হলুদ কার্ডেই ম্যাচ গড়াপেটার সঙ্কেত? যার দৌলতে ফুটবল-জুয়ার অশুভ ছায়া সাগরপারের মাঠ ময়দানে। এ দিন দুপুরের দিকে যে অশুভ ছায়া ইংল্যান্ড ফুটবলের নীচের ডিভিশনের উপর পড়েছে বলা হচ্ছিল। কিন্তু রাত বাড়তে সন্দেহ করা হচ্ছে ম্যাচ গড়াপেটার কালো ছায়া বিস্তার করে থাকতে পারে এমনকী প্রি-ওয়ার্ল্ড কাপের কতিপয় ম্যাচের উপরেও! বিশেষ করে ইউরোপ আর অস্ট্রেলিয়ার কোয়ালিফায়ার ম্যাচে।
পরের বছর ব্রাজিল বিশ্বকাপের ৩২ দেশের নাম দিনকয়েক আগেই চূড়ান্ত হয়েছে। ডিসেম্বরের গোড়াতেই ২০১৪ বিশ্বকাপের গ্রুপ বিন্যাস আর ড্র। যার কয়েক দিন আগেই ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)-র গোপন ভিডিও রেকডির্ংয়ে আন্তর্জাতিক বেটিং সিন্ডিকেটের জনৈক জুয়াড়ির চাঞ্চল্যকর মন্তব্য, “হ্যাঁ, আমরা অস্ট্রেলিয়া, স্কটল্যান্ড, আয়ার্ল্যান্ড, ইউরোপে ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচ গড়াপেটা করেছি।”
গোপন ভিডিও ক্যামেরার সামনে ওই ব্যক্তি আরও জানান, কোনও বিশেষ ফুটবলারকে ম্যাচ ফিক্সিং-জালে তুলতে ন্যূনতম খরচ পাঁচ হাজার পাউন্ড। আর সেই ফুটবলার যে জুয়াড়িদের টোপ গিলেছেন তা বোঝাতে ম্যাচের শুরুতেই তিনি অযথা হলুদ কার্ড দেখে সঙ্কেত পাঠাবেন গ্যালারিতে বসে থাকা ফিক্সারদের। এমনকী কুড়ি হাজার পাউন্ড পকেটে গুঁজে দিতে পারলে ম্যানেজ হয়ে যান রেফারিও।
চাঞ্চল্যকর এই আবিষ্কারের শুরু ফিফার সঙ্গে যোগাযোগে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর এক স্টিং অপারেশনে। যার জেরে ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) বুধবার রাতে ম্যাচ গড়াপেটায় গ্রেফতার করে ছয় ব্যক্তিকে। যাদের তিন জন আবার প্রাক্তন ফুটবলার বলে জানিয়েছে তারা। এদেরই এক জন বোল্টন ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ইপিএলে খেলা প্রাক্তন ফুটবলার দেলরয় ফ্যাসে। |
ম্যাঞ্চেস্টারের সেই গোপন বৈঠক
(ম্যাচ গড়াপেটাকারীর সঙ্গে আত্মগোপনকারী অফিসারের কথপোকথন) |
গড়াপেটাকারী: আমি অস্ট্রেলিয়া, স্কটল্যান্ড, আয়ার্ল্যান্ড, ইউরোপ সব জায়গায় ফিক্স করেছি। এমনকী বিশ্বকাপ, বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারও।
অফিসার: কী, বিশ্বকাপ!
গড়াপেটাকারী: অবশ্যই। অন্তত ১৫টা। আমি ম্যাচ কিনে নিই। এমনকী একটা আফ্রিকান দেশের পুরো টিমটাই আমি নিয়ন্ত্রণ করি।
অফিসার: ইউরোপে কোথায় কোথায়?
