আগামী এক বছরে কী কী কাজ করা হবে, সেটা আগাম জানিয়ে দিতে প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। বৃহস্পতিবার সেই উপলক্ষে এই প্রথম রাজ্যের সচিবালয়ে পা রাখলেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। এবং ক্যালেন্ডার প্রকাশের পরে জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই সরকার গত দু’বছর ধরে প্রশাসনে যে নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে, যে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, তা এ রাজ্য গত ৪০ বছর দেখেনি।
কাজে গতি আনা এবং সময়মতো তা শেষ করার ব্যাপারে এর আগে একাধিক বার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জেলায় জেলায় সফরে গিয়ে প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকের সময়ে দফতর ধরে ধরে নিজেই কাজের খতিয়ান শুনিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন, কাজ আটকে থাকার কারণ। প্রয়োজনে ধমকও দিয়েছেন দফতরের মাথাদের। এমনকী, কলকাতায় টাউন হলে প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ে বৈঠকেও দফতর ধরে ধরে কে কতটা কাজ করেছে, কত টাকা খরচ করেছে, দিয়েছেন সেই খতিয়ান।
কিন্তু গোটা বিষয়টিকে তিনি যে আর প্রশাসনের অন্দরে আটকে রাখতে চান না, তা দু’টি কাজে বুঝিয়ে দিলেন মমতা। প্রথমত, সময় বেঁধে কাজ শেষ করার জন্য পরিষেবা আইন পাশ করেছে তাঁর সরকার। সময়মতো কাজ না-পেলে যে আইন মোতাবেক সরকারি কর্মচারীদের শাস্তি দাবি করতে পারবেন সাধারণ মানুষ। এ বার প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার সরকারি কর্মীদের দায়বদ্ধ করার দ্বিতীয় ধাপ বলেই মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কর্তাদের অনেকেই। গোটা বছরে সরকার কী কী কাজ করবে,
তা আগাম জানিয়ে দেওয়ার ফলে বছর শেষে জনগণ সেই ক্যালেন্ডার ধরে সরকারি কর্মীদের কৈফিয়ৎ চাইতে পারবে। |
নবান্নে রাজ্যপালকে স্বাগত মুখ্যমন্ত্রীর। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার। |
এক প্রশাসনিক কর্তার মতে, কাজে গতি আনার জন্য আর মৌখিক আশ্বাস নয়, অফিসারদের কাছ থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। যে ব্যবস্থা দেশের আর কোথাও নেই বলে ঘনিষ্ঠ মহলে দাবি করেছেন মমতা। এ দিন প্রশাসনিক ক্যালেন্ডারের উদ্বোধন করে সে কথা বলেছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও। তাঁর কথায়, “৬০ বছর ধরে বহু নেতা থেকে আমলা, আম-জনতা থেকে বহু বিখ্যাত মানুষ, দল-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকের সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু বলতে বাধা নেই, এমন অভিনব এবং স্বচ্ছ পদক্ষেপ আগে কখনও দেখিনি।”
রাজ্যপালের প্রশংসায় এ দিন দৃশ্যতই খুশি মুখ্যমন্ত্রী এর পরে সুশাসনের তিনটি মন্ত্র উল্লেখ করে নিজের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন, “আমার বিচারে সুশাসনের তিনটে মন্ত্র। ইন্টেনশন-মিশন-অ্যাকশন। কোনও সরকারের যদি উদ্দেশ্য ঠিক থাকে, সেই উদ্দেশ্যকে লালন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যও অবিচল থাকে, সেই ভাবে যদি কাজও করা হয়, তা হলে সুশাসন আসবেই।”
প্রশ্ন হচ্ছে, মমতা এই পথে হাঁটলেন কেন? মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলছেন, এই ভাবে কাজ করলে নজরদারি ভাল হয়। এই ক্যালেন্ডারের উপরে তো সকলেরই নজর থাকবে। ফলে কোথায় কী কাজ হল, সেটা সহজেই জানা যাবে। প্রশাসনের একাংশ বলছে, এত দিন ধাপে ধাপে কাজকে সময় ও নিয়মে বেঁধে ফেলার দিকেই এগোচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে কর্পোরেট সংস্থার মানবসম্পদ কর্তাদের মতো ভাল কাজের জন্য পুরস্কার, আর না পারলে ফল ভোগেরও ব্যবস্থা করেছেন। সম্প্রতি মন্ত্রিসভার রদবদলে সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বিচার না-করে শুধুমাত্র কাজের বিচারে শিল্প দফতর তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে তুলে দিয়েছেন অমিত মিত্রের হাতে। প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার সেই পেশাদারি ব্যবস্থার শিকড়ই প্রশাসনে আরও গভীর করবে বলে সরকারি অফিসারদের একটি বড় অংশের মত।
