বিদেশ থেকে চোরা পথে ১৫ গ্রাম সোনা আনতে পারলে মুনাফা সাত হাজার টাকা! ব্যাঙ্কক-দুবাই-হংকংয়ের মতো জায়গার সঙ্গে ভারতের সোনার দামের এই ফারাকটাই পাচারকারীদের মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এখন তাই চোরাপথে সোনা আনতে ওই সব দেশে নিত্যযাত্রীদের মতো যাতায়াত করছে পাচারকারীরা। যা দেখেশুনে শুল্ক দফতরের কর্তাদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। নিত্যদিন যাতায়াত করা এই যাত্রীদের নামের তালিকা পরীক্ষা করে খিদিরপুর ও হাওড়া এলাকার বেশ কয়েক জনের নাম জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।
শুল্ক দফতরের অফিসাররা অনেকেই মানছেন, লুকিয়ে সোনা আনতে গিয়ে কখনও, কেউ হয়তো ধরা পড়ছে। কিন্তু তাঁদের নজর এড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সিংহভাগ পাচারকারী। দফতর সূত্রের খবর, নভেম্বর থেকে গত দেড় মাসে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বাজেয়াপ্ত হয়েছে ৩৬ কিলোগ্রাম সোনা, যার দাম ১০ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে জেট বিমানের শৌচাগারে লুকানো ছিল ২৪ কিলোগ্রাম সোনা, এয়ার ইন্ডিয়ার এক অফিসারের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে ৭ কিলোগ্রাম। এই সব ঘটনায় ধরা পড়েছেন বেশ কয়েক জন। ধৃতদের জেরা করে গোয়েন্দারা নিশ্চিত, বছর খানেক ধরে কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে কয়েক কোটি টাকার সোনার বিস্কুট পাচার হয়ে গিয়েছে।
কী ভাবে সোনা পাচার হয়ে কলকাতায় ঢুকছে? |
শুল্ক দফতরের অফিসারদের অভিজ্ঞতা হল, পাচারের জন্য অন্য রাজ্যের কারবারিরা নিত্যনতুন পদ্ধতি অবলম্বন করছে। কখনও টর্চ বা মোবাইলের ব্যাটারির খাপে, কখনও ট্রলি ব্যাগের তলায় সোনার বিস্কুট ঢুকিয়ে তার উপর কালো করে আনা হচ্ছে। কখনও আবার সোনা গলিয়ে বালা, আংটি, চেন তৈরি করে তা শরীরে পরে নিয়ে আসছে পাচারকারীরা। আবার, কলকাতা বা আশপাশের একদল ব্যবসায়ী পকেটে, কাপড়ের গাঁটরি, বা বেল্টের তলায় লুকিয়ে আনছে পাচারের সোনা।
কেন এই ঝুঁকির পাচার, ধৃত এক সোনা পাচারকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তাঁদেরই এক জন জানান, ব্যাঙ্ককের বাজারে সাড়ে ১৫ গ্রাম সোনার দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৩৪ হাজার টাকা। একেবারে খাদহীন সোনা। অথচ ভারতের বাজারে খাদ মেশানো ১০ গ্রাম সোনার দাম ৩০ হাজার টাকা। ফলে ব্যাঙ্ককের ১৫ গ্রাম সোনা অনায়াসে ভারতের বাজারে ৪৫ হাজার টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। যারা আনছে, তাদের বিমান ভাড়া ও কিছু পারিশ্রমিক দিয়েও মুনাফা থাকছে প্রায় ৭ হাজার টাকা।
বিমানবন্দর সূত্রের খবর, গত ক’ মাসে বাজেয়াপ্ত সোনার বিস্কুটের ওজন ছিল যথাক্রমে ১১২ গ্রাম, ১৫৫ গ্রাম এবং ১৭৫ গ্রাম। এক একটি বিস্কুট থেকে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা মুনাফার সুযোগ। গোয়েন্দারা জানায়, যারা এই চোরাচালানের সোনা নিয়ে ব্যবসা করছে, তারা এমন ঝুঁকির পাচারে যুক্ত নয়। ছোটখাটো যে সব ব্যবসায়ী মূলত নিজেদের ব্যবসার কারণে নিয়মিত ব্যাঙ্কক-হংকং-দুবাইয়ের রুটে যাতায়াত করে, পাচারের কাজে এদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিক জায়গায় সোনা পৌঁছে দিলে ছোট ব্যবসায়ীরা পাচ্ছে প্রায় ৩ হাজার টাকা। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, ঝুঁকি থাকলেও অতিরিক্ত টাকার লোভেই ছোট ব্যবসায়ীদের একাংশ সোনা আনতে প্রায় ‘ডেলি-প্যাসেঞ্জারি’ শুরু করে দিয়েছে। সম্প্রতি এমনই এক যাত্রীর পাসপোর্ট দেখে বিস্মিত হন শুল্ক অফিসারেরা! সোমবার সে কলকাতা থেকে ব্যাঙ্কক যায়। আবার পরের দিনই ফিরে আসে। একই ভাবে গত বৃহস্পতিবার ব্যাঙ্কক গিয়ে সে ফিরেছে শনিবার। এমনও হয়েছে, কলকাতা থেকে এক যাত্রী ভোরের বিমানে ব্যাঙ্কক পৌঁছেছে। বিমানবন্দরের বাইরে নির্দিষ্ট লোকের কাছ থেকে সোনার বিস্কুট সংগ্রহ করে রাতের উড়ানেই আবার কলকাতায় ফিরে এসেছে। এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, “বছরখানেক আগেও সোনা পাচারের এই ব্যবসা চলছিল খুবই চুপিসাড়ে। কিন্তু সম্প্রতি সোনা আমদানির উপরে করের পরিমাণ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই সরকারি ভাবে সোনা আমদানি কমলেও বাজারে তার চাহিদা রয়ে গিয়েছে। সোনা পাচার করে অধিক মুনাফার রাস্তা খুলে গিয়েছে এর জেরে। যত দিন যাচ্ছে, কলকাতা ও আশপাশের ছোট ব্যবসায়ীরা আরও বেশি সংখ্যায় এই সোনা পাচারের চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে।”
|