ছাড়পত্রে দেরির দায় শিল্পের কেন, প্রশ্ন দফতরে
রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের কোনও প্রস্তাব যাতে একুশ দিনের মধ্যে প্রশাসনের ছাড়পত্র পেয়ে যায়, সেই লক্ষ্যে ‘এক জানলা’ (সিঙ্গল উইন্ডো) নীতি চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পায়নের এই প্রয়াসকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে গড়েছেন বিশেষ টাস্ক ফোর্স। জট ছাড়াতে প্রকল্পপিছু ‘রিলেশনশিপ ম্যানেজার’ নিয়োগের কথাও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এর পরেও বেশ কিছু প্রস্তাব নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়পত্র না-পাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। গত শুক্রবার টাউন হলে মন্ত্রীদের কাজের মূল্যায়ন পর্বে এ নিয়ে তিনি উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। শিল্প দফতরের তথ্য বলছে, ছাড়পত্রের অপেক্ষায় রয়েছে এখন ৫৩টি প্রকল্প। যার সিংহভাগই (৩৪টি) আটকে আছে ভূমি দফতরে।
বস্তুত শিল্প দফতরের কর্তাদের দাবি, চূড়ান্ত ছাড়পত্রের জন্য যে সব প্রকল্পের আবেদন দীর্ঘদিন পড়ে রয়েছে, তার একটাতেও তাদের আপত্তি নেই। সবই অন্যান্য দফতরে আটকে রয়েছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন। মূল্যায়ন-বৈঠকে অবশ্য অন্যান্য দফতরের তুলনায় মুখ্যমন্ত্রী শিল্প-কর্তাদেরই বেশি কড়া কথা শুনিয়েছেন। “কারণ, শিল্পে বিনিয়োগের ছাড়পত্র দেওয়ার দায়িত্ব শিল্প দফতরের হাতেই ন্যস্ত। অন্য দফতরের জট ছাড়ানোর দায়ও তাই তাদের উপরে বর্তায়।” যুক্তি দিচ্ছেন নবান্নের কর্তাদের একাংশ।
তবে শিল্প দফতরের একটি মহল এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের পাল্টা প্রশ্ন, “এক জানলা নীতি মেনে যখন ঠিক হয়েছিল যে, আবেদনের একুশ দিনের মধ্যে শিল্প-প্রকল্পে ছাড়পত্র দেওয়া হবে, তখন অন্যান্য দফতরও সম্মতি দিয়েছিল। এখন তারা ফাইল ছাড়তে ঢিলেমি করলে আমাদের দায় থাকবে কেন?” বরং ছাড়পত্র মঞ্জুরির জন্য শিল্প দফতর লাগাতার তদ্বির করে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে ভূমি, দমকল, সেচ-জলসম্পদ বা পরিবেশের মতো বিভিন্ন দফতরের তরফে তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি বলে শিল্প দফতরের এই মহলটি আক্ষেপ প্রকাশ করেছে।
নবান্নের খবর: সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের হয়রানি কমাতে শিল্প উন্নয়ন নিগম যে ‘এক জানলা’ পদ্ধতি চালু করেছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘শিল্পসাথী সেল।’ পাশাপাশি বিনিয়োগ-প্রস্তাব পেশের পদ্ধতিগত জটিলতা দূর করে যতটা সম্ভব সরল করার চেষ্টা হয়েছে। আবেদনপত্রের বহর কমিয়ে আনা হয়েছে সাকুল্যে সাত পাতায়। আবেদনগুলি শিল্প দফতর পাঠিয়ে দেয় বিশেষ টাস্ক ফোর্সের কাছে। প্রস্তাব বিবেচনা করে টাস্ক ফোর্স সুপারিশ করে, কীসের কীসের ছাড়পত্র আবেদনকারীকে নিতে হবে। শিল্পসাথী সেই মতো ভূমি, পরিবেশ, সেচ-জলসম্পদ, বিদ্যুৎ, অর্থ, কৃষি, দমকল বা শ্রমের মতো বিভিন্ন দফতরকে তা পাঠিয়ে দেয়। সংশ্লিষ্ট দফতরের সবুজ সঙ্কেত মিললে শিল্প-কর্তারা লগ্নিকারীকে ডেকে চূড়ান্ত ছাড়পত্র মঞ্জুর করেন।
লগ্নি-প্রস্তাব পেশ থেকে চুড়ান্ত মঞ্জুরি এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে মাঝের পর্বের কাজে গতি না-থাকাতেই অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করছেন শিল্প দফতরের কর্তাদের একাংশ। ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া পরিসংখ্যানের উল্লেখ করে তাঁদের এক জন হিসেব, “টাস্ক ফোর্স ছাড়পত্র দিতে সুপারিশ করেছে, এমন ৫৩টি প্রকল্পই আটকে রয়েছে অন্য নানা দফতরে। ভূমি দফতরেই ৩৪টি। ফলে বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলোয় অনুমোদন দেওয়া যাচ্ছে না।”
উল্লেখযোগ্য কী কী প্রকল্পের ছাড়পত্র থমকে রয়েছে?
