বিমানের শৌচাগারে ৭ কোটির সোনা
কালো চামড়ার দু’দু’টো পাউচব্যাগ। তাদের শুঁকে দেখছে বাঘা বাঘা কুকুর। উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সিআইএসএফ, দমকল, পুলিশ এবং বিমানবন্দরের আধিকারিকরা।
নাহ্, বোমা নয়। এক প্রস্ত স্বস্তি। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেটা বদলে গেল দমবন্ধ বিস্ময়ে! একটি বিমানের শৌচাগার থেকে পাওয়া ওই দুই পাউচব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক সোনার বার! সিগারেটের প্যাকেটের মতো আয়তন, ওজন এক কিলোগ্রাম। মোট ২৪টা বার, মানে ২৪ কিলোগ্রাম সোনা! শুল্ক দফতরের হিসেবে যার বাজারদর প্রায় ৭ কোটি ২২ লক্ষ টাকা।
সোমবার রাতে এমনই নাটকীয় ঘটনার সাক্ষী থাকল কলকাতা বিমানবন্দর। বিস্ময়ের প্রাথমিক ঘোর কাটিয়ে ওঠার পরই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, বিমানের মধ্যে এত সোনা নজর এড়িয়ে ঢুকল কী ভাবে? কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে ২৪ কিলোগ্রাম সোনা যদি বিমানের শৌচাগারে রেখে আসা যায়, তা হলে বিস্ফোরক রাখলেই বা ধরা পড়বে কী করে? কারা এর পিছনে? বিমানকর্মী বা বিমানবন্দরের কর্মীদের একাংশের মদত ছাড়া কি আদৌ এমন সম্ভব?
সব মিলিয়ে আকাশপথের নিরাপত্তা নিয়েই বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিল সোমবারের রাত। এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। প্রাথমিক তদন্তে ওই সোনা দুবাই থেকে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
জেট এয়ারওয়েজের বিমানটি পটনা থেকে রাত আটটায় কলকাতায় নামার পরে ১৫ মিনিটের মধ্যে যাত্রীরা নেমে গিয়েছিলেন। সাড়ে আটটার পরে ইঞ্জিনিয়াররা বিমানটি পরীক্ষা করতে শুরু করেন। বিমানসংস্থা সূত্রের খবর, ৩০ দিন অন্তর প্রতিটি বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়। এই বোয়িং ৭৮৭ বিমানটির ক্ষেত্রে সোমবার রাতই ছিল সেই কাজের নির্ধারিত সময়। বিমানটি তখন বিমানবন্দরের ৪৯ নম্বর পার্কিং বে-তে দাঁড়িয়ে।
বিমানসংস্থা সূত্রের খবর, এক মহিলা ইঞ্জিনিয়ার বিমানের পিছনে বাঁ দিকের শৌচাগারটি পরীক্ষা করছিলেন। রুটিনমাফিক কমোড-এর উপরের ঢাকনাটি খুলে পিছনের বিদ্যুতের প্যানেল পরীক্ষা করতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে একটি কালো পাউচব্যাগ। মহিলা কর্মী বিষয়টি তৎক্ষণাৎ উর্দ্ধতন কর্তাদের জানান। খবর যায় সিআইএসএফ-এর কাছে। পরিত্যক্ত ওই পাউচব্যাগে বোমা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর নিয়ে সিআইএসএফ কর্তারা চলে আসেন। ডেকে পাঠানো হয় দমকল ও পুলিশকে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং শুল্ক দফতরের অফিসারেরাও চলে আসেন। খালি বিমানটিকে টেনে দ্বিতীয় রানওয়ের কাছে পরিত্যক্ত বে-তে নিয়ে যাওয়া হয়।
উদ্ধার হওয়া সোনার বার। —নিজস্ব চিত্র।
বিমানবন্দর সূত্রের খবর, শৌচাগারের কমোডের পিছনে রাখা চামড়ার ওই পাউচব্যাগটি কায়দা করে দড়ি দিয়ে বেঁধে সন্তর্পণে নামিয়ে আনা হয় বিমানের বাইরে। কুকুরকে দিয়ে শুঁকিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে যখন বোঝা যায় যে, ওতে আর যাই হোক বিস্ফোরক নেই, তখন খোলা হয় ব্যাগটি। ব্যস, তার পরেই সকলের চক্ষু চড়কগাছ! ডজনখানেক সোনার বার ঝকমক করছে ভিতরে!
এ বার দ্বিতীয় দফায় খোঁজ-তল্লাশির পালা! ঠিক হয়, বিমানটি আবার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হবে। হয়তো আরও সোনা লুকোনো রয়েছে! বিমান সংস্থার ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে এ বার সিআইএসএফ অফিসারেরাও বিমানে উঠে তল্লাশি শুরু করেন। আসনের সামনে-পিছনে, হাতব্যাগ রাখার জায়গায় তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়। বিমানের সামনের দিকেও রয়েছে একটি শৌচাগার। সংস্থার এক অফিসার এ বার সেই শৌচাগারে ঢুকে কমোডের ঢাকনা খুলে ফেলেন। বেরিয়ে পড়ে দ্বিতীয় পাউচব্যাগ। একই রকম দেখতে। দু’টি ব্যাগের উপরেই ইংরেজির ‘এ’ অক্ষর খোদাই করা। দ্বিতীয় সেই ব্যাগও বিমান থেকে নামিয়ে কুকুর দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়। এ বারেও বিস্ফোরক মেলে না। ব্যাগ খুলে দেখা যায়, সেখানেও রয়েছে সোনা!
