অর্থ ছড়িয়ে ফুটবল ম্যাচ কিংবা ফুটবলার কিনে নেওয়ার বিশ্বজনীন পান্ডা তারা। সেই উইলসন রাজ পেরুমল বা গাত্তুসোদের ছায়া আগামী দিনে কি বাসা বাঁধতে পারে ভারতীয় ফুটবলে? না কি এদেশের ফুটবলে ইতিমধ্যেই তারা জাল বিছিয়ে ফেলেছে লুকিয়ে-চুরিয়ে!
ফুটবল ম্যাচ গড়াপেটার বিষবাষ্প সুনীল ছেত্রীদের ফুটবলে যাতে না লাগে তার জন্যই এ বার ভারতে আসছেন ইন্টারপোল কর্তারা। ফেডারেশনের সঙ্গে জোট বেঁধে ১৫-১৬ জানুয়ারি নয়াদিল্লির তাজমহল হোটেলে দু’দিনের এক অভিনব কর্মশালারও আয়োজন করতে চলেছে ইন্টারপোল। ভারতীয় ফুটবলে যা এই প্রথম। আই লিগ খেলা ক্লাবগুলি এবং ফেডারেশনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন রাজ্য সংস্থার কর্তা, আইনজীবী, রেফারি, ক্লাব মালিক, ফুটবলারদের সংগঠন, বেটিং সিন্ডিকেট-সহ এ দেশের প্রথম সারির অন্তত পঞ্চাশ জন ফুটবল ব্যক্তিত্বকে এই কর্মশালায় যোগদানের জন্য ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে ইন্টারপোল এবং ফেডারেশনের তরফে। ফেডারেশন সূত্রে খবর, বিশ্ব ফুটবলে ম্যাচ গড়াপেটার বিভিন্ন নজির তুলে ধরে অংশগ্রহণকারীদের সতর্কবার্তা দিতে হাজির থাকার কথা আইসিসির দুর্নীতি দমন শাখার শীর্ষ কর্তারও। থাকবেন ইন্টারপোলের ম্যাচ গড়াপেটা টাস্ক ফোর্সের তিন কর্তা ডেভিড গ্রাহাম, জন অ্যাবট এবং কিথ ইপ।
দিল্লি থেকে ফেডারেশন সচিব কুশল দাস ফোনে আনন্দবাজার-কে বললেন, “বিশ্ব জুড়ে অর্থের বিনিময়ে ম্যাচ গড়াপেটার খবর বাড়ছে। ভারতীয় ফুটবল কিন্তু আগামী কয়েক বছরেই বহরে অনেক বাড়বে। দুর্নীতিগ্রস্তরা যাতে কোনও ভাবেই এ দেশের ফুটবলে ঢুকতে না পারে তার জন্যই এই কর্মশালা।” আরও বললেন, “আগামী দিনে আরও আকর্ষণীয় ভাবে আই লিগ পরিচালনা, ফুটবলের আই পিএল, অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ-সহ অনেক কর্মযজ্ঞ রয়েছে। তা কলুষিত হোক আমরা চাই না।”
যা শুনে চার্চিল ব্রাদার্স টিডি সুভাষ ভৌমিক বলছেন, “অতীতের মতো আজও বলছি আইপিএলের মতো সার্কাস চালু হলে ভারতীয় ফুটবলে জুয়াড়িদের অনুপ্রবেশ ঘটবেই। ফুটবলার জীবনে আন্তর্জাতিক ম্যাচে আমারই অভিজ্ঞতা রয়েছে এ ব্যাপারে। কর্মশালা হচ্ছে ভাল কথা। কিন্তু তখন তো ফেডারেশন কাপ চলবে। ফুটবলারদের তো পাওয়া যাবে না!” আর সুব্রত ভট্টাচার্য বললেন, “এত দিনে মৌচাকে ঢিল মারছে ফেডারেশন। ঠিকঠাক তদন্ত হলে ভারতীয় ফুটবলের অনেক রাঘববোয়ালই জালে জড়াবে।” |
• “অতীতের মতো আজও বলছি আইপিএলের মতো সার্কাস চালু হলে ভারতীয় ফুটবলে জুয়াড়িদের অনুপ্রবেশ ঘটবেই ফুটবলার জীবনে আন্তর্জাতিক ম্যাচে আমারই অভিজ্ঞতা রয়েছে এব্যাপারে। কর্মশালা হচ্ছে ভাল কথা। কিন্তু তখন তো ফেডারেশন কাপ চলবে। ফুটবলারদের তো পাওয়া যাবে না!” —সুভাষ ভৌমিক
• “এত দিনে মৌচাকে ঢিল মারছে ফেডারেশন। ঠিকঠাক তদন্ত হলে ভারতীয় ফুটবলের অনেক রাঘববোয়ালই জালে জড়াবে।” —সুব্রত ভট্টাচার্য |
|
