|
|
|
|
দাঙ্গা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল: মোদী
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি
২৭ ডিসেম্বর |
বারো বছর বাদে আদালত ক্লিনচিট দিল তাঁকে। এবং তার পর দিনই গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে মুখ খুলে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী জানালেন, এই দাঙ্গা তাঁকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কতটা? শোক, দুঃখ, বেদনা, ক্ষোভ এই শব্দগুলো দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে এর আগে যতবারই তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে, অধিকাংশ সময়েই তিনি সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু গত কাল আদালতের রায়ের পরে আজ প্রায় হাজার শব্দের ব্লগ লিখলেন তিনি। যেখান দাঙ্গাকে অমানবিক আখ্যা নিয়ে নিজের মানবিক দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করলেন ধাপে ধাপে। বললেন, দাঙ্গার সময়েও তিনি ক্রমাগত ঐক্য ও শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করে গিয়েছেন। দোষীদের শাস্তি দিয়েছেন। দেশের যে কোনও দাঙ্গার তুলনায় দ্রুত ও শক্ত হাতে তা মোকাবিলা করেছেন। তা সত্ত্বেও কিছু সঙ্কীর্ণ মন ও রাজনৈতিক স্বার্থ তাঁকে, গুজরাত ও গোটা দেশকে কালিমালিপ্ত করার নিরন্তর চেষ্টা করে গিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নজরদারিতে ক্লিনচিট পাওয়ার পর আজ তিনি শান্তি অনুভব করছেন বলেও জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, এই রায় তাঁর ব্যক্তিগত জয় বা পরাজয় নয়। বিরোধীদের প্রতিও সেই আবেদন রেখেছেন তিনি। |
|
নিখুঁত শব্দ চয়ন করে ব্লগে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে তাঁর মনের কথা জানিয়ে এক ঢিলে অনেক পাখি মারার চেষ্টা করলেন মোদী। এক, মোদী বুঝিয়ে দিলেন দাঙ্গার ঘটনা তাঁকে কতটা ব্যথিত করেছে। অথচ এই চরম যন্ত্রণা নিয়েও তিনি দক্ষ প্রশাসক হিসাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন।
দুই, দাঙ্গার জন্য ক্ষমা চাননি বটে। কিন্তু দাঙ্গার ঘটনা অমানবিক বলে তিনি পরোক্ষে এর নিন্দার পর্বটিও সেরে ফেললেন।
তিন, গত কালের রায়কে পুঁজি করে মোদী লোকসভা ভোটের আগে দাঙ্গার কলঙ্ক ধুয়েমুছে সাফ করে নিজের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।
চার, স্পষ্ট করেছেন ভবিষ্যতে এই সম্প্রীতির অবস্থান নিয়েই এগোবেন তিনি। বস্তুত, এই প্রক্রিয়া তিনি অনেক আগেই শুরু করেছেন সদ্ভাবনা যাত্রার মাধ্যমে।
পাঁচ, একই সঙ্গে বার্তা দিলেন দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকেও।
ছয়, দাঙ্গা নিয়ে তাঁর নামে যে বিরোধী-প্রচার চলে, সেই প্রচারকারীদেরও কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখলেন।
