্য এক লক্ষ টাকা অর্থ সাহায্যও ঘোষণা করেছে।
ধনেখালিতে প্রাক্তন মন্ত্রী নরেন দে-র উপরে হামলার প্রতিবাদে গিয়ে মধ্যমগ্রামে তৃণমূলের দুষ্কৃতী এবং পুলিশের ভূমিকার দিকে ফের আঙুল তুলেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীর কটাক্ষ, “মুখ্যসচিব তো আসলে নিজের সরকারের দিকেই অভিযোগ করেছেন! মরদেহের উপরে প্রথম অধিকার থাকে পরিবারের। এখানে পুলিশই তো পরিবার এবং ডেথ সার্টিফিকেট
ছাড়া সৎকার করার জন্য দেহ তুলে নিয়ে গিয়েছিল! তা হলে রাজনীতি কারা করল?”
শুধু বামেরাই নয়, তৃণমূলের অন্দরে বিক্ষুব্ধ অংশও মধ্যমগ্রাম নিয়ে তোপ দাগার সুযোগ ছাড়েনি। আমহার্স্ট স্ট্রিটে এ দিন একটি রক্তদান শিবিরের অনুষ্ঠানে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল সাংসদ সোমেন মিত্র প্রশ্ন তুলেছেন, “দিল্লিতে নির্ভয়া-কাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী মাথা নত করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এখানে প্রায় প্রতিদিন নারীরা ধর্ষিত হচ্ছেন। কিন্তু এখানকার মুখ্যমন্ত্রী নীরব কেন?” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় অবশ্য এর বিশদ জবাব না-দিয়ে বলেন, “রাজ্যের মুখ্যসচিব সরকারের বক্তব্য ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন। দলের তরফে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে বাংলার বুকে ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে সিপিএম এবং বামফ্রন্টেরই যোগ দেখা গিয়েছে।” মধ্যমগ্রামের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে মুকুলবাবুর দাবি। তিনি বলেন, “এখন শুনছি ওই অভিযুক্ত সিপিএমে যোগ দিয়েছে।” যার প্রেক্ষিতে সিপিএম নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, অভিযুক্ত সিপিএম হলে অভিযোগকারিনীর বাড়িতে তৃণমূল হুমকি দিতে গেল কেন?
সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের দাবিতে গাঁধীমূর্তির পাদদেশে কংগ্রেস বিধায়কদের অবস্থান-মঞ্চে এ দিন কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি, মিছিলের বিরুদ্ধে আমরা। মেয়েটি কোনও দলের নয়, এই বাংলার। মেয়েটির মৃত্যুতে পুলিশ ও চিকিৎসকদের অবহেলার সিবিআই তদন্ত হোক। সংসদীয় পদ্ধতিতে মেয়েটির মৃত্যুর বিচার চাই।” মাঝরাতে কেন মেয়েটিকে দাহ করার চেষ্টা হয়েছিল, সে বিষয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। ঘটনার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার রাজ্য জুড়ে বিকেল ৩টে থেকে ৪টে পর্যন্ত এক ঘণ্টা মানবশৃঙ্খলের ডাক দিয়েছেন।
নির্যাতিতার বাবা-মা এ দিনও সিটুর রাজ্য দফতরে সাময়িক আস্তানাতেই ছিলেন। সন্ধ্যায় বিহার পুলিশের আইজি জি এস গঙ্গোয়ার এ জে সি বোস রোডে একটি বেসরকারি দফতরে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। মেয়েটির বাবা-মায়ের হাতে বিহার সরকারের তরফে নগদে এক লক্ষ টাকা সাহায্য তুলে দেন, গোটা ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন এবং বিহারে ফিরে গেলে তাঁদের পুনর্বাসনের যাবতীয় আশ্বাস দেন। বাবা অবশ্য বলেছেন, মেয়ের সঙ্গে অন্যায়ের ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি না দেখে তাঁরা কলকাতা ছাড়তে চান না। বিহারের আইজি-র আজ, শুক্রবার রাজ্য পুলিশের ডিজি-র সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা। |