কিংসমিড টেস্টের প্রথম দিনটা দেখার পর মনে হচ্ছে, একটা ভুল ধারণা শুরুতেই ভেঙে দিয়ে ম্যাচ রিপোর্টে হাত দেওয়া ভাল।
মুরলী বিজয়, চেতেশ্বর পূজারাদের এমন অসাধারণ ব্যাট করতে দেখে অনেকেই দেখছি ডারবানের পিচকে কারণ হিসেবে তুলে আনছেন। অনেকেই দেখছি বলছেন, কিংসমিডের উইকেট আর আগের মতো নেই। গতি, বাউন্স সব গিয়েছে। ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা এখানে মস্তানি দেখাবে না তো কোথায় দেখাবে?
যেটা সম্পূর্ণ ভুল।
আমি নিজে কিংসমিডে খেলেছি। জানি ডারবানের উইকেট আগে কী ছিল, এখন কী হয়েছে। একটু গতি যে কমেছে আমিও মানছি। হয়তো একটু বাউন্সও। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, ড্রেসিংরুমে বসে একটা উইকেটকে যে রকম লাগে, ড্রেসিংরুমের বাইরে থেকে সে রকম মনে হয় না। যেটা মাঠের বাইরে বসে আমাদের কাছে সহজ লাগছে, মাঠের ভেতরে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। তখন ডারবানের এই উইকেটেই ডেল স্টেইনের গতিকে মারাত্মক মনে হবে। মর্কেলের বাউন্স দেখে বুক কাঁপবে।
সোজাসুজি বলছি, ডারবান উইকেটের চরিত্র এমন কিছু পাল্টে যায়নি যে, সেটা ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বিরাট সুবিধে করে দিচ্ছে। ভারত ভাল খেলছে, নিজেদের মাইন্ডসেট পাল্টে ফেলার জন্য। ডারবানের এমন উইকেট পেয়ে নয়, বিজয়রা যা খেলছে, তাতে ওদের যোগ্য মর্যাদা প্রাপ্য।
কিন্তু আবার দলগত মানসিকতা কতটা পজিটিভ বলা যাবে, বুঝে উঠতে পারছি না। এক দিকে, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি টস জিতে ব্যাট নিয়ে দু’বার ভাবছে না। টেস্ট সিরিজের প্রথম থেকে দেখছি, পিচ সবুজ কি না, সে সব না দেখে সোজা ব্যাটিং নিচ্ছে ভারত অধিনায়ক। অতীতে যেটা হত না। বিদেশের পিচে ঘাস দেখলে অনেকেই ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে ফেলত। প্রথমে বল করতে চাইত। ধোনি টেস্টে সেটা করেনি। কিন্তু ওই একই ধোনি আবার ডারবানের উইকেটে অশ্বিনকে টিমের বাইরে রেখে নামল। যেখানে কয়েক দিন আগেও ওয়ান ডে-তে বল ঘুরেছে। দলে নিল রবীন্দ্র জাডেজাকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে শেষ টেস্ট সিরিজে অশ্বিনের চেয়ে বেশি উইকেট আছে জাডেজার। টার্ন না পেলেও ও কিন্তু ‘অ্যাঙ্গেলে’ ব্যাটসম্যানকে বিট করাবে। |
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলে চোখ। ডারবানে অটল বিজয়। ছবি: এএফপি। |
“মুরলী বিজয় খুব ধৈর্য ধরে ইনিংসটা গড়ছে।
যার জন্য ওর যাবতীয় কৃতিত্ব প্রাপ্য।” —সুনীল গাওস্কর |
|
