ঠিক সিনেমার মতো, কিন্তু আসলে সিনেমা নয়!
সোমবার সকালের বিমানবন্দর। নতুন টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে নিঃসাড়ে কার-পার্কিংয়ে পৌঁছলেন একটি বিমান সংস্থার এক কর্মী। তাঁর শার্টের তলায় পেটে বেল্টের মতো করে পেঁচানো কাপড়। সেই কাপড়ের ফাঁকে ফাঁকে ৬৪টি সোনার বিস্কুট। সেই কার-পার্কিংয়েই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন দু’জন। আধো-অন্ধকারে দাঁড় করানো সেই গাড়ির পিছনে গিয়ে শার্ট তুলে সোনায় মোড়া সেই বেল্ট খুলে ফেললেন ওই কর্মী। তা তুলে দিলেন গাড়িতে থাকা দু’জনের হাতে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আচমকা উদয় হলেন ‘ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স’ (ডিআরআই)-এর এক দল অফিসার। হাতেনাতে তাঁরা ধরে ফেললেন বিমান সংস্থার ওই অফিসার আর গাড়িতে অপেক্ষা করা দু’জনকে। যাঁদের মধ্যে এক জন আবার অন্য দেশের নাগরিক।
এখানেই শেষ নয়। বিমান সংস্থার ওই সোনা পাচারকারী কর্মীকে নিয়ে বিমানবন্দরের একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়লেন ডিআরআই অফিসারেরা। যে বিদেশিদের ভারতে ঢোকার ভিসা থাকে না, সেই সব বিদেশি যাত্রীরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার পথে বিমানবন্দরের যেখানে অপেক্ষা করেন, সেই ট্রানজিট লাউঞ্জে পৌঁছলেন তাঁরা। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন আর এক বিদেশি। যিনি দুবাই থেকে কলকাতায় এসে ঢাকা যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, তাঁর কাছ থেকেই সোনা নিয়েছিলেন বিমান সংস্থার ওই কর্মী। পুলিশ জানিয়েছে, এক-একটি বিস্কুটের ওজন প্রায় ১১৭ গ্রাম। সব মিলিয়ে ৭ কিলো ২০০ গ্রাম। যেগুলোর বাজার দর প্রায় ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা।
বিমানবন্দর সূত্রের খবর, ধৃত কর্মীর নাম বিনীত জেভিয়ার তিরকে। তিনি দীর্ঘ দিন ধরেই এয়ার ইন্ডিয়ায় কাজ করছেন। গোয়েন্দাদের ধারণা, সম্ভবত এর আগেও তিনি এই ধরনের ‘অপকর্ম’ করেছেন। এয়ার ইন্ডিয়ার তরফেও সোমবারের ঘটনার কথা স্বীকার করা হয়েছে। এ দিনের পাচার সম্পর্কে আগে থেকেই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন ডিআরআই অফিসারেরা। সোমবার ভোর থেকে তাঁরা ওত পেতে ছিলেন বিমানবন্দরে। এ দিন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ এমিরেট্সের উড়ানে দুবাই থেকে কলকাতায় নামেন এ আলি নামে বাংলাদেশি ওই যাত্রী। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে সন্ধ্যায় তাঁর ঢাকা উড়ে যাওয়ার কথা ছিল। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, ট্রানজিট লাউঞ্জে তাঁর উপরে দূর থেকে নজর রাখছিলেন গোয়েন্দারা। খবর ছিল, কলকাতাতেই কারও হাতে তুলে দেওয়া হবে সোনা। এক সময়ে আলি শৌচাগারে গেলে তাঁর পিছনে পিছনে সেখানে ঢোকেন তিরকে। পিছু নেন গোয়েন্দারাও। সেই শৌচাগারেই আলির পেটে জড়ানো সোনা-সহ কাপড়ের বেল্ট চলে আসে তিরকের পেটে। তিরকে সেটা নিয়ে সটান হাঁটা দেন বিমানবন্দরের বাইরে।
