মাস কয়েক হল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজস্ব আইন সংশোধন করে ‘রাজনৈতিক বন্দি’র সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে। এ বার সেই সংশোধনকে হাতিয়ার করে জেলবন্দি বিভিন্ন মাওবাদী নেতাকে দেওয়া রাজনৈতিক বন্দির তকমা ফিরিয়ে নিতে আদালতের দ্বারস্থ হতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন। ইতিমধ্যে সরকারি কৌঁসুলিদের কাছে বার্তা পৌঁছেছে, তাঁরা যেন এই মর্মে সরকারের আবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে নথিভুক্ত করেন।
কিন্তু ঘটনা হল, মাওবাদী ও তার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনকে কেন্দ্রীয় সরকার কয়েক বছর আগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তেমন কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি। এ প্রসঙ্গে রাজ্যের পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের বক্তব্য ছিল, তারা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভাবেই মাওবাদীদের মোকাবিলা করবে। তৃণমূল জমানাতেও সরকারের অবস্থান বদলায়নি, মাওবাদীদের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপেনি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। ফলে অন্তত খাতায়-কলমে মাওবাদীরা এ রাজ্যে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবেই কার্যকলাপ চালাচ্ছে।
তা হলে মাওবাদী বন্দিদের কাছ থেকে রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার প্রয়াস কেন, এখন সেই প্রশ্ন উঠছে। ঘটনা পরম্পরার বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে যার ব্যাখ্যা দিয়েছে নবান্ন-সূত্র।
কী রকম? সূত্রের বক্তব্য: ১৯৯২-এর পশ্চিমবঙ্গ সংশোধনাগার আইনে বলা ছিল, রাজনৈতিক বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িত অভিযোগে কেউ গ্রেফতার বা আটক হলে তাঁকে ‘রাজনৈতিক বন্দি’র গোত্রে ফেলা যেতে পারে। আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক বন্দিরা অন্যান্য সাধারণ কয়েদির তুলনায় বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধে পেয়ে থাকেন। যেমন শোওয়ার জন্য লোহার খাট, তোশক, বালিশ, মশারি, কম্বল প্রভৃতি। তাঁদের সেলে থাকবে পাখা, চেয়ার, টেবিল। পড়ার জন্য বই, পত্র-পত্রিকা তো বটেই, কাগজ-সহ লেখার সরঞ্জাম, এমনকী ভাল সাবান-টুথপেস্ট-ব্রাশ ইত্যাদিও তাঁদের জোগাবেন জেল-কর্তৃপক্ষ।
আইনের ব্যাখ্যা মোতাবেক আদালত এক মামলায় রাজ্যের অন্যতম মাওবাদী নেতা গৌরমোহন চক্রবর্তীকে রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদাদানের নির্দেশ দেয়। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে গৌরবাবুই হলেন প্রথম মাওবাদী নেতা, যিনি ওই সুবিধা পেয়েছেন। তাঁর উদাহরণকে সামনে রেখে পরে আদালতে একই সুবিধা চেয়ে আবেদন করেন কাঞ্চন, হিমাদ্রী, সন্তোষ দেবনাথ, রাজা সরখেল বা প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মতো মাওবাদী নেতা-কর্মীরা।
কোর্টের নির্দেশে একে একে ৬৫ জন মাওবাদী রাজনৈতিক বন্দির তকমা পেয়ে যান। পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি-র নেতা ছত্রধর মাহাতোও বাদ যাননি। যদিও এঁদের অনেকের বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ নিরোধক আইনে (ইউএপিএ) মামলা চলছে। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর রীতিমতো চিন্তায় পড়ে যায়। নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও।
এবং দিল্লির চিন্তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় আফতাব আনসারি। কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের সামনে সন্ত্রাস-হানা ও খাদিম-কর্তা অপহরণে দোষী সাব্যস্ত ফাঁসির আসামিটিও যখন রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা লাভের দাবি তোলে, তখন প্রমাদ গোনে কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের সংশোধনাগার আইনটিতে অবিলম্বে সংশোধন চেয়ে তারা রাজ্যকে চাপ দিতে থাকে। অবশেষে গত অগস্টে বিধানসভায় আইন সংশোধন করে বদলে দেওয়া হয় ‘রাজনৈতিক বন্দি’র সংজ্ঞা।
কী ভাবে? নতুন আইনে বলা হয়েছে: দেশের যে কোনও আইনে নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনও রাজনৈতিক সংগঠন বা উগ্রপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত অভিযোগে গ্রেফতার বা আটক কোনও ব্যক্তি রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা পাবেন না। নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যেরা নতুন সংগঠন গড়ে একই ধরনের কার্যকলাপ চালু রাখলে তাঁরাও যাতে ওই সুবিধে না-পান, নতুন আইনে সে সংস্থান রয়েছে। এমনকী, সাম্প্রদায়িক বা জাতি-ভাষাগত ভেদাভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে কোনও সংগঠন বা গোষ্ঠীর সদস্যেরা বিক্ষোভ-প্রতিবাদ দেখাতে গিয়ে গ্রেফতার বা আটক হলে তাঁরাও রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে গণ্য হবেন না।
অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ না-হলেও অন্যত্র বলবৎ নিষেধাজ্ঞার সুবাদে মাওবাদীরা সংশোধনটির আওতায় পড়ছেন। আর এটিকেই সামনে রেখে এখন মাওবাদীদের জন্য বরাদ্দ করা রাজনৈতিক বন্দির তকমা প্রত্যাহার করতে তৎপর হয়েছে রাজ্য। আইজি (কারা) রণবীর কুমারের কথায়, “মাওবাদী বন্দিদের অনেকেই পুরনো আইনে রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা পেয়েছেন। তার পরে আইনে সংশোধন আনা হয়েছে। এর ভিত্তিতেই আমরা নতুন করে আবেদন জানিয়ে আদালতের নির্দেশ চাইছি ।”
অন্য দিকে সরকারের পদক্ষেপকে অবৈধ বলেছে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর)। “নয়া আইন কখনও আগের ঘটনায় বলবৎ হতে পারে না। উপরন্তু ব্যাপারটা এখনও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।” বলছেন সংগঠনের নেতা রঞ্জিত শূর। তাঁর অভিযোগ, “রাজ্য সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণের মতো আচরণ করছে। এর থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত।”
|