মাত্র একটাই রিভলভার আছে, ভেবেছিল ষড়যন্ত্রীরা। তাদের ধারণা ছিল, সেই রিভলভার হাতিয়ে নিয়ে হামলা চালালেই ৯এ শর্ট স্ট্রিটের বিতর্কিত জমি-বাড়ি কব্জায় আসবে। কিন্তু সেখানকার বাসিন্দা রতনলাল নাহাটার যে আরও দু’-দু’টো বন্দুক আছে, হানাদারদের তা জানা ছিল না। ১১ নভেম্বর ওই জমি দখলের হামলা চালাতে গিয়ে সেই বন্দুকের গুলিতেই দু’জন বাউন্সার মারা যান বলে তদন্তকারীরা জানান। তাঁরা বলছেন, ওই বাড়িতে বাড়তি বন্দুকের কথা জানত না বলেই দখলদারেরা কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হানা দেয়নি।
তদন্তে নেমে চক্রীদের এই ভুলের কথা সম্প্রতি জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা বলছেন, শুধু বাউন্সার নয়, শর্ট স্ট্রিটের ওই জমি থেকে মমতা অগ্রবালদের উৎখাতের জন্য দাগি দুষ্কৃতীদেরও সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। ১১ নভেম্বরের হামলা ও গুলিতে মৃত্যুর ঘটনার আগে, ১৫ সেপ্টেম্বর জনা পঞ্চাশ দুষ্কৃতী সেখানে হানা দিয়েছিল। তারা ওই জমি-বাড়ির অন্যতম বাসিন্দা নাহাটার রিভলভার লুঠ করে বলে অভিযোগ। তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের দুই দাগি ডাকাত।
গোয়েন্দারা শুক্রবার জানান, ওসমান হোসেন ও মনজার হোসেন নামে ওই দুই দাগি ডাকাতের বিরুদ্ধে জগদ্দল, খড়দহ, নৈহাটি এলাকায় বহু দুষ্কর্মের অভিযোগ আছে। শর্ট স্ট্রিটে ১৫ সেপ্টেম্বরের হামলার পরে ব্যারাকপুর এলাকার একটি ডাকাতির ঘটনায় তারা ধরা পড়ে। সেই ডাকাতির মামলায় আদালত তাদের ব্যারাকপুর জেলে পাঠায়। ওই দুই দুষ্কৃতীকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করার জন্য আদালতে আবেদন জানান শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডের তদন্তকারীরা। বিচারক সেই আবেদন মঞ্জুর করায় এ দিন ব্যারাকপুর জেল থেকে এনে তাদের ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হয়। বিচারক তাদের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত শর্ট স্ট্রিট মামলার তদন্তকারীদের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রায় সাড়ে তিন মাসেও নাহাটার সেই রিভলভার উদ্ধার হয়নি বলে সরকারি আইনজীবী কৃষ্ণচন্দ্র দাস এ দিন ব্যাঙ্কশাল আদালতের বিচারক বিশ্বরূপ শেঠকে জানান। তদন্তকারী অফিসারদের সন্দেহ, ওসমান ও মনজার লুঠ হওয়া রিভলভারের হদিস জানে। সেই জন্যই তাদের পুলিশি হাজতে নিয়ে জেরা করা জরুরি। গোয়েন্দারা জানান, শর্ট স্ট্রিটের বিতর্কিত জমিতে থাকা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতা অগ্রবাল-সহ একাধিক ব্যক্তিকে সেখান থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেন পরাগ মজমুদার ও পিনাকেশ দত্ত। ১৫ সেপ্টেম্বরের হামলা সেই ষড়যন্ত্রেরই একটি পর্ব। পিনাকেশের নির্দেশে সামির রিয়াজ নামে এক আইনজীবী ওই দিন ওসমান ও মনজারের মতো আরও কয়েক জন দুষ্কৃতীকে শর্ট স্ট্রিটে হামলা চালানোর জন্য ভাড়া করেছিলেন। ঘটনাচক্রে রিয়াজের বাড়িও ব্যারাকপুরে।
গোয়েন্দাদের দাবি, জেরার মুখে রিয়াজ জানান, শর্ট স্ট্রিটের ওই জমিতে ঢুকে মমতা ও অন্য বাসিন্দাদের ভয় দেখিয়ে উৎখাত করতে ওসমান ও মনজারকে নিয়োগ করেছিলেন তিনিই। শর্ট স্ট্রিটের বাসিন্দা নাহাটার কাছে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে বলে খবর ছিল পরাগের কাছে। সেই আগ্নেয়াস্ত্র হাতাতে না-পারলে যে ওই জমি থেকে মমতাদের উৎখাত করা সম্ভব হবে না, তা বুঝেই ১৫ সেপ্টেম্বর সেখানে হানা দেয় দুষ্কৃতীরা। পরিকল্পনামাফিক শর্ট স্ট্রিটের জমি-বাড়িতে ঢুকে রিভলভার, মোবাইল এবং কয়েক হাজার টাকা লুঠ করে ওসমান ও মনজার। পরের দিন মমতা ডাকাতির বিষয়টি শেক্সপিয়র সরণি থানায় জানান। অভিযোগ, ওই থানার তদন্তকারী অফিসার নুর আলি ডাকাতির ঘটনাটিকে লঘু করে দেখান। জমি-বাড়ি দখলের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে নুরকেও পরে গ্রেফতার করা হয়।
গোয়েন্দারা জানান, দুই দাগি দুষ্কৃতীকে দিয়ে রিভলভার লুঠ করানোর পরে ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল, ওই জমির বাসিন্দাদের কাছে আর কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নেই। তাই পরবর্তী হামলার (১১ নভেম্বর) সময় তারা জনা পঁচিশ বাউন্সার ও নিরাপত্তারক্ষী পাঠালেও তাদের কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যেতে বলেনি। তাদের কাছে ছিল লোহার রড, লাঠি ইত্যাদি। ষড়যন্ত্রকারীদের ধারণা ছিল, ওই ষন্ডাগুন্ডা বাউন্সারেরা সহজেই প্রধান শিক্ষিকা, তাঁর দুই নিরাপত্তারক্ষী এবং অসুস্থ নাহাটাকে কাবু করে শর্ট স্ট্রিট থেকে উৎখাত করতে পারবে। বিশেষ ভাবে মমতাকে সরানোর জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা বাউন্সারদের সঙ্গে তিন জন মহিলা নিরাপত্তারক্ষীকেও পাঠিয়েছিল।
কিন্তু মমতার কাছে যে আরও দু’টি বন্দুক ছিল, ষড়যন্ত্রকারীরা তা জানত না। তদন্তকারীরা জানান, ওই দু’টি বন্দুকের লাইসেন্সও নাহাটার নামে। ১১ নভেম্বর দখলদারেরা হামলা করতেই মমতা ও তাঁর সঙ্গী ওই দু’টি বন্দুক থেকে গুলি চালান বলে অভিযোগ। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান দু’জন বাউন্সার। আহত দু’জন।
|