গড়াপেটাকারী: বেলজিয়াম, ফ্রান্সে আমার টিম আছে। এ সব জায়গায় ফুটবলারদের মাইনে খুব কম। জার্মানির মতো নয়। ফুটবলার, রেফারি সবাইকে কিনে নেওয়া যায়।
অফিসার: কী ভাবে এটা হয়?
গড়াপেটাকারী: আমি একজন রেজিস্টার্ড ফিফা এজেন্টের সঙ্গে কাজ করি। অর্থাৎ বিশ্বের যে কোনও জায়গায় ম্যাচ করতে পারি। আমার বস ওই এজেন্টকে টাকা দিয়ে লাইসেন্স নিতে বলেছিল। |
কে কততে ‘ম্যানেজ’ হয়
রেফারি: সাধারণত ২০ হাজার পাউন্ড।
ফুটবলার: ৫ হাজার পাউন্ড থেকে শুরু।
গোটা ম্যাচ: মোটামুটি ৫০ হাজার পাউন্ড। |
|
|
অভিযুক্ত এই ছ’জনকে জেরা করেই পাওয়া গিয়েছে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য। আর এতেই টলে যাওয়ার জোগাড় বিশ্ব ফুটবলের। এনসিএ সূত্রে জানানো হয়েছে গোটা ঘটনাটির পিছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক বেটিং সিন্ডিকেটের কিংপিনরা। গোটা ঘটনায় হতচকিত এফএ কর্তারাও। তবে বিষয়টি যে তাঁদের একেবারে অজানা ছিল না, তা এফএ-র তরফে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানা যাচ্ছে। যেখানে বলা হয়েছে, “তদন্তে নামার আগে এনসিএ পুরো ব্যাপারটাই আমাদের জানিয়ে রেখেছিল। তবে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যে রকম বড়সড় সাপ বেরিয়ে এসেছে তা হতবাক করে দেওয়ার মতোই। তদন্তের স্বার্থে আপাতত এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।”
স্টিং অপারেশনে নেমেছিলেন ওই সংবাদপত্রের তিন সাংবাদিক। তাঁদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই ফুটবল দুনিয়ায় সোরগোল পড়ে গিয়েছে। ম্যাঞ্চেস্টারে গোপন বৈঠকে (যার ভিডিও রেকর্ডিং রয়েছে) কথপোকথনে তদন্তকারী ব্যক্তি বেটিং সিন্ডিকেটের সেই জুয়াড়িকে যখন প্রশ্ন করেন, ‘‘সে কী, বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচ পর্যন্ত গড়াপেটা হয়েছে?” তখন জবাব আসে, “কম করে বিশ্বকাপের পনেরোটা কোয়ালিফায়ার ম্যাচ গড়াপেটা হয়েছে। আমরা কিনে নিয়েছিলাম।”
সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা গড়াপেটার অন্যতম ওই চক্রী আরও দাবি করেন, তিনি আফ্রিকার একটি দেশকে প্রি-ওয়ার্ল্ড কাপে পুরো নিয়ন্ত্রণ করেছেন। “পুরো টিমটাকে। ফিফার এক নথিবদ্ধ এজেন্ট আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে গোটা বিশ্বে ফুটবলে ম্যাচ গড়াপেটার বন্দোবস্ত করা সম্ভব আমাদের পক্ষে। বেলজিয়াম, ফ্রান্সেও আমাদের ম্যাচ গড়াপেটা করার দল রয়েছে।”
সংবাদপত্রটির তদন্ত রিপোর্টের সূত্র ধরেই পুলিশ জালে তোলে বোল্টন ওয়ান্ডারার্সের প্রাক্তন স্ট্রাইকার তেত্রিশ বছর বয়সি দেলরয় ফ্যাসেকে। দশ বছর আগে ফুটবল ছাড়ার পর এত দিন তিনি এজেন্ট হিসেবেই কাজ করছিলেন। আর আড়ালে চালাচ্ছিলেন ম্যাচ গড়াপেটার কাজ। |