তাঁদের বক্তব্য, এর ফলে দায়বদ্ধতার পাশাপাশি স্বচ্ছতার বিষয়টিও স্পষ্ট করে দেওয়া যাচ্ছে। যেখানে তথ্যের অধিকার আইনের মাধ্যমে সরকারের প্রায় সব কাজের খতিয়ান জেনে যেতে পারেন সাধারণ মানুষ, সেখানে আগেভাগে ক্যালেন্ডার
প্রকাশ করে কাজে নামাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রশাসনের এক কর্তা রসিকতা করে বললেন, “সংসারেও কিন্তু এ ভাবে আগাম পরিকল্পনা করে কাজ করা খুব কঠিন।”
কী ভাবে তিনি সরকারের কাজে স্বচ্ছতা এবং গতি আনতে চেয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “প্রতিটি দফতরকে বলে দিতে হয়েছে, তারা কোন কাজ কোন মাসে করবে। সেই লক্ষ্যমাত্রা আগে পূরণ করতে হবে। এর থেকে বড় স্বচ্ছতার প্রমাণ আর কী আছে!” প্রথম দিকে কিছু ভুলত্রুটি হবে, তবে পরের বছর তা শুধরে নেবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “নতুন বাড়িতে গেলে যেমন প্রথম দিকে ঘর সাজানো নিয়ে নানা খিটিমিটি লেগে থাকে, তার পর এক বার সাজিয়ে-গুছিয়ে বসলে আর সমস্যা থাকে না।”
কী ভাবে শুরু হয়েছিল ক্যালেন্ডার তৈরির প্রস্তুতি? মমতা বলেন, “মাসখানেক আগেই মুখ্যসচিবকে বলি, আমি কী করতে চাই, সেটা বছরের শুরুতেই জানিয়ে দেব। তখন এ নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা ছিল। কিন্তু যে ভাবে সমস্ত দফতর তাদের সারা বছরের পরিকল্পনা খুব সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে এই ক্যালেন্ডার তৈরি করেছেন, তাতে শুরুটা ভালই হল।” মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের কথায়, “একেবারেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনা ছিল এই ক্যালেন্ডার তৈরি। সব দিক দিয়েই অভিনব এই পদক্ষেপ।”
এ দিন ৩টে নাগাদ রাজ্যপাল নবান্নের পার্কিং এলাকায় আড়াইশো পাতার প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেন রাজ্যপাল। সেখানে রাজ্য সরকারের ৬১টি দফতরই ২০১৪ সালে মাস ধরে ধরে তাদের করণীয় কাজের খতিয়ান দিয়েছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘কন্যাশ্রী’র ছাত্রীরা অনুষ্ঠান করেন। তাদের হাতে ‘কন্যাশ্রী’র পুরস্কার তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। এর পরে ৪৫ দিনের মধ্যে নবান্নকে সাজিয়ে তোলার পুরস্কার পান হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশন (এইচআরবিসি) এবং পূর্ত দফতরের কর্তা-কর্মীরা। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনায় ভাল কাজের জন্য পুরস্কার পান স্বাস্থ্য দফতরের ৩১ জন কর্মীও। নবান্নর মঞ্চ থেকেই এ দিন মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করেন গঙ্গাসাগরে চতুর্থ জেটি এবং নব কলেবরে সেজে ওঠা যুব আবাস।
অনুষ্ঠানের পর মুখ্যমন্ত্রী নিজেই রাজ্যপালকে নবান্নে তাঁর ঘরে নিয়ে যান। রাজ্যপাল চোদ্দো তলায় উঠে মুখ্যমন্ত্রীর ঘর, অন্য সভাঘরগুলি ঘুরে দেখেন। প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে নানা আলোচনা করেন। মুখ্যমন্ত্রীর কনফারেন্স রুমে প্রায় ৪০ মিনিট চা-চক্রে সময় কাটান রাজ্যপাল।
রাজ্য প্রশাসনের সচিবালয়ে রাজ্যপালের পা-রাখার এই ঘটনা নজিরবিহীন। বলেছেন নারায়ণনই। তাঁর কথায়, “প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ যেমন অভিনব ঘটনা তেমনই আরও একটি নজিরবিহীন ঘটনা হল এ দিন রাজ্যপাল হিসেবে এই সচিবালয়ে আসা।” তিনি বলেন, “সাধারণত রাষ্ট্রপতির শাসন চললেই রাজ্যপালেরা সচিবালয়ে যান। কিন্তু আমি মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ ফেরাতে পারিনি।”
|