নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
জগতের অন্ধকার কেটে এখন আলো। প্রফুল্লনগরের টালির চালের বাড়িটায় বুধবার সত্যিই বড় দিন।
মুক্তির পরোয়ানা এসে গিয়েছিল আগের দিনই। তবু কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না খবরটা। উত্তেজনা আর আনন্দে সারা রাত জেগেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন জগৎ সরকার। কিন্তু প্রেসিডেন্সি জেলে এটাই যে তাঁর শেষ রাত, সেটা তখনও জানা ছিল না। জানতেন না জগতের বাড়ির লোকেরাও।
জগৎ ভেবেছিলেন, ছাড়া পেতে আরও দু’তিন দিন সময় লেগে যাবে। কিন্তু বুধবার সকালে জানতে পারলেন, এ দিনই তাঁর মুক্তি। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তখন। বাড়িতে বসে পরে গল্প করলেন, “আমি একেবারেই তৈরি ছিলাম না। তাই গোছগাছ করতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল।” শেষ পর্যন্ত দুপুরবেলা জগৎ জেলের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাইরের জগতে পা দিলেন, মুক্ত মানুষ হয়ে। প্রফুল্লনগরের বাড়িতে যখন দশ বছর পর আবার ঢুকছেন জগৎ, বাড়ির লোক ভুত দেখার মতো চমকে উঠেছে। তার পরই বাঁধভাঙা আনন্দে মেতে উছলেন সবাই। নতুন জীবন পাওয়া ছেলে নব্বই বছরের বৃদ্ধা মা আলাপি সরকারকে প্রণাম করলেন সবার আগে। মা বললেন, “আমি জানতাম, ছেলে এমন কাজ কিছুতেই করতে পারে না। কোনও না কোনও দিন ও সুবিচার পাবেই।” ছোটবেলার বন্ধু গৌতম সামন্তেরও একই কথা, “ও খুন করতে পারে বলে কোনও দিনই বিশ্বাস করিনি।” |
পুকুরে গিয়ে হাত-পা ধুয়ে আসা, গেটের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোই এ দিন মহার্ঘ মনে হচ্ছিল জগতের। চেনা জীবন-চেনা অভ্যাস যে এত দামি, হারিয়ে না গেলে তা বোঝা যায় না সচরাচর। জগৎ এ দিন সেটা বুঝছিলেন প্রতিটা পদে। লোকজন, সংবাদমাধ্যমের
ভিড় আবার এনে দিচ্ছিল একটা অচেনা স্বাদও।
আরও এক জন প্রায় অচেনা। মেয়ে ঝুমা। ছোট্ট মেয়েকে রেখে জেলে যেতে হয়েছিল। ক্লাস সেভেনের ছাত্রী তখন সে। সেই মেয়ে বড় হয়ে, পড়াশোনা শিখে বাবাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য লড়াই করল এই ঝুমাকে এখনও ততটা চেনেন না জগৎ। শুধু গর্বে বুকটা ফুলে আছে বাবা-র। বললেন, “ও (ঝুমা) যতটুকু এগিয়েছে, তার মধ্যে আমার কোনও অবদান নেই। অথচ মেয়েটা আমার জন্য কী না করেছে! দেখি, এখন যদি ছেলে আর মেয়েটাকে আর একটু ভাল করে পড়াতে পারি।” আর একটা ভাবনাও রয়েছে। “বিনাদোষে আমার যে দশ বছর নষ্ট হল, তা তো আর ফিরবে না। মুখ্যমন্ত্রীকে শুধু অনুরোধ, মেয়েটার যদি একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়।”
২০০৪ সালে শক্তি চক্রবর্তীকে খুনের মামলায় জগৎবাবুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল হাওড়া আদালত। জগৎবাবু ও শক্তিবাবু ছিলেন বন্ধু। আদালতে পুলিশ বলেছিল, জগৎবাবু নিজেই কবুল করেছেন খুনের অপরাধ। তাঁর সাহায্যেই উদ্ধার হয়েছে শক্তিবাবুর দেহ ও খুনের অস্ত্র। হাইকোর্টে প্রমাণ হয়েছে, পুলিশ মিথ্যা অভিযোগে জগৎবাবুকে ফাঁসানোর জন্য কেস সাজিয়েছিল।
মেয়ে কিন্তু কোনও দিন বিশ্বাস করেননি, বাবা খুনি। মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকে টিউশনি করে টাকা জমিয়েছেন ঝুমা। সেই টাকা নিয়ে দেখা করেছেন আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। জয়ন্তবাবু সামান্য টাকাতেই আপিল মামলা করতে রাজি হন। মঙ্গলবার হাইকোর্টে বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু ও বিচারপতি শিবশঙ্কর সাধুর ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, জগৎবাবুর অপরাধের কোনও প্রমাণ নেই। তাঁকে মুক্তি দেওয়া হোক। মঙ্গলবার রাত ন’টা নাগাদ প্রেসিডেন্সি জেলে পৌঁছে যায় জগৎবাবুর মুক্তির নির্দেশ। এ দিন
দুপুর বারোটা নাগাদ জেল থেকে মুক্তি পান তিনি।
দশ বছরের কারাবাস। নিজের কষ্টকে তাও বড় করে দেখছেন না জগৎ। বলছেন, “আমার থেকে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে বাড়ির লোকেরা। এই রকম সময় যেন কারও জীবনে না আসে।” জেলের জীবনের প্রতি বরং একটা শ্রদ্ধাই রয়েছে জগৎবাবু। তাঁর কথায়, “জেলে গিয়ে পড়াশোনা শিখেছি। মূর্তি গড়তে, গান গাইতে শিখেছি। জেল আমার কাছে আশ্রমের মতো।” যখনই কষ্ট হত, গলা ছেড়ে গান গাইতেন। জেলে বসেই পাথরের শিবমূর্তি গড়ে পাঠিয়েছিলেন মায়ের জন্য। তাঁর গড়া ভারতের মানচিত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি রয়েছে প্রেসিডেন্সি জেলের গেটে।
জগৎবাবুকে মুক্তি দিতে পেরে খুশি প্রেসিডেন্সি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের সুপার নবীন সাহাও। বললেন, “উনি জেলের মধ্যে খুব ভাল কাজ করতেন। সম্প্রতি জেলে বন্দিদের ভোটে পঞ্চায়েতের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।” জেলে থাকার সময়ে ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’য় অভিনয় করেছেন জগৎবাবু। পরিচালক অলকানন্দা রায় তাঁকে ডাকতেন ‘পাগলা জগৎ’ বলে। ওই নাটকে অভিনয় করেই বিখ্যাত হন নাইজেল আকারা। মুক্তির পর তিনিও নতুন জীবন শুরু করেছেন। দু’জনেরই শিক্ষক অলকানন্দা এ দিন বলেন, “ওঁর (জগতের) মধ্যে কোনও ছল-চাতুরি নেই। ঘটনাচক্রে আমি মঙ্গলবারই প্রেসিডেন্সিতে গিয়েছিলাম। খুউব আনন্দে ছিলেন। আনন্দে আমাকে গান শোনালেন।” জগতের গানের ভক্ত অলকানন্দা। বলেন, “ওঁকে বলেছি, গানটা উনি যেন না ছাড়েন।”
|
আমরা একসঙ্গে রিহার্সাল করতাম। মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তা করত। ও (জগৎ) মুক্তি পাওয়ায় আমি খুব খুশি। ও যেন একটা ভাল জীবন পায়।
নাইজেল আকারা |
|