মেয়ের লড়াইয়ে খুনির তকমা থেকে মুক্ত বাবা
ছর দশেক আগে বাবার যখন যাবজ্জীবন জেল হয়, মেয়ে তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। বিশ্বাস করত, বাবা খুনি নয়। টিউশনি করে জমানো টাকা আর একরাশ জেদ সম্বল করে সেই মেয়েই আইনি লড়াইয়ে মুক্ত করে আনল বাবাকে। ১০ বছর জেল খাটার পরে মঙ্গলবার হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস হলেন খুনের অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হুগলির রাজচন্দ্রপুর প্রফুল্লনগরের জগৎ সরকার। হাইকোর্টের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু ও বিচারপতি শিবশঙ্কর সাধুর ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, সম্পূর্ণ মিথ্যে অভিযোগে জগৎবাবুকে ফাঁসানোর জন্য মামলা সাজিয়েছিল পুলিশ।
স্বামীকে খুনের দায়ে ১৩ বছর জেলে থাকার পর অপরাজিতা (মুনমুন) বসু সম্প্রতি বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন। জেলে জগৎবাবুর সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছিল তাঁর। কিন্তু দু’জনের কাহিনির ওই বেকসুর খালাসের অংশটুকু এক হলেও বাকিটা একেবারেই আলাদা। জগৎবাবুকে মুক্ত করার কাণ্ডারী যখন তাঁরই মেয়ে, তখন মুনমুন মুক্তির পরেও তাঁর দুই ছেলেকে একটি বারও দেখতে পাননি। ছেলেরা জানিয়ে দিয়েছে, তারা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চায় না। এ দিন হাইকোর্টের রায় শোনার পরে মুনমুন বলেন, “জীবনের একটা বড় অংশ চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে কেটে গেল। জগৎ নিশ্চয়ই খুশি। ওকে মুক্ত করল ওর সন্তান। আর আমি মুক্ত হয়েও ছেলেদের এক বার দেখতেও পাইনি। একে কি মুক্ত হওয়া বলে!”
সুখী পরিবার। খুনের মামলায় জড়ানোর আগে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের সঙ্গে জগৎ।
আর ঝুমা? কিছু দিন আগে বিয়ের কথা উঠতেই ‘না’ করে দিয়েছিলেন বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ছাত্রীটি। পণ করেছিলেন, বাবাকে বেকসুর প্রমাণ না করা পর্যন্ত বিয়ে নয়। মঙ্গলবার তাঁর বাবাকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করে দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, এ দিনই রায়ের প্রতিলিপি জেলে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে হবে। দেখতে হবে যাতে কালক্ষেপ না করে জগৎবাবুকে মুক্তি দেওয়া হয়। পুলিশের দাবি ছিল, ২০০৪ সালের ১৪ মে জগৎবাবু থানায় এসে জানান, তিনি তাঁর বন্ধু শক্তি চক্রবর্তীকে খুন করেছেন এবং দেহটি রাজচন্দ্রপুর রেল স্টেশনের কাছে কালভার্টের নীচে ফেলে দিয়েছেন। শক্তিবাবুর দেহ ও খুনের অস্ত্রগুলি জগৎবাবুর সাহায্য নিয়েই উদ্ধার হয় বলেও দাবি করেছিল পুলিশ। যার ভিত্তিতে হাওড়া আদালত জগৎবাবুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
কিশোরী ঝুমার যদিও স্থির বিশ্বাস ছিল, বাবা খুনি নন। তাঁর কথায়, “শুনলাম, শক্তি চক্রবর্তীকে খুন করে বাবা নাকি আত্মসমর্পণ করেছেন। সে জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল তাঁর। এর বেশি কিছু বুঝিনি, জানতেও পারিনি তখন।” মাধ্যমিকের পর থেকে গৃহশিক্ষকতা করে বাবাকে ছাড়ানোর জন্য টাকা জমিয়েছিলেন ঝুমা। তা নিয়ে দেখা করেছিলেন আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সামান্য টাকাতেই আপিল মামলা করতে রাজি হন জয়ন্তবাবু।
মঙ্গলবার হাইকোর্টে ঝুমা। —নিজস্ব চিত্র।
মঙ্গলবার হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে হত্যা ও দেহ লোপাটে যে জগৎবাবুরই হাত আছে, পুলিশ তা প্রমাণ করতে পারেনি। যে সব অস্ত্র উদ্ধার হয়, সেগুলি ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানোই হয়নি। এক জনকে দোষী সাব্যস্ত করার সময়ে নিম্ন আদালত এই বিষয়গুলি খতিয়ে দেখেনি বলেও মন্তব্য করেছে কোর্ট। বলেছে, পুলিশের চার্জশিটের উপরে ভরসা করেই জগৎবাবুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছিল। জয়ন্তবাবুর কথায়, “মামলার কাগজ পড়ে দেখি হাওড়া কোর্টের রায়ে অসংখ্য ত্রুটি। সন্দেহের অবকাশ থাকলে কখনওই শাস্তি দেওয়া যায় না। প্রকৃত অপরাধী ছাড়া পেলেও কোনও নিরপরাধ মানুষকে যেন শাস্তি দেওয়া না হয়, এটাই দেশের বিচার ব্যবস্থার মূল কথা।” পেশায় রংমিস্ত্রি জগৎবাবুই ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। আর্থিক অনটনের পাশাপাশি মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যেই কৈশোর কেটেছে ঝুমা ও তাঁর ভাই বাপনের। অল্পশিক্ষিত মা পরিচারিকার কাজ শুরু করেন। ঝুমা জানান, বাবা খুনের অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত বলে পরিচিতদের কাছে অনেক সময়ে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে তাঁদের। আবার জেঠু গোবিন্দ সরকারের মতো কাউকে কাউকে পাশেও পেয়েছেন। কিন্তু হতাশা অনেক সময়েই চেপে বসত। ঝুমার কথায়, “ছোটবেলায় বন্ধুরা যখন তাদের বাবার গল্প করত, আমি আর ভাই চুপচাপ শুনতাম। ভাবতাম, আমাদের জীবনটা এমন কেন হল!” জেলে জগৎবাবু অভিনয় করতেন। ভাল ছবি আঁকেন, গান করেন।
ভাস্কর্য নির্মাণেও পটু। জেলে ছবি আঁকা ও ভাস্কর্যের কাজও শেখাতেন। ঝুমা বলেন, “আমারও খুব ইচ্ছে ছিল সে সব শেখার। কিন্তু সুযোগ হয়নি। অলকানন্দা রায়ের নির্দেশনায় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় অভিনয় করেছিলেন বাবা। দেখতে গিয়েছিলাম। বাবাকে মঞ্চে দেখে আমি-মা-ভাই অঝোরে কেঁদেছি। মনে মনে বলেছি যে করেই হোক, মানুষটাকে গারদের বাইরে বের করতে হবে।” দেরিতে হলেও হাইকোর্টের এই রায়ে বিচারব্যবস্থায় ফের বিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন ঝুমা। “শনিবার বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে আমার। তখনও জানতাম না যে, মুক্তি এত কাছে। রায়ের পরে আর কথা হয়নি ওঁর সঙ্গে। মা’কে জানিয়েছি। কারও আনন্দ আর বাঁধ মানছে না।” তার মধ্যেও লক্ষ্যে অটল মেয়েটি বলেন, “একটা লড়াই জিতলাম ঠিকই। তবে অনেক পথ চলা বাকি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষক হতে চাই। এখন সেই স্বপ্ন পূরণের লড়াই জেতার প্রস্তুতি নেব।”





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.