সৌরভের দাদাগিরি নয়, হলিউডের দাদাগিরি।
‘দ্য টেলিগ্রাফ’ আয়োজিত এ বারের আন্তর্জাতিক বিতর্কসভার বিষয় ছিল এটাই। ‘সংস্কৃতির জগতে হলিউডের দাদাগিরি চলছে।’ সংস্কৃতি আর দাদাগিরি-র অর্থ নিয়েই তার্কিকরা মাতলেন চুলচেরা বিশ্লেষণে। উঠে এল পছন্দের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, বিপণন কৌশল, জনপ্রিয়তার মতো প্রসঙ্গও।
ক্যালকাটা ক্লাব চত্বরে শনিবারের এই বিতর্ক জমালেন ভারতীর সিইও জহর সরকার, চিকিৎসক কুণাল সরকার, চিত্রপরিচালক অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, সাংবাদিক প্রদীপ গুপ্তু এবং অতলান্তিকের দু’পারে তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আট ছাত্র। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন চিকিৎসক সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়। সবার আগে বিষয়টি সম্পর্কে প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করে দিলেন কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল হেলেন লা ফেভ এবং ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার স্কট ফারসেডন উড।
সংস্কৃতির ধারণা দেশ ও মানুষ ভেদে পাল্টে যায়। দাদাগিরি করতে হলে জোর করে এক জনের ধারণা অন্যের উপরে চাপিয়ে দিতে হয়। হলিউড কি তা করছে? প্রস্তাবের বিপক্ষে বলতে গিয়ে প্রশ্ন তুললেন জহরবাবু। চার্লি চ্যাপলিন তো হলিউডে বসেই ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর মতো দাদাগিরি-বিরোধী ছবি বানিয়েছেন। তা ছাড়া অর্থনৈতিক আগ্রাসন থেকে সংস্কৃতির দাদাগিরিকে আলাদা করে দেখার পক্ষে জহরবাবু। অর্থনীতির আগ্রাসন মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে। কিন্তু কোনও সিনেমা ইচ্ছে না হলে দর্শক না দেখতেই পারেন। আর জনপ্রিয় ছবি মানেই তাকে খাটো করে দেখারও কিছু নেই, বললেন জহর। |
কিন্তু হলিউডের জাল কাটিয়ে কি দর্শক আদৌ অন্য ধরনের সিনেমা দেখার সুযোগ পান? সন্দেহ প্রকাশ করলেন অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। প্রস্তাবের পক্ষে মত দিতে গিয়ে তিনি জানালেন, বলিউডের সিনেমার মধ্যেও আসলে হলিউডই লুকিয়ে থাকে। ফলে তা দেশের সংস্কৃতির প্রকৃত ছবি তুলে ধরে না। প্রস্তাবের পক্ষে একাধিক বক্তা সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ধুম ৩’ ছবিটির কথা নিয়ে তুললেন। যেখানে একটি ভারতীয় ছবি শিকাগোর প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠছে।
বিপক্ষের বক্তারা আবার উল্লেখ করলেন ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’ বা ‘লাইফ অব পাই’-এর মতো ছবির কথা। যা ভারতীয় বিষয় নিয়ে তৈরি। জিতেছে অস্কারও। কিন্তু পক্ষের বক্তাদের মতে, এই ছবিগুলি বিদেশি চোখে ভারতকে দেখেছে। সেখানে হলিউডের চেনা ছকেই ভারতকে ফেলা হয়েছে।
উঠল হলিউডের বিপণন কৌশলের কথা। এই বিপণনের জন্য অন্য ধারার ছবিগুলি হারিয়ে যায় বলে পক্ষের বক্তাদের মত। ছবির বাণিজ্যের জগতে হলিউডের এই একাধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কুণালবাবু। কিন্তু ছবি তৈরির বিশাল খরচের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রদীপবাবু জানালেন, এই ধরনের বিপণন ছাড়া লাভের মুখ দেখা যাবে না। কিন্তু কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ড্যানিয়েল বার্নম্যানের মতে, এই বিপণনই নীরবে মানুষের রুচি পাল্টে দিচ্ছে। আর সেটাই দাদাগিরি। কিন্তু রুচি বদলের মধ্যে তো সরাসরি কোনও জোর-জবরদস্তির ব্যাপার নেই! তাই একে দাদাগিরি বলে মানতে নারাজ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বেন কর্নফিল্ড। তাঁর মতে, এ ভাবে ভাবলে দর্শকের পছন্দের অধিকারকে খাটো করা হয়। যদিও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গ্রেগরি ফাকুয়ার-এর মতে, দর্শক আসলে বিচ্ছিন্ন হতে ভয় পায়। তাই বাধ্য হয়েই সে জনরুচির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নেয়। হলিউডের দাদাগিরি নিয়ে অভিযোগ তোলা মানে আসলে আন্তজার্তিকতাবাদকেই অস্বীকার করা বলে মনে করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বেঞ্জামিন স্প্রাঙ্কেজার। তিনি জানান, এতে অস্বীকার করা হয় বিশ্বায়নকেও। তা ছাড়া হলিউডের সিনেমার এই প্রভাব কখনই একমুখী নয়। হলিউডেও তো নাইট শ্যামালন, অ্যাং লি-র মতো পরিচালকরা কাজ করছেন। অন্য দেশের সংস্কৃতিকে নতুন ভাবে দেখার হলিউডের এই চেষ্টাকেও দাদাগিরি বলে তিনি মানতে নারাজ। একই মত ইয়েলের ছাত্র অ্যান্ড্রু কনারি-রও। তাঁদের সঙ্গেই একমত হলেন শ্রোতারা। ভোটাভুটিতে প্রস্তাবের বিপক্ষেই হাত উঠল বেশি। |