শুল্ক দফতর সূত্রের খবর দু’টি ব্যাগেই যে সোনার বার রয়েছে, তার প্রত্যেকটিতে দুবাই-এর সরকারি ‘এমিরেটস’ সিলমোহর রয়েছে এবং একটি করে নম্বরও খোদাই করা রয়েছে। সেই কারণেই গোয়েন্দাদের প্রাথমিক অনুমান, দুবাই থেকেই এই সোনা পাচার করে ভারতে আনা হচ্ছিল। সংশ্লিষ্ট বিমানসংস্থা জানাচ্ছে, নির্দিষ্ট এই বিমানটি সোমবার সকালেই মুম্বই থেকে দুবাই গিয়ে ফেরত এসেছিল। তার পরে সেটি মুম্বই থেকে কুয়েত যাতায়াত করেছে। তার পরে মুম্বই থেকেই উড়ে গিয়েছে ব্যাঙ্কক। ব্যাঙ্কক থেকে সেটি এ দিন প্রথম বার কলকাতায় নামে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ। কলকাতা থেকে পাঁচটা পাঁচ মিনিটে উড়ে যায় পটনা। পটনা থেকে রাত আটটা নাগাদ ফেরার পরেই নাটকের শুরু।
বিমানসংস্থার এক অফিসারের বক্তব্য, “হতে পারে দুবাই থেকে বিমানটি মুম্বই ফেরার সময়ে সকালেই বিমানটির ভিতরে কেউ সোনা রেখে দিয়েছিলেন।” আবার, গত এক মাসের মধ্যে অন্য কোনও দিনও এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কারণ, গত মাসে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়ে যাওয়ার পরে মাঝের দিনগুলিতে আর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়নি। ফলে কমোডের ওই ঢাকনা খোলার কোনও প্রয়োজনও পড়েনি। এর মধ্যে বিমানটি প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বার দুবাই যাতায়াত করেছে। সুতরাং ঠিক কত সময় ধরে ওই সোনা বিমানে লুকিয়েছিল, তা স্পষ্ট নয়। অফিসারটি বলেন, “হতেই পারে, ওই সোনা দিন দশ-পনেরো আগেই শৌচাগারে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তখন থেকে সোনা নিয়েই বিমান উড়ে বেড়াচ্ছিল। পাচারকারী হয়তো সোনা নামিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ”
কিন্তু কে এই রাখতে পারে এই সোনা? বিমানসংস্থার এক অফিসারের কথায়, “যিনিই রাখুন না কেন, তিনি কমোডের ঢাকনা খুলতে জানেন। সাধারণ যাত্রীরা জানবেন না ঠিকই, তবে পেশাদার চোরাচালানকারীদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।” কিছুই অসম্ভব যে নয়, তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। শুল্ক অফিসারদের ফাঁকি দিতে সোনাদানা গিলে শরীরের মধ্যে লুকিয়ে আনার ব্যবস্থাও করে থাকে পাচারকারীরা। সেই কারণেই এ বার সন্দেহ আরও বেশি করে দানা বাঁধছে যে, তবে কি বিমানসংস্থার কর্মীদের বা বিমানবন্দরের কর্মীদের একাংশের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে পাচারকারীর? সেই জন্যই কি নির্বিঘ্নে শৌচাগারে ব্যাগের মধ্যে সোনা লুকনোর সুযোগ পেয়েছিল তারা? বিমানেরই কোনও কর্মী কি নিজে হাতে সোনা লুকিয়ে রেখেছিলেন? বিমান-কর্মীদের সাহায্য নিয়েই কি সোনা বের করে নিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা ছিল?
সন্দেহের তালিকা থেকে অতএব বাদ যাচ্ছেন না বিমানসংস্থার কর্মীরাও। শুল্ক দফতরের পাশাপাশি তাই তদন্তে নেমেছে জেট-ও। তবে বিমান সংস্থার এক অফিসার বলছিলেন, সোনা বের করার সময় শুল্ক অফিসারদের চোখ এড়ানোর জন্য বিমান-কর্মীদের প্রয়োজন না-ও থেকে থাকতে পারে। অফিসারের যুক্তি, “ভুলে যাবেন না, বিমানটি কিন্তু শেষ বার কলকাতা থেকে পটনা যাতায়াত করেছে। কলকাতা-পটনা রুটে তো আর শুল্ক অফিসারেরা ওত পেতে নেই!” বিমানসংস্থার কর্মীর সঙ্গে যোগসাজশ থাকলে বিমানটি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোন কোন শহরে উড়ে বেড়াবে, তা জেনে নেওয়া চোরাচালানকারীর পক্ষে বড় কোনও কাজ নয়।
ওই অফিসারের সন্দেহ, সোনা যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুবাই থেকে বিমানে উঠে থাকে, তা হলে তা শৌচাগারে লুকিয়ে রাখার পরে জানিয়ে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে অন্য কোনও ব্যক্তিকে। তিনি সময় হিসেব করে কলকাতা থেকে পটনা অথবা পটনা থেকে কলকাতায় আসার টিকিট কেটে থাকতে পারেন। যাত্রী সেজে বিমানে উঠে শৌচাগার থেকে সোনা নিয়ে নিশ্চিন্তে হেঁটে বেরিয়ে যাওয়াই হয়তো তাঁর ছক ছিল। কিন্তু কোনও কারণে দুয়ে দুয়ে চার না হওয়াতেই ধরা পড়ে গেল সোনা!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.