কার-পার্কিংয়ে এক ভারতীয় যুবকের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল ওই সোনা। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, সেই ভারতীয়ের সঙ্গে ছিলেন আরও এক বাংলাদেশি যুবক। যাঁদের নাম তদন্তের স্বার্থে জানাতে রাজি হননি গোয়েন্দারা। জানা গিয়েছে, কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করার জন্যই নাকি এই বাংলাদেশি যুবক দু’দিন আগে কলকাতায় এসেছিলেন। তবে সোমবার সকালে কলকাতা বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনালে এত সন্তপর্ণে পুরো বিষয়টির সমাধা হয় যে, অন্য যাত্রী বা বিমানবন্দরের কর্মী-অফিসারদের বেশির ভাগই ঘূণাক্ষরেও জানতে পারেননি এই ঘটনার কথা। দুপুরের মধ্যে পুরো ‘কাজ’ সেরে ফেলে ডিআরআই। আটক করা হয় দুই বিদেশি-সহ মোট চার জনকে। রাত পর্যন্ত কলকাতা বিমানবন্দরের ভিতরেই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলে। তাঁদের মধ্যে এক জনের শহরে ঢোকার ভিসা পর্যন্ত ছিল না। আটক ব্যক্তিদের সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে বিকেলের পরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় হানা দেন দফতরের অফিসারেরা।
এর আগে ২০১১ সালে মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ পাচার করতে গিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে শুল্ক অফিসারদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ বিমানের এক অফিসার। কিন্তু, সোনা নিয়ে এই প্রথম ধরা পড়লেন কোনও বিমান সংস্থার কর্মী। গত মাসে জেট এয়ারওয়েজের একটি বিমান পটনা থেকে কলকাতায় নামার পরে তার দু’টি শৌচাগার থেকে ২৪ কিলোগ্রাম সোনা পাওয়া যায়। যার বাজারদর ৭ কোটিরও বেশি। কিন্তু, সেই সোনার কোনও দাবিদার ছিল না। ঘটনার তদন্তে নেমে শুল্ক অফিসারদের ধারণা হয়, পাচারকারী এই সোনা শৌচাগারে রেখে নেমে গিয়েছেন। সন্দেহ হয়, সেই সোনা শৌচাগার থেকে অন্য কারও বার করে নেওয়ার কথা ছিল। এই পাচারের সঙ্গে বিমান সংস্থার কর্মীদের যোগাযোগ রয়েছে বলেও সন্দেহ হয় অফিসারদের। তাই, সে দিনের ওই বিমানে কর্মরত সকলের সম্পর্কে বিশদ তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে শুল্ক দফতর।
শুল্ক দফতরের এক অফিসারের কথায়, “কলকাতা দিয়ে সোনা পাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে। যেগুলি সম্পর্কে আমাদের কাছে আগে থেকে তথ্য থাকছে বা যেগুলি দেখে আমাদের অফিসারদের তৎক্ষণাৎ সন্দেহ হচ্ছে, কেবলমাত্র সেগুলিই ধরা পড়ছে।” মনে করা হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্কক ও দুবাই থেকে চোরাপথে শহরে ঢুকছে সোনা।
এ দিকে, রবিবার রাতে ব্যাঙ্কক থেকে কলকাতায় এসে সোনা-সহ ধরা পড়েছেন চার ভারতীয় যুবক। তাঁদের মধ্যে রাজেশ সাউ এবং আদিত্য সিংহের কাছ থেকে একটি করে সোনার চেন ও বালা পাওয়া গিয়েছে। তাঁরা সেগুলিতে রুপোলি রং করে নিয়ে এসেছিলেন। ইন্দ্রপাল যাদব নামে এক যাত্রী তাঁর ট্রাউজার্সের ছোট পকেটে তিন টুকরো সোনার বার নিয়ে এসেছিলেন। আরেক যাত্রী রবি ভান কোমরে বেল্টের তলায় কাপড়ের মধ্যে ৬টি ছোট ছোট সোনার বার নিয়ে আসেন। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম সোনা বাজেয়াপ্ত হয় সোমবার সকালেই।
|