দু’দিনের এই কর্মশালায় কোন কোন ব্যাপারে আলোকপাত হবে? এআইএফএফ সচিবের কথায় জানা যাচ্ছে, ১৫ জানুয়ারি কর্মশালা শুরুর দিন ফুটবল ম্যাচ গড়াপেটার ধরন, কারা জড়িত হয়ে পড়ে তা বিশ্বের নানা কেস স্টাডি-সহ আলোচনা করবেন জন অ্যাবট এবং কিথ ইপ। কুড়ি মিনিটের একটা সেশনে ক্রিকেটে ম্যাচ গড়াপেটার নানা খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করবেন আইসিসি কর্তাও। জানতে চাওয়া হবে এই ইস্যুতে অংশগ্রহণকারীদের অভিজ্ঞতার কথাও। কী ভাবে এই গড়াপেটার থেকে দূরে থাকা যাবে তা নিয়ে দ্বিতীয় দিন ক্লাস নেবেন ইন্টারপোল কর্তা ডেভিড গ্রাহাম। ভারতে কেউ এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন কি না তা-ও জানতে চাওয়া হবে।
আই লিগ খেলা কলকাতার চার প্রধান দলই এই কর্মশালায় প্রতিনিধি পাঠাবে বলে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইউনাইটেড স্পোর্টস কর্তা নবাব ভট্টাচার্য বললেন, “সম্পর্কের ভিত্তিতে কলকাতা ময়দানে তিন পয়েন্ট দেওয়া-নেওয়া হয় বলে শুনেছি। কিন্তু টাকার বিনিময়ে আই লিগে ম্যাচ গড়াপেটা হয়েছে বলে শুনিনি। সেই অভিজ্ঞতা যাতে ভবিষ্যতে না হয় তার জন্যই প্রতিনিধি পাঠাব।” মহমেডান স্পোটির্ং প্রধান সুলতান আহমেদ দিল্লি থেকে ফোনে বললেন, “শুধু ক্লাব বা কর্তা বা ফুটবলার কেন? রেফারিদের গতিবিধিও নজরে রাখা হোক। অনেক সন্দেহজনক নজির কিন্তু রয়েছে।”
তবে চমকে উঠতে হয় মোহনবাগান অর্থ-সচিব দেবাশিস দত্তর কথা শুনলে। চলে আসে আই লিগে ম্যাচ গড়াপেটার আশঙ্কাও। বললেন, “মোহনবাগানের স্পনসর হবে বলে মাস তিনেক আগে সিঙ্গাপুরের এক সংস্থা যোগাযোগ করে। আমরা ক্লাবে সেই সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকও করি। সেখানে ওই প্রতিনিধির কিছু কথা সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। ওরা রহস্যজনক ভাবে আমাদের বলেন, আমরাও আপনাদের কয়েকটা ম্যাচ সংগঠনের দায়িত্বে থাকব। বিষয়টা খোলসা করে জানতে চাইলে সেই ব্যক্তি বলেন, মানে আর কিছুই নয়। কখনও আপনারা জিতবেন। কখনও অন্য দল। এটাই খেলা।” বৈঠকে এই কথা শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন মোহনবাগান কর্তারা। “এর পর ওই সংস্থার সঙ্গে আমাদের ক্লাব আর কোনও যোগাযোগ করেনি। কর্মশালায় অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাওয়া হলে এটাও জানাব।” ‘অভিজ্ঞতা’ রয়েছে ইস্টবেঙ্গলেরও। এ বছরই এএফসি কাপে লাল-হলুদের বিরুদ্ধে নামার আগে অন্যত্র ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগে সাসপেন্ড হয়েছিলেন লেবাননের ফুটবলার রামিজ দায়ুব। সিঙ্গাপুরে তাম্পাইন্স রোভার্সের বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল দলের সঙ্গে সিঙ্গাপুর যাওয়া ক্লাবের সহ-সচিব শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত বললেন, “ওখানে ম্যানেজার্স মিটিংয়ে জেনেছিলাম লেবানিজ রেফারি ম্যাচ খেলাবেন। কিন্তু ম্যাচ খেলালেন ফিলিপিন্সের চার রেফারি। পরে জানতে পারি, যৌনতার বিনিময়ে অতীতে ম্যাচ গড়াপেটায় গ্রেফতার হয়েছেন চার লেবানিজ রেফারি।” |