শিল্প দফতরের খবর: ইস্টার্ন কোলফিল্ডস, ওএনজিসি কিংবা ম্যাটিক্স ফার্টিলাইজার-সহ বেশ কিছু ইস্পাত প্রকল্পের ছাড়পত্র আটকে রয়েছে পরিবেশ দফতরে। মনিকাঞ্চন, শিল্পাঙ্গনের মতো সরকারি শিল্পতালুক ছাড়াও দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেড, টেক্সম্যাকো, ডানকুনি সিমেন্ট, নর্থব্রুক জুটমিলের মতো ৯টি কারখানা বা শিল্পতালুকে দমকল-ছাড়পত্রের নবীকরণও ঝুলে রয়েছে। আর ভূমি দফতরে আটক ৩৪টি প্রকল্পের ১১টি হল শিল্প উন্নয়ন নিগমের নিজস্ব শিল্পতালুক। উপরন্তু শালবনিতে জিন্দালদের শিল্পতালুক, এসার অয়েল, গ্রেট ইস্টার্ন এনার্জি কর্পোরেশন, ডিভিসি-এমটার মতো বেশ কিছু ইস্পাত ও সিমেন্ট কারখানার জমির ছাড়পত্র (ভূমি-আইনের ১৪ওয়াই ধারা মোতাবেক ঊর্ধ্বসীমার অতিরিক্ত জমি রাখার অনুমতি বা মিউটেশন-কনভারশন সার্টিফিকেট) আসতে দেরি হচ্ছে।
বেশ কিছু শিল্প ইউনিটে জল বা বিদ্যুতের সংযোগ বরাদ্দের প্রশ্নেরও মীমাংসা হয়নি। এমন বিবিধ কারণে শিল্প দফতরও প্রকল্পগুলোয় চূড়ান্ত ছাড়পত্র মঞ্জুর করতে পারছে না বলে দাবি করছেন দফতরের অফিসারদের একাংশ। দফতরের অন্দরে এমনও আক্ষেপ শোনা গিয়েছে যে, মুখ্যমন্ত্রীর মূল্যায়নে অন্যান্য দফতরের কৃতকর্মের দায় চাপিয়ে শিল্পকেই তোলা হয়েছে কাঠগড়ায়। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই শিল্পসাথী ও টাস্ক ফোর্স তৈরি হয়েছে। যে সব জটিলতা ছিল, তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
কোনও দফতরকে দোষারোপ করছি না। কিন্তু সকলে তৎপর হলে সময়ে ছাড়পত্র দেওয়া যায়। আশা করব, আটকে থাকা প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি দ্রুত ছাড়পত্র দেবে।”
‘সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি’ কী বলছে?
শিল্প দফতরের হিসেব অনুযায়ী, জল তোলার অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে তিনটি প্রকল্প। যে প্রসঙ্গে সেচ-জলসম্পদমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “যত দূর জানি, আমাদের এখানে কোনও প্রকল্প আটকে নেই। যদি থাকে, দ্রুত ছেড়ে দেব।” শিল্পের তথ্য বলছে, দমকল দফতর ৯টি প্রকল্পে ছাড়পত্র ঝুলিয়ে রেখেছে। দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানের আশ্বাস, “আমার নজরে আসেনি। শিল্প দফতর আমাকে তালিকা পাঠালে চব্বিশ ঘণ্টায় অনুমোদন দিয়ে দেব।” পরিবেশে ‘আটক’ প্রকল্প সম্পর্কে ওই দফতরের এক কর্তার অবশ্য স্পষ্ট যুক্তি, “পরিবেশ-ছাড়পত্র একুশ দিনে দেওয়া যায় না। যে সব প্রকল্পের ক্ষেত্রে জন-শুনানি করতে হয়, সেখানে সময় লাগবেই। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”
আর সিংহভাগ আবেদন যেখানে আটকে, সেই ভূমি দফতরের কী ব্যাখ্যা?
মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ভূমি দফতরের দায়িত্বে। তাঁর প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথের বক্তব্য, “ভাল ভাবে খোঁজ না-নিয়ে কিছু বলব না। যদি প্রকল্প আটকে থাকে, তা হলে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”


থমকে মঞ্জুরি
দমকল
ভূমি ৩৪
পরিবেশ
সেচ-জলসম্পদ
কৃষি
মোট ৫৩
* লগ্নি প্রস্তাবের সংখ্যা
১৮ ডিসেম্বর, ২০১৩ পর্যন্ত পাওয়া হিসেব



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.