কিন্তু এর পরেও দাঙ্গার কলঙ্ক থেকে মোদীকে মুক্তি দিতে নারাজ তাঁর বিরোধীরা। কেন্দ্রের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারি বলেন, “ব্লগে কোথাও মোদী দাঙ্গার জন্য ক্ষমা চাননি। এতই যদি নির্দোষ হন, তা হলে অটলবিহারী বাজপেয়ী কেন তাঁকে রাজধর্ম পালন করার উপদেশ দিলেন!” অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনেল ল’ বোর্ডের সদস্য কমল ফারুকির মতে, “মোদী আদৌ দাঙ্গার জন্য আক্ষেপ জানাননি। বরং এই ব্লগ তাঁর নিছক রাজনৈতিক কৌশল।” কংগ্রেস শাসিত মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে রাহুল গাঁধী যখন সাংবাদিক সম্মেলন করতে আসেন, তাঁকে অবশ্য এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, “আমরা আজ এখানে দুর্নীতি মোকাবিলার কাঠামো নিয়ে আলোচনা করছি।”
এই ব্লগ কেন লিখলেন মোদী? সঙ্ঘ ও বিজেপি সূত্রের মতে, লোকসভা ভোটের আগে মোদীকে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। সঙ্ঘ তাঁকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ হিসেবে দেখতে চাইলেও মোদী নিজেই সচেতন ভাবে হিন্দুত্বের রাজনীতি করতে চান না। বিজেপির এক শীর্ষ নেতার কথায়, “লোকসভায় একার ক্ষমতায় বিজেপিকে দু’শোর বেশি আসন নিয়ে আসার লক্ষ্য রয়েছে মোদীর। সেই লক্ষ্যপূরণে শুধু মুসলমান নয়, হিন্দুদের কাছেও মোদীকে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে হবে। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে যদি মেরুকরণের জমি তৈরি করতে হয়, তা করবে সঙ্ঘ পরিবার। মোদী তাতে সক্রিয় অংশ নেবেন না।” এখানেই ওই নেতার প্রশ্ন, “তা হলে গত কালের রায়ের পরে দাঙ্গার ভূত ঘাড় থেকে নামাতে মোদী যদি একটি সুদীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন, তাতে আপত্তি কীসের?”
ব্লগে নিজের যন্ত্রণার কথা লিখলেও আসলে মোদীর ভঙ্গি যে আক্রমণাত্মক, তা-ও অস্বীকার করছেন না বিজেপি নেতারা। তাঁদের মতে, এ বারে মোদীর জবাব দেওয়ার পালা। মোদীর কৌশলের রূপকার অরুণ জেটলি আজই আর একটি ব্লগে লিখেছেন, “একটি মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে (মোদীকে ভিসা না দিয়ে) আমেরিকা অপরিপক্ক কূটনীতির পরিচয় দিয়েছে।” অন্য দিকে, কংগ্রেসকে কটাক্ষ করে মোদী ঘনিষ্ঠ নেত্রী স্মৃতি ইরানির মতে, “আদালত মোদীকে ক্লিনচিট দেওয়ার পরেও কংগ্রেস নেতারা মোদীকে ক্ষমা চাইতে বলছেন! যে অপরাধ মোদী করেনইনি, তার জন্য ক্ষমা কীসের?”
রাজনীতির ইতিহাসে নানা সময়ে এই ক্ষমার রাজনীতি ঘুরে ফিরে এসেছে। মোদীর কাছেও গুজরাত দাঙ্গার জন্য ক্ষমার প্রত্যাশা রয়েছে। জালিওয়ানাবাগের ঘটনাকে ‘গভীর লজ্জাজনক ঘটনা’ বলেছিলেন ডেভিড ক্যামেরন। কিন্তু ‘ক্ষমা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। বাবরি মসজিদের ঘটনার পর লালকৃষ্ণ আডবাণী মন্তব্য করেছিলেন, ওই ঘটনা তাঁর জীবনে সব থেকে দুঃখের দিন। সেই মন্তব্যেই সঙ্ঘ পরিবার তখন রে-রে করে উঠেছিল। মোদীর আজকের ব্লগে কোথাও ‘ক্ষমা’ শব্দটি না থাকলেও অন্তত এই ঘটনা ‘অমানবিক’ বলা হয়েছে। কারণ, ‘হিন্দুত্বের পোস্টার বয়’ থেকে ‘বিকাশ পুরুষ’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যেও তাঁকে সঙ্ঘ ও নিজের ভাবমূর্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে তিনি এই ক্ষমার রাজনীতির শরিক হবেন কি না, সেটাই এর পরে দেখার।
|
পুরনো খবর: দাঙ্গায় ছাড় পেলেও কমিশন -কাঁটা মোদীর |
|
|
|
|
|