বিদেশে টেস্টে অশ্বিনের রেকর্ড পাতে দেওয়ার মতো নয়। ধোনি নাম না দেখে কার্যকারিতা দেখল— সবই বুঝলাম। কিন্তু তার পরেও অশ্বিনকে বসিয়ে রাখার মানে একটাই হয়, বিপক্ষের কুড়িটা উইকেট তোলাটা তোমার টার্গেট নয়। সে রকম হলে প্রজ্ঞান ওঝা তো দলে ছিল। জাডেজা বিশেষজ্ঞ বোলার নয় অশ্বিনের মতো। অতএব ওকে নিয়ে একটা ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ থাকছে। ওকে আমলারা মেরে দিলে ধোনিকেই কিন্তু তখন কাউন্টার স্ট্র্যাটেজি বার করতে হবে।
যাই হোক, বিজয়দের ব্যাটিংয়ে ফিরি। সফরের প্রথমেই লিখেছিলাম, মাত্র দু’দিন প্র্যাকটিস করে ভারত থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় মানিয়ে নেওয়া অত সোজা নয়। কিন্তু টিমটা যত সময় পাবে, তত ভাল খেলবে। খুব স্বাভাবিক ভাবে ওয়ান ডে সিরিজে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের পক্ষে ভাল কিছু করা কঠিন ছিল। সাউথ আফ্রিকার পিচ বুঝতে-বুঝতেই সিরিজ শেষ হয়ে গিয়েছে। ওরা যদি এক সপ্তাহ আগে দক্ষিণ আফ্রিকা যেত, ওয়ান ডে-তেও অন্য ভারতকে হয়তো দেখতেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ওয়ান ডে-টা ছিল প্রস্তুতি-পর্ব, যেটা টেস্টে ভারতের কাছে লাগছে। আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করছে, শর্ট বলের বিরুদ্ধে পূজারা-বিজয়দের পাল্টা মার! এত দিন আমরা শর্ট খেলতে ভয় পেতাম। আর এ দিন স্টেইন শর্ট লেগ, লেগ গালি রেখে রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে শরীর টার্গেট করে শর্ট করে গেল, কিন্তু তাতেও বিজয়রা শর্টে শট খেলে দিল! দক্ষিণ আফ্রিকার পিচে যা করা উচিত, ওদের সেটাই করতে দেখছি। লাইনের পিছনে গিয়ে খেলছে। ব্যাকফুটে ঠিকঠাক, দরকারে ফ্রন্টফুটেও আসছে। বল থেকে চোখ সরাচ্ছে না। দেখুন, এই পর্যায়ের ক্রিকেটে টেকনিকের চেয়েও বেশি দরকার মেন্টাল সেট-আপ। আপনি যখন ভারতের হয়ে খেলছেন, ধরেই নেওয়া হবে আপনার টেকনিক ভাল। বিদেশ সফরে গেলে দরকারটা পড়ে মানসিক কাঠিন্যের। যেটা বিজয়রা এই টেস্ট সিরিজে দেখাচ্ছে। খেয়াল করলে দেখবেন, ডারবান টেস্টে প্রথম দিনের একটা সেশনেও হারেনি ভারত। রান শুধু করেনি, করেছে আধিপত্য নিয়ে। টেস্টে যত বেশি সেশন জেতা যাবে, তত বেশি ম্যাচটা জেতার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।
তা হলে ভারত কি টেস্টটা জিতছে? আমি বলব, খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সেটা বলা। এখনও পর্যন্ত ৬০-৪০ সম্ভাবনা ভারতের দিকে। তার চেয়ে বরং একটা কথা বলা যায় এখন। শুক্রবার সকালের প্রথম সেশনটা যে জিতবে, তারা কিন্তু সিরিজ জয়ের পথেও অনেকটা এগিয়ে যাবে। ওই ২৭-২৮ ওভারে যদি ভারতের তিনটে উইকেট পড়ে যায়, তা হলে মুশকিল। কিন্তু যদি শ’খানেক রান ওঠে, একটার বেশি উইকেট যদি না যায়, তা হলে?
তা হলে ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন দেখাটা বোধহয় বাড়াবাড়